এই সিনেমায় থাকা এগারোটি গল্প মূলত ঢাকা শহরে বাস করা এগারো ধরনের মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করছে। শহরের বুকে তাদের প্রত্যেকের জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার যে যন্ত্রণা, তা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সিনেমা দেখার সময় মনে হচ্ছিল, এরা যেন সবাই ঢাকার হয়ে সমগ্র দেশের কাছে আবেদন জানাচ্ছে, তাদের জীবনযাপনের ধরনটা যেন কেউ দেখে। নামকরণ হিসেবে তাই ‘ইতি, তোমারই ঢাকা’ যথার্থই মনে হয়েছে।
কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ
অ্যান্থলজি ফিল্ম প্রকৃতপক্ষে কীরকম, সেটা নিয়ে অনেকের মনে অনেক সংশয় থাকতে পারে। থাকাটাই স্বাভাবিক, কারণ এর আগে গত ছয় দশকে আমাদের দেশে কোনো অ্যান্থলজি সিনেমা হয়নি, যেখানে আমাদের প্রতিবেশী কলকাতায় সেই ষাটের দশকেই ‘তিনকন্যা’ নামে একটি অ্যান্থলজি সিনেমা তৈরি হয়েছে। পুরো বিশ্বব্যাপী এই জনরাটি যেখানে অতি পরিচিত, সেখানে কেন আমাদের দেশের নির্মাতারা এ জনরায় কাজ করার চেষ্টা আগে করেননি, সেটা বেশ চিন্তা-ভাবনার বিষয়।
যদি সহজ ভাষায় বলি, অ্যান্থলজি ফিল্ম বা অমনিবাস ফিল্ম বলতে আমি বুঝি কয়েকটা ছোটগল্পকে পর পর জুড়ে দিয়ে একটি পূর্ণ্যদৈর্ঘ্যের সিনেমা বানিয়ে ফেলা। এখন এক্ষেত্রে এমন কিছু ছোটগল্প জুড়ে দেওয়া হয়, যেগুলোর মূল ভিত্তি একইরকম থাকে; যেমন- কোনো পরিচিত জায়গা বা শহর, কিংবা কোনো অঞ্চলের ভূতপ্রেত, কোনো বস্তু কিংবা কোনো এক মানুষ ইত্যাদি।
সাধারণত এ ধরনের সিনেমায় একাধিক গল্পে ভিন্ন ভিন্ন অভিনেতা ও পরিচালক থাকেন, তবে যদি এক পরিচালক ও একই অভিনেতা একাধিক গল্পের যথাক্রমে পরিচালনা ও অভিনয় করেন, তবে সেটিকেও অ্যান্থলজি সিনেমা বলা যেতে পারে। সবমিলিয়ে অ্যান্থলজি সিনেমার প্রধান শর্ত হলো, এখানে একাধিক গল্প থাকবে, যেগুলো একত্র করে একটি প্যাকেজ তৈরি করা হয়।
‘ইতি, তোমারই ঢাকা’ তৈরির পেছনে মূল ভাবনা ‘জালালের গল্প’ খ্যাত পরিচালক আবু শাহেদ ইমনের। তার উদ্যোগেই মূলত এগারোজন সম্ভাবনাময় তরুণ পরিচালক একত্র হতে পেরেছেন। সিনেমাটি দেখার পর মনে হয়েছে, এটি ২০০৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আমেরিকান অ্যান্থলজি ফিল্ম ‘নিউ ইয়র্ক, আই লাভ ইউ’ থেকে বেশ খানিকটা অনুপ্রাণিত। দুটি সিনেমার গঠনগত দিক থেকে বেশ খানিকটা মিল পাওয়া যায়। যদিও ওখানে রোমান্সের ওপর কিছুটা জোর দেওয়া হয়েছে, আর এখানে জোর দেওয়া হয়েছে মানুষের কষ্ট বা আবেগীয় পরিস্থিতির ওপর।
এখানে মোট এগারোটি গল্প আছে। এগুলো কেমন ছিল, তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেখে নেওয়া যাক।
১. ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট
গল্প: নুহাশ হুমায়ূন
‘ইতি, তোমারই ঢাকা’র প্রথম গল্প ছিল এটি। এখানে বড় পর্দায় অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে কাজ করা একজন অভিনেতার জীবনযুদ্ধ দেখিয়ে গল্পটি শুরু হয়। সময়ের সাথে সাথে গল্পটি স্থানান্তরিত হয় এক দর্জির দিকে, যিনি অভাব এবং নিজ পেশার প্রতি সমাজের কটুদৃষ্টির কারণে ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করাতে পারছিলেন না। পরবর্তী সময়ে এই দুটি মানুষ কীভাবে একে অন্যের উপকার করতে পারেন, সেটাই দেখা যায়। গল্পের দিক থেকে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট’কে আমার মনে হয়েছে বাকি ছবিগুলোর তুলনায় অন্যতম সেরা। যথেষ্ট কমেডি ও হিউমারের সাথে এটি উপস্থাপন করায় শুরুতেই এমন একটি গল্প দর্শককে নড়েচড়ে বসতে এবং সিনেমার সাথে নিজেকে জুড়ে নিতে সাহায্য করে।
২. চিয়ার্স
গল্প: রফিকুল ইসলাম পল্টু
