চে; কেউ তাঁকে ‘ক্রেজি কমিউনিস্ট’ বলবে, কারো কাছে আবার তিনি স্রেফ টি-শার্টের ছবি। কিন্তু সবকিছুকে ছাড়িয়ে তিনি এমন একজন সত্যিকারের স্বপ্নবাজ মানুষ, যিনি লাতিন আমেরিকার নিপীড়িত মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে সবসময় প্রস্তুত ছিলেন। তার মত ও পথের সাথে আমাদের বিরোধ হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু তার স্পিরিটের সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তিনি পৃথিবীর সব নিপীড়িত মানুষের নেতা। কারো কাছে তিনি যখন রুপকথা, ইয়াংকি সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে তিনি তখন এক মূর্তমান আতঙ্কের নাম।
চে’র জীবনের শেষের দিনগুলো কেটেছে বলিভিয়ায় । বলিভিয়ার পাহাড়ে আর জঙ্গলে ।
কিউবায় সফল বিপ্লবের পর চে কিউবার মন্ত্রী হন। শুধু মন্ত্রী নন, সারা পৃথিবীর কাছে এক মহানায়ক হয়ে ওঠেন। কিন্তু বিপ্লব যার রক্তে, সারা দুনিয়ার সব নিপীড়িত মানুষের গল্প যার করোটিতে এসে ভিড় করে, তিনি তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। আস্তে আস্তে মন্ত্রিত্ব আর লাইমলাইট থেকে সরে এসে কঙ্গোতে চলে যান। কঙ্গোতে ব্যর্থ বিপ্লবের পর চে বলিভিয়ায় যান। বলিভিয়ায় এগারো মাস ধরে লেখা তার ডায়েরিতে তিনি প্রতিটি দিনের প্রত্যেকটি গুরুত্ববহ ঘটনা লিখে গেছেন। সে লেখা কেবল লেখার জন্যই লেখা নয়, রীতিমতো বিশ্লেষণধর্মী লেখা। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সমস্ত ঘটনা লেখা। তিনি কিছুটা সাবধানতার সাথেই ডায়েরি লিখতেন, যাতে শত্রুপক্ষের হাতে পড়লেও এখান থেকে তারা খুব বেশি বা গোপনীয় তথ্যগুলো উদ্ধার করতে না পারে।
চে বিশ্বাস করতেন- একজন বিপ্লবীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শৃঙ্খলাবোধ। ডায়েরির বহু জায়গায় তিনি সরাসরি এ কথা লিখেছেন বা অন্য বিপ্লবীদের বলেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজেও প্রচণ্ড শৃঙ্খলাপরায়ণ মানুষ ছিলেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ তার এই ডায়েরি। প্রতিদিনের ঘটনা প্রতিদিন নিখুঁতভাবে লিখে তো রাখতেনই , পাশাপাশি প্রতি মাসের শেষে ঐ মাসের উপর একটি সার্বিক বিশ্লেষণও লিখে রাখতেন। অমানুষিক জীবন প্রবাহের মাঝেও এই কাজটি করতে তিনি কখনো ভুল করতেন না। বিপ্লবী গেরিলা দলে নিয়ম ভাঙার জন্য শাস্তিও বরাদ্দ ছিল। চে কখনও গেরিলা দল থেকে বের করে দেয়ার ভয় দেখাতেন, কখনও ঐ যোদ্ধাকে কিছু সময়ের জন্য নির্দিষ্ট খাবার দেয়া বন্ধ করে দিতেন, কখনো কাজ করার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন বা অন্য কোনো শাস্তি দিতেন।
বলিভিয়ায় গিয়ে চে’র প্রথম কাজ ছিল যথেষ্ট পরিমাণে গেরিলা যোদ্ধা, বিশেষত বলিভিয়ান গেরিলা যোদ্ধা সংগ্রহ করা এবং বলিভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে তাদের সাহায্য পাওয়ার পথ তৈরি করা। উল্লেখ্য, দুটি কাজই করতেই ব্যর্থ হন চে। বলিভিয়ার বিপ্লবে কিউবা, আর্জেন্টিনাসহ বিভিন্ন দেশের বিপ্লবীরা অংশ নিলেও বিভিন্ন কারণে চে বলিভিয়ার বিপ্লবীদের সংখ্যা বাড়ানোতে আগ্রহী ছিলেন। আর গেরিলাদের সংখ্যা নিয়ে সবসময়ই এক হতাশা ছিল তার। ডায়েরির এক জায়গায় তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের দলে এখন আরো একশো গেরিলা বিপ্লবী নেই।” অন্যদিকে বলিভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি কখনো চে-কে সেভাবে সাহায্য তো করেইনি, বরং কোথাও কোথাও বিপ্লবের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বলিভিয়ার সশস্ত্র বিপ্লবের সময়ে বিপ্লবীদের নিজেদেরও ছোটখাট কিছু সমস্যা ছিল। প্রথমত, পুরো এগারো মাস জুড়ে সবসময়ই অপর্যাপ্ত খাবার গেরিলা দলের অনেক বড় এবং অনতিক্রম্য সমস্যা ছিল। বিশেষভাবে বলতে গেলে শেষের মাসগুলোতে এই সমস্যা এত প্রকটভাবে দেখা দেয় যে, জল আর খাবারের অভাবে অনেক বিপ্লবী নিজেদের মূত্র খেয়ে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এগারো মাস জুড়েই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিপ্লবীর নির্ধারিত খাবারের চেয়ে বেশি খাওয়া, খাবার চুরি করে খাওয়ার কথা চে তার ডায়েরিতে লিখে গেছেন। এর বাইরেও বিপ্লবীদের ঝগড়া-বিবাদের মতো ছোটখাট উপেক্ষণীয় সমস্যা লেগেই ছিল। এগুলোকে উপেক্ষণীয় বলার কারণ এরকম দুর্গম অঞ্চলে বন্য পরিবেশে একসাথে চলতে গেলে এসব হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
সহযোদ্ধাদের ভালোবাসতেন চে। তাদের বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা নিয়ে তার উদ্বেগ ডায়েরির লেখাতেও প্রকাশ পায়। মৃত্যুকে জীবন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই নিতেন তিনি। ঠিক সেজন্যই বোধহয় সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর খবরে আবেগ প্রকাশ করতেন না। ব্যতিক্রম কেবল রোলাণ্ডো আর টুমা। বিভিন্ন কাজে পারদর্শী এবং বিশ্বস্ত রোলাণ্ডো গেরিলা দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। নানা সময়ে নানা প্রয়োজনে এই মানুষটির উপর আস্থা রেখেছিলেন চে। তার মৃত্যু চে-কে চিন্তিত করে তোলে। টুমার মৃত্যুতে চে লিখেছিলেন, তিনি যেন তার ছেলেকে হারিয়েছেন। মৃত্যুর সময় নিজের ছেলের জন্য হাতের ঘড়ি খুলে দেন টুমা, যে ছেলেকে কখনো দেখতে পাননি তিনি।
চে তার শত্রুর সাথেও মানবিক আচরণ করতেন। বহুবার সৈন্যদের বন্দী করেও তাদের প্রাণে না মেরে ছেড়ে দিয়েছেন। খুব বেশি হলে গেরিলা বাহিনী বন্দী সৈন্যদের প্রায় উলঙ্গ করে, অর্থাৎ শুধু অন্তর্বাস রেখে আর সব পোশাক খুলে রেখে মুক্তি দিতো। সাতষট্টি সালের জুনের তিন তারিখে নিজেদের অত্যন্ত করুণ সময়ে দুজন সৈন্যকে মারার সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দেন তিনি। এ নিয়ে চে ডায়েরিতে লিখেছেন, “ঠিক গতকালের মতো দুজন অল্পবয়স্ক সেনা কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছে দেখতে পাই। ছেলে দুটোকে গুলি করে মারতে ইচ্ছে করে না।“
চে’র আরেকটি বড় গুণ হলো আত্মসমালোচনা। পুরো ডায়েরি জুড়ে তিনি যতটা না তার শত্রুদের বিশ্লেষণ করেছেন, তার থেকে অনেক বেশি বিশ্লেষণ করেছেন গেরিলা বাহিনীকে। তিনি নিজের ভুল যেমন অকপটে স্বীকার করেছেন, ঠিক তেমনি অন্যদের সমালোচনা করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। তিনি ডায়েরি লিখেছেন নির্মোহভাবে এবং নিরপেক্ষভাবে। ২রা মে কিউবায় রেডিও হাভানার ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সংবাদ বলা থেকে শুরু করে ছাব্বিশে আগস্টে তার নিজের মেজাজ হারিয়ে অ্যান্টনিওকে কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করা– এর কিছুই লিখতে বাদ রাখেননি। কোথায় কোথায় কী কী করেছেন, কোনটা ভুল ছিল, কোনটা ঠিক করেছেন, তা-ই লিখেছেন ডায়েরির বড় অংশ জুড়ে।
এই ডায়েরিতে রাজনৈতিক আলাপ প্রায় নেই বললেই চলে। এমনকি চে তার আদর্শ আর লক্ষ্য নিয়েও খুব একটা কথা বলেননি। কেবল গেরিলা বাহিনীর পথচলা, কর্মপরিকল্পনা এবং ঘটনাপ্রবাহ নিয়েই এই ডায়েরি লিখেছেন।
মানবজাতির সভ্যতা স্থাপনের পর থেকেই যুগে যুগে শাসক এবং শোষকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে নিপীড়িত মানুষেরা। স্পার্টাকাস থেকে একাত্তরের মুক্তিবাহিনী; সময়ের প্রয়োজনে স্বাধীনতাকামী মানুষকে বেছে নিতে হয়েছে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ। ভবিষ্যতের সকল সশস্ত্র, বিশেষত গেরিলা সংগ্রামের জন্য চে’র ডায়েরি এক প্রেরণা এবং নির্দেশনার উৎস হয়ে থাকবে।
ডায়েরিটি যদিও চে’র নিজের, তবু তাঁর নিজেকে নিয়েও খুব একটা লেখা পাওয়া যায় না ডায়েরিতে। বলিভিয়ার এগারো মাস জুড়ে হাঁপানির সমস্যা তাঁকে ভুগিয়েছে। কখনো কখনো হাঁপানি অসহ্য হয়ে উঠেছে। হাঁপানির ওষুধপত্র সৈন্যরা জব্দ করায় এ সমস্যা আর সঙ্গীন হয়ে উঠেছে। বেশ কিছু দিন হাঁপানির সমস্যা নিয়ে লিখলেও সেটা লিখতে এক-দুই লাইনের বেশি খরচ করেননি তিনি।
বলিভিয়ার সেনাবাহিনী চে এবং গেরিলা বাহিনীকে যথেষ্ট সমীহ করতো বলেই তিনি মনে করতেন। গেরিলা বাহিনীর শক্তি এবং মনোবলকে খাটো করে দেখতো না সেনাবাহিনী। তবে নিজেদের সুবিধার জন্য বা নিজেদের মধ্যে গেরিলাদের নিয়ে যাতে আতঙ্ক সৃষ্টি না হয় সেজন্য বহুবার মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ করেছে। চে জানতেন, পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধে এসব ঘটে এবং এসবকে তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই নিতেন।
বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বলিভিয়ার চাষীদের কাছ থেকে গেরিলা বাহিনীর কোনো রকম সাহায্য না পাওয়া। উপরন্তু, এই চাষীরাই একসময় সেনাবাহিনীর কাছে গেরিলাদের গতিবিধির খবর পৌঁছে দেয়ার প্রধান বাহক হয়ে ওঠে। চাষীদের সাহায্য না পাওয়ার আক্ষেপ ছিল পুরো ডায়েরি জুড়ে।
এগারো মাসের সশস্ত্র বিপ্লবের সময় জুড়ে কি নারকীয় যন্ত্রণাভোগ করতে হয়েছে গেরিলা বাহিনীকে তার অনন্য দলিল এই ডায়েরি।
চে’র মৃত্যু এই ডায়েরির অংশ নয়। অথচ মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি ডায়েরি লিখেছেন। উনিশশো সাতষট্টি সালের সাত অক্টোবর শেষ ডায়েরি লেখেন চে। আট অক্টোবর আহত অবস্থায় ধরা পড়েন। তার পরের দিন, অক্টোবরের নয় তারিখ, দুপুর একটা দশ মিনিটে তাকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়।
টেরিন যখন গুলি করে হত্যা করার জন্য চে’র সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তখন চে বলেছিলেন, “জানি, তুমি আমাকে হত্যা করতে এসেছো। গুলি করো কাপুরুষ, তুমি তো শুধু একটা মানুষকেই হত্যা করতে পারবে।“
একজন মানুষকে তো হত্যা করা যায়, কিন্তু আদর্শ আর স্বপ্নকে কি হত্যা করা যায়?
চে’র সাথে বলিভিয়ার জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে চাইলে পড়ে নিতে পারেন এ ডায়েরিটি।