উর্দু্র সাথে যদিও আমাদের বিরোধ আছে, তবে এর মূল কারণ কিন্তু কোনো লেখক বা চাষাভুষো শ্রেণির কেউ নন; স্বয়ং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তবে সে আলোচনা এখানে মুখ্য নয়। এখানে মূলত বলা হবে উর্দু লেখক কৃষণ চন্দরের লেখার কথা। তার হাত থেকে প্রায় ২০ খানা উপন্যাস আর ৩০ খানা ছোটগল্পের সমগ্র বেরোলেও সেখান থেকে গুটিকয়েকই অনূদিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। জন্ম ১৯১৪ সালের নভেম্বরে, রাজস্থানের ভরতপুরে; যদিও পরিবারের গোড়াপত্তন ছিল পাঞ্জাবের ওয়াজিরাবাদে। পাকিস্তান ছেড়ে আসার পর তিনি হিন্দিতে লেখালেখি শুরু করেন। তার মৃত্যু হয় ৬২ বছর বয়সে, মুম্বাইয়ে। বস্তুত কৃষণ চন্দরের লেখা নিয়ে পড়ার মূল হেতু একটাই, তার লেখা না পড়লে আমাদের জ্ঞান ভাণ্ডার বা সাহিত্যভাণ্ডারে এতটুকু ‘রস বিলোপ’ ঘটবে না, তবুও যুদ্ধ এবং দাঙ্গার ভয়াবহতা সম্পর্কে আঁচ করতে গেলে তার লেখার ধার ধারাটা আবশ্যক।
এই লেখার মূল পটভূমিকার চিত্রকর অবশ্যই কৃষণ চন্দর, এবং এর পুরোটাই আবর্তিত হয়েছে র্যাডক্লিফ সাহেবের কলমের খোঁচার কল্যাণে। অর্থাৎ দেশ ভাগ নিয়ে ছোটগল্প ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’ সম্পর্কেই বলতে আসা। অনুবাদক জাফর আলমের অনূদিত বই ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’ এর মূল লেখক কৃষণ চন্দর; এই নামে একটি গল্প ছাড়াও এতে আরও আটটি ছোটগল্প আছে; যার প্রতিটিই দেশবিভাগের ভয়াবহতা বিশ্লেষণ করেছে নানান দিক দিয়ে। বইটির প্রকাশক ‘প্রথমা প্রকাশন’।
দেশবিভাগের সময়ই যখন শরণার্থী বিনিময় শুরু হয়, তার প্রারম্ভের যাত্রার বিশদ বর্ণনা আছে এই গল্পে। ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’এর যাত্রা শুরু হয় পেশোয়ার স্টেশন থেকে, তখন ট্রেনের সমস্ত বগি ভরা ছিল হিন্দু শরণার্থী দিয়ে। তাদের কেউ কোহাট, কেউ চরসদ্দা, কেউ মর্দান, কেউ বা খাইবার, নওশেরা, মানশেরা থেকে এসেছে। সবাই পাড়ি জমাচ্ছে ভারতে, অথচ পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি সমস্তই এই পাকিস্তানে, হাজার হাজার বছর ধরে এই মাটির সাথে জল আর আকাশের সাথে তাদের সখ্য। আজ ধর্মের ও নেতার ভিন্নতার প্রশ্নে পাকিস্তানের উষ্ণ মাটির আশ্রয়কে ত্যাগ করতে হচ্ছে- জানমাল আর মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষার তাগিদে।
এই হিন্দু পাঠানদের মুখের ভাষা কর্কশ পশতু হলেও ভেতরটা ঠিক উলটো, পাহাড়ি জমি আর ঝর্না ছেড়ে আসার সময় এদের ভেতরটা বিদীর্ণ হচ্ছিল যেন। এই বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়েই ট্রেন এসে থামে হাসান আব্দাল স্টেশনে। এবারের যাত্রীরা শিখ, পাঞ্জা সাহেবে এদের বাস, এখন বাস্তুহারা; আর চোখেমুখে তীক্ষ্ণ ভয়ের চিহ্ন। কেউ সমস্ত খুইয়ে ছেঁড়া জুতো আর জানটা হাতে নিয়ে এসেছে, কেউ শুধু ঘুমোবার বালিশটুকু।
এরপর তক্ষশীলা স্টেশনে ছিল আরেক গল্প। আরেকদল হিন্দুর আসার কথা ছিল, কিন্তু তারা এলো লাশ হয়ে; প্রতিহিংসা আর হিন্দু-মুসলিম নগ্ন বিভেদের সাক্ষী হয়ে। দুশো লাশের স্তুপ তুলে দেওয়া হলো ট্রেনে, মৃত আর অর্ধমৃত একসাথে এক বগিতে। আরও একবার মৃত্যুর মিছিল নামল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। অথচ এই তক্ষশীলাই নাকি ছিল ভাস্করের চারণভূমি, সিরকপের রাজপ্রাসাদ, কনিষ্কের সমৃদ্ধ রাজ্য আর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অহিংস বাণীর তীর্থস্থল। আর আজ এখানেই, সেই একই উদ্যানে মৃত্যুর বিভীষিকা রচনা করল ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ মানুষ। ভেজা প্লাটফর্ম যত দ্রুত সম্ভব পাশ কাটিয়ে ফের এগিয়ে চলল এক্সপ্রেস। ট্রেনের জীবিত প্রতিটি যাত্রীই মৃতের চাইতেও অসহায়, কান্নাও তাদের জন্য অভিশাপ।
রাওয়ালপিণ্ডি স্টেশনে চলল কতক হিন্দু নারীর সম্ভ্রম রক্ষার জন্য তাদের হিন্দু ভাইদের বলিদান, কিন্তু শেষতক ভ্রাতা-ভগ্নি সমস্তই মুসলিম সৈন্যের হাতে আত্মদান করতে বাধ্য হলো। লালামুসা স্টেশনে ফেলে দেয়া হলো সেই বয়ে নিয়ে আসা হিন্দু লাশগুলো, সাথে কিছু শরণার্থীকেও। মানুষ যেন এখন আর মানুষ নয়, পঁচে যাওয়া দুর্গন্ধ ছড়ানো আম-আপেল; চাইলেই পিষে ফেলা যায়, ছুরির পোঁচে কেটে ছুঁড়ে ফেলা যায় ট্রেনের বাইরে। ওয়াজিরাবাদ বিখ্যাত ছিল ছুরি রপ্তানিতে, সেখানেই সমস্ত ধ্বংসযজ্ঞের আরেক প্রাণ যেন সঞ্চার করল এই ছোরা। সমস্ত পথ জুড়ে মাটির বদলে মানুষ, ধুলোর বদলে রক্ত। এই জায়গায় সাদত হোসেন মান্টোর ‘আপ্যায়ন’ গল্পের কথা আকস্মিকে মনে পড়ে যায়।
লাহোর, এই স্টেশনে আরও একবার রক্তের বন্যা বইল। চারশো শরণার্থীকে নামিয়ে নিমেষের মাঝেই ছুরির আঘাতে আরেকবার মানবতার গলা কাটা হলো; চারশো মুসলিম ভাইয়ের রক্তের বদলা চারশো হিন্দু ভাইয়ের রক্তে নেয়া হল। অথচ কেউ জানল না, এই দুই ভাইয়ের মা কিন্তু একজনই; যে কারো আঘাতেই মায়ের বুকেই বেঁধে বেশি। অমৃতসর আসতেই দেখা গেল উলটো চিত্র, পাশার দান যেন পাল্টে গেছে। এবার শ’য়ে শ’য়ে মুসলিমদের শবদেহ পথেঘাটে। যারা হিন্দু সেজে পালাতে চাইছিল, তাদের খৎনা পরীক্ষা করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছিল। এমনকি যেসব নিরীহ মুসলমান চাষী পরিবার নিয়ে বনে-জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল, তাদেরও ধরে এনে বর্শায় বিঁধিয়ে হত্যাযজ্ঞে মাতোয়ারা হয়েছিল হিন্দুরা। সেই উৎসব এতটাই নৃশংস ছিল যে, একজন জাট বর্শার ডগায় মুসলিম শিশুর লাশ গেঁথে “দেখো, বৈশাখী জটা এনেছি” গানও বেঁধে বসেছিল।
এর পরই ঘটে আরেক ঘৃণ্য আর নারকীয়তার পাট; জলন্ধরের গ্রামে। পাঠান পুরুষদের হত্যা করে পাঞ্জাবের সুজলা সুফলা মাঠে চলে গ্রামীণ নারীদের মর্যাদাহানির নারকীয় তাণ্ডব। কিন্তু দিনকয়েক আগেই এখানে ছিল প্রাণের মেলা, হিন্দু মুসলিম পাশাপাশি ক্ষেতে বীজ বুনত, ভাগ করে নিত দুপুরের রুটি-লচ্ছি। এখানেই প্রেমের গীত গেয়েছিল হির-রাঞ্ঝা, সনি-মাহিওয়াল আর মির্জা-সাহিবানরা; সেই প্রেমের ক্ষেত্রের কী নিদারুণ অপমান! সেই লাশগুলো বয়ে নিয়ে ফেলা হল সামনের খালে। এরকমভাবে যতই এগোলো ট্রেন, ততই মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত করল হাত হিন্দুরা। এভাবে আম্বালায় এক মুসলিম ডেপুটি কমিশনার ও তার পরিবার হয় শেষ ঘেন্নার বলি। সেই পরিবারের মেয়েটার হাতে সমাজতন্ত্রের বই ছিল, মেয়েটার চোখে দেশ ও জাতিকে বদলে দেবার স্বপ্ন ছিল; অথচ নিমেষে ছুরির এক পোঁচেই সব নিভে গেল!
বোম্বাই, মানে বর্তমানের মুম্বাইয়ে এসে যাত্রা শেষ হল আমাদের ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’র। রক্তের দাগ ধুয়ে মুছে আলাদা করে রাখা হয় ট্রেনটিকে। এই ট্রেন সাক্ষী থাকল হাজার হাজার খুনের, রক্তস্নানের আর মানবতার পরাজয়ের। কিন্তু এ তো হবার কথা ছিল না, কিছু নেতার অঙ্গুলিহেলনে সমৃদ্ধভূমি আরও সমৃদ্ধতর হওয়ার কথা ছিল, সবুজ ক্ষেতে আরও বীজ বোনার আরও আশার সঞ্চারের কথা ছিল। প্রতিটি গ্রামে গ্রামে পরিবারগুলো আরও সুখে আরও নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকার কথা ছিল, কথা ছিল নতুন পাওয়া স্বাধীনতার স্বাদ বুক ভরে নেওয়ার। অথচ তার বদলে মৃত্যু আর মৃত্যু, রক্তের বদলে রক্তের তাণ্ডবই পেয়েছে এই উপমহাদেশের ভূমি; ভাইয়ের হাতেই ভাই খুন হয়েছে, ভাইয়ের লাশ বর্শায় বিঁধিয়ে রক্ত পান করেছে আরেক ভাই।
দেশবিভাগের করুণ গল্প আমাদের সবারই কমবেশি জানা, কিন্তু এর ভয়াবহতা আর ক্ষতির পরিমাণটা আন্দাজ করতে গেলে এই ছোটগল্প এবং সমসাময়িক লেখকদের উপন্যাস, গান, প্রবন্ধ ইত্যাদি পড়াও খুব প্রয়োজন। দেশবিভাগের ক্ষত, ক্ষতি সবই হয়তো এতদিনে বুজে এসেছে, কিন্তু সেই সময়ের এই অহেতুক জীবনহানি, এত অনাচার, এত জানমালের ক্ষয়ের আসলেই কোনো প্রয়োজন ছিল না। অথচ যুগে