সদ্য ব্রেকআপ হওয়া এক মেয়ে ও তার বান্ধবী ব্যাপক মানসিক কষ্টে ভুগতে থাকা অবস্থায় ঠিক করে, তারা মদ্যপান করবে। এর আগে তারা শুনেছে যে এতে নাকি মনের কষ্ট দূর হয়। এখন ঢাকা শহরে এমনিতেই মদ্যপান করা একধরনের অপরাধের শামিল, তার ওপর একজন নারী যদি মদ্যপান করে, তবে তাকে কতটা বাঁকাচোখে দেখা হয় সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তো দুই বান্ধবী মিলে কীভাবে সেই কঠিন কাজটা করে। মূলত এ শহরে নারীদের কেমন চোখে দেখা হয়, সেটাই এ গল্পে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এ গল্পে অর্চিতা স্পর্শিয়ার দেওয়া একটি সংলাপে জনপ্রিয় সিনেমা ‘আয়নাবাজি’র রেফারেন্স টেনে হিউমারের সৃষ্টি করা হয়েছে, যা বেশ উপভোগ্য ছিল।
৩. জীবনের GUN
গল্প: রাহাত রহমান
নামকরণটাই বড্ড ইউনিক, এখানে GUN মানে হলো বন্দুক। বন্দুক হাতে এলেই যে ভালো শ্যুটার হওয়া যায়, বিষয়টি তেমন না। ট্রিগারে চাপ দেওয়ার জন্য বুকে সাহস থাকা লাগে, গায়ে জোর থাকা লাগে। বাকি সব গল্পের তুলনায় এটি গভীরতার দিক থেকে একটু পিছিয়ে থাকলেও এর উপস্থাপনা দারুণ।
৪. মাগফিরাত
গল্প: তানভীর চৌধুরী ও রবিউল ইসলাম রবি
এক সাধারণ ড্রাইভারের মানসিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে এ শহরের বাস্তবতার নানারকম দ্বন্দ্ব দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বাকি দশ গল্প থেকে এই গল্পটি একটু অন্যরকম সৃজনশীল চিন্তাভাবনার ছাপ রেখে যায়, যদিও গল্পটি এভাবে মাঝে বসানোটা একটু খাপছাড়া ছিল। এ গল্পটি ছবির একদম শুরুতে, দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে কিংবা একদম শেষে বসানো উচিত ছিল। পর পর তিনটি গতিশীল চিত্রনাট্যের পর ‘মাগফিরাত’ এর মতো গভীর চিন্তা-ভাবনার গল্প সামনে আসায় এর সাথে দর্শকের যোগাযোগ স্থাপনে সমস্যা হবার কথা।
৫. সাউন্ডস গুড
গল্প: সরদার সানিয়াত হোসেন ও গোলাম কিবরিয়া ফারুকী
নাটক বা সিনেমার শ্যুটিংয়ের সময় পর্দার পেছনে বুম বা মাইক সামলান, এমন একজন কলাকুশলীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গল্পটি দেখানো হয়, যার কাছে অতি শক্তিশালী একটি মাইক্রোফোন থাকে, যার মাধ্যমে তিনি রুমের বাইরে বসে ভেতরের কথাবার্তা শুনে ফেলতে পারেন। আইডিয়াটি শুনতে অসাধারণ মনে হলেও আদতে যা দেখানো হয়েছে, তা ব্যক্তিগতভাবে আমার ভালো লাগেনি। এটি এই সিনেমার অন্যতম দুর্বল উপস্থাপনের গল্প বলেই মনে হয়েছে।
৬. অবিশ্বাসের ঢাকা
গল্প: মীর মোকাররম হোসেন
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু হয় এই গল্প দিয়ে। গল্পটি খুবই শক্তিশালী একটি বার্তা দেয়, এ শহরে কারো বিপদের সময় সাহায্যের হাত বাড়ানোর আগে অবশ্যই নিজের দিকটা আগে চিন্তা-ভাবনা করে নিতে হয়, অন্যথায় অন্যকে টেনে তুলতে গিয়ে নিজে গর্তে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ঢাকা শহরে এরকম ঘটনা অহরহ হয়, তাই খুব সহজেই এর সাথে দর্শক যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন।
৭. আকাশের পোষা পাখিরা
গল্প: তানভীর আহসান
শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের এক মা ও মেয়ের গল্প। মায়ের ছেলে কোনো এক কারণে জেলহাজতে আটক, সেই সাথে মেয়ে অন্য এক ছেলের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে এখন প্রতারণার শিকার হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও নিজের ছেলেমেয়েদের সামলাতে একজন মাকে কতটা কষ্ট করতে হয়, সেটা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। গল্পটি বেশ হৃদয়স্পর্শী করে উপস্থাপন করায় এর সাথে সহজেই নিজেদের জুড়ে নেওয়া যায়। গল্পের শেষটা অবশ্য অসম্পূর্ণ রাখা হয়েছে।
৮. ঢাকা মেট্রো
গল্প: মাহমুদুল ইসলাম
এক মধ্যবিত্ত যুবকের স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি, সেই সাথে তার গাড়িটাও চুরি হয়ে গিয়েছে। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য যখন তার প্রচুর টাকার প্রয়োজন, তখন তার সাথে পরিচয় হয় এক চোরাকারবারির। এখন তিনি কীভাবে সেই গাড়িটি উদ্ধার করেন, সেই গল্পই এখানে দেখা যায়। গল্পের শেষটা একটু ওভার দ্য টপ গেলেও সবমিলিয়ে উপভোগ্য ছিল।
৯. এম ফর মানি/মার্ডার
গল্প: তানিম নূর
নাম শুনলে যদিও আলফ্রেড হিচককের জনপ্রিয় ছবি ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’ এর কথা মনে পড়ে, আদতে গল্প দুটির মধ্যে তেমন মিল নেই। ব্যাংকিং খাতের কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়া উঁচু শ্রেণীর এবং নিচু শ্রেণির দুই কর্মকর্তার মধ্যকার মানসিক সংঘর্ষ দেখানো হয়েছে এই গল্পে। এই গল্পে থ্রিল এবং সাসপেন্স দুটোই যথেষ্ট আছে, যা অন্য দশ গল্প থেকে একে আলাদা করেছে। থ্রিলারপ্রেমীদের জন্য উপভোগ্য হবে।
১০. জিন্নাহ ইজ ডেড
গল্প: কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়
এটা মোটামুটি সবাই জানেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধিতা করা সত্ত্বেও সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করায় ঢাকা শহরের মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ নানা জায়গায় ভারতীয় বিহারীরা এখনো বসবাস করছে। এ গল্পটি তাদের নিয়েই। তাদেরকে বর্তমান সমাজে কতটা নিচু স্তরের ভাবা হয়, সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে। এর আগে আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসে বিহারীদের নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। সেই হিসেবে এটি খুবই সাহসী নির্মাণ। বিশেষ করে যারা মিরপুর কিংবা মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের আশেপাশে থাকেন, তারা বুঝতে পারবেন যে, ওখানে গিয়ে শ্যুট করা কতটা কষ্টসাধ্য একটি কাজ।
১১. যুথী
গল্প: মনিরুল ইসলাম রুবেল
এ ছবির শেষ গল্প, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে এটি খুবই শক্তিশালী বার্তা দেয়। গল্পের মাঝে চমক আছে, শক্তিশালী সংলাপ আছে। প্রথম গল্প ‘ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট’ এর পাশাপাশি ‘যুথী’কেও মনে হয় এই ছবির অন্যতম সেরা গল্প।
সংলাপের দিক থেকে ‘ইতি, তোমারই ঢাকা’ অত্যন্ত শক্তিশালী। ‘ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট’ এ মোস্তাফিজুর নূর ইমরানের বলা “সিনেমার পর্দায় দেখা হবে”, ‘চিয়ার্স’-এ নওফেলের দেওয়া “হেব্বি কড়া!”, ‘ঢাকা মেট্রো’তে শতাব্দী ওয়াদুদের “আপনের চারপাশে তো দেখতেছি শনি লাইগা রইছে”, ‘এম ফর মানি/মার্ডার’-এ গাউসুল আলম শাওনের “আমারে ফাঁসানো এত সহজ না, এই মাঠে অনেকদিন ধরে খেলতেছি” এবং ইরেশ যাকেরের “আবিদুর রহমান জানতো না, এস্কেপ রুট আমারও সবসময় খোলা থাকে”, ‘জিন্নাহ ইজ ডেড’-এ লুৎফর রহমান জর্জের “কিসকো কাটকে রাখেগা বে?”, ‘যুথী’তে নুসরাত ইমরোজ তিশার “এর পরেরবার নিয়ে আসলে ভাড়াটা তুমি দিও, গাড়ির সাথে আমারটাও” মনে রাখার মতো কিছু সংলাপ।
পরিচালনা
‘ইতি, তোমারই ঢাকা’র মধ্য দিয়ে মোট এগারোজন পরিচালকের বড় পর্দায় অভিষেক হলো। তাঁদের সবাই দারুণ প্রতিভাবান এবং ভীষণ সম্ভাবনাময়। বিশেষ করে নুহাশ হুমায়ূন, তানভীর আহসান, তানিম নূর, কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় এবং সালেহ সোবহান অনীমের ব্যাপারে বলতে হবে। তবে অন্যরাও যে পিছিয়ে ছিলেন এ কথা মোটেও বলা যাবে না। আগামী দিনগুলোতে এই প্রতিভাবান পরিচালকদের কাছ থেকে আমরা সৃজনশীল ও ব্যতিক্রমী আরও অনেক কিছুই পাব- এমন প্রত্যাশা তো করাই যায়।