বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে জীববিজ্ঞান যেন এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। কারো কারো মতে- খুনের শাস্তি হিসেবে ফাঁসি দেওয়ার পরিবর্তে জীববিজ্ঞান পরীক্ষা নিলেও নাকি শাস্তির পরিমাণ একটুও কম হবে না, বরং হয়তো কিছু বেশিই হবে! তবে জীববিজ্ঞানের জটিল এই জগতে প্রকৃতির রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীদেরই যেখানে গলদঘর্ম অবস্থা হয়, সেখানে ছাত্রদেরই বা কতটুকু দোষ দেওয়া যায়? জীববিজ্ঞান নামক নীরস এই বিষয়কে নিছক গল্পের ছলে একটু হলেও সরস করে তোলার চেষ্টায় লেখক হাসান উজ-জামান শ্যামল আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন স্বপ্নপুরী হাই স্কুলের ধারণা। যেখানে ছাত্রের কোনো দোষ নেই, সমস্ত দোষ শিক্ষকের!
ছোটবেলায় ক্লাসে বসে কখনও কি এমন মনে হয়েছে যে- সারা ক্লাসে শিক্ষকের বকবকানির একটি শব্দও আপনার মস্তিষ্কে ঢোকেনি? তখন নিজের কাছে নিজেরই একটু হলেও খারাপ লাগা স্বাভাবিক। কিন্তু এমনটা যদি হয় যে আপনি ক্লাসের বিষয়ের একেবারে গভীর থেকে বিশ্লেষণ করছেন বলে আপনার কাছে শিক্ষকের কথা নিছক বকবকানি মনে হয়েছে। আপনার এই গভীর থেকে বিশ্লেষণের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে যদি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হতো, হয়তো আপনি সহজেই বিষয়টি বুঝতে পারতেন। লেখকের কল্পনার স্বপ্নপুরী হাই স্কুলের শিক্ষার্থী হতে পারলে হয়তো আপনিই হতেন ক্লাসের সেই না বোঝা বিষয়টির একজন বিশেষজ্ঞ ধরনের কেউ!
‘এটাই সায়েন্স- ২: স্বপ্নপুরী হাই স্কুল’ লেখক হাসান উজ-জামান শ্যামলের দ্বিতীয় বই। তার প্রথম বই ‘এটাই সায়েন্স: বাংলাদেশের অজানা কিছু গবেষণার গল্প’ বইয়ের ন্যায় এই বইয়েও গল্প বলার ঢঙে পাঠকের কাছে বিজ্ঞানকে তুলে ধরেছেন তিনি, অবতারণা করেছেন কাল্পনিক স্বপ্নপুরী হাই স্কুলের ধারণা। তার ধারণা, এই হাই স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছে অতি শীঘ্রই সহজ, সুন্দর ও বোধগম্য একটি বিষয় হয়ে উঠবে জীববিজ্ঞান!
স্বপ্নপুরী হাই স্কুলের এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জীববিজ্ঞানের একের পর এক গল্প তুলে ধরেছেন লেখক। তবে তার এসব গল্প যথেষ্ট সরস, রোমাঞ্চকর ও কৌতূহলোদ্দীপক। আমাদের দেহের কলকব্জায় যেন লুকিয়ে আছে দুনিয়ার তাবৎ রহস্য। বিজ্ঞানীরা কোনো একটি রহস্যের সমাধান করে বসলেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে আরেক রহস্য। বিজ্ঞানীদের ক্রমাগত গবেষণার পরও জীববিজ্ঞানের গল্প যেন প্রতিনিয়ত প্রকৃতির রহস্যের কাছে আমাদের নাজেহাল হওয়ার গল্প।
আমাদের দেহের কলকব্জার এমন কিছু রহস্যের গল্প লেখক তুলে ধরেছেন খুব সাবলীলভাবে। এই যেমন ডিএনএ-র কাজ যে শুধু বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্যের ধারা রক্ষা নয়, বরং জাল ফেলে জীবাণু ধরার মতো কাজেও ব্যবহৃত হয় তা। আবার কোনো নির্দিষ্ট কাজের এক এনজাইম সক্রিয় অবস্থায় তার নির্দিষ্ট কাজটি করলেও কখনো কখনো তা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পরিবর্তিত হয়েও কোষের বিভিন্ন কাজে আসতে পারে। যথোপযুক্ত বাস্তবসংগত উদাহরণের সাথে লেখকের সাবলীল গদ্যে বিজ্ঞান জানছেন, নাকি নিছক গল্প পড়ছেন- এ বিষয়ে পাঠক যথেষ্ট সন্দিহান হয়ে উঠতে পারেন!
বিজ্ঞানীদের নানা গবেষণার পেছনের তদন্ত যে শার্লক হোমস কিংবা ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির চেয়ে কোনো অংশেই কম কিছু নয়- এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করবেন পাঠক। গিরগিটির শিং পাওয়ার গল্প কিংবা প্রজাতির সংজ্ঞা সম্পর্কে মানুষের ধারণার ক্রমাগত পরিবর্তনের গল্প মুগ্ধ করবে আপনাকে।
পাঠক অবাক নয়নে লক্ষ করবেন- বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলে বিদায় নেব নেব করছে যে করোনা মহামারি, তার পেছনে দায়ী কেবল বারোটি অক্ষর! আর এই বারো অক্ষরের তেরো প্যাচে পড়ে বিজ্ঞানীদের কীভাবে নাজেহাল অবস্থা হয় তা-ও তুলে ধরেছেন লেখক । চীনের উহানের এক বাজার নাকি কাছাকাছি দূরত্বের এক গবেষণাগার- কোথায় হয়েছে এই ভাইরাসের উৎপত্তি? তাবৎ বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে জনসাধারণের মনে বিভেদের দাগ কেটে দেয় যেন এই একটি প্রশ্ন। অতীতের নানা মহামারি থেকে শিক্ষা নিয়ে বিজ্ঞানের আতশিকাচের নিচে এই প্রশ্নকে ফেলে ক্রমাগত চলছে গবেষণা। লেখক দেখিয়েছেন- প্রকৃতিতেই করোনাভাইরাসের উৎপত্তি কিনা তা নিশ্চিত না হলেও এখন পর্যন্ত ভাইরাসটি যে ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়েছে এমন ধারণার পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো প্রমাণ নেই!
জীববিজ্ঞান কি নাগরিক জীবন, সাহিত্য কিংবা দর্শন থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয়? মোটেই না। বাইরের এসব জগতের সাথে জীববিজ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে বের করতে না পারাও একে দুর্বোধ্য এক বিষয় মনে হওয়ার একটি কারণ। কিন্তু এমন যদি হয় যে, দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি আমাদের তেমন কোনো কষ্ট ছাড়াই রীতিমতো একটি গবেষণার তথ্য সংগ্রহের অংশ হয়ে যাই। একটি বিশেষ ধরনের জুতা পরে নিত্যদিনকার কাজ শেষে আমরাও যে একটি এলাকায় মাটি ও পানিতে জীবাণুর উপস্থিতি নির্ণয় গবেষণার অংশ হয়ে উঠতে পারি!
জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত উপন্যাস ‘নাইন্টিন এইটি ফোর’-এর সাথে কি বিজ্ঞানকে কোনোভাবে মেলানো সম্ভব? বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে সূক্ষ্মদর্শিতা আর বিশ্লেষণাত্মক মনোভাবের জন্য দরকার ভাব প্রকাশের দক্ষতা। এই ভাব প্রকাশের দক্ষতা রপ্ত করতে হলে যেন সাহিত্য পড়ার বিকল্প নেই। বইটি পড়া শেষ করে পাঠক লক্ষ্য করবেন- নামিবিয়ার উপজাতিদের উপর এক গবেষণা আর ‘নাইন্টিন এইটি ফোর’-এর মধ্যে যেন লুকায়িত আছে তেমনি এক ধারণা!
লেখক বইয়ের একদম শেষাংশে দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন- দর্শনও আর দশটা বিজ্ঞানের শাখার ন্যায় একটি নিয়মতান্ত্রিক গবেষণার অংশ। আলোচনা শেষে প্রত্যেক অধ্যায়েই লেখক জুড়ে দিয়েছেন বেশ কিছু গবেষণাপত্র কিংবা বইয়ের নাম, যা পাঠকের কৌতূহল মেটাবে দারুণভাবেই।
লেখক হাসান উজ-জামান শ্যামল যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিনের পিএইচডির শিক্ষার্থী। তার গবেষণার বিষয়বস্তু জীবাণু! গবেষণার পাশাপাশি জীববিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে লেখালেখি ও ভিডিও আলোচনা করেন তিনি। বিজ্ঞানের কাঠখোট্টা সব বিষয়ের সরল ও সরস আলোচনায় রীতিমতো সিদ্ধহস্ত তিনি।
সংক্ষিপ্ত বই পরিচিতি
বই: এটাই সায়েন্স-২: স্বপ্নপুরী হাই স্কুল
লেখক: হাসান উজ-জামান শ্যামল
প্রকাশনী: অধ্যয়ন
প্রচ্ছদ: জয় দেব নাথ
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১২৮
মুদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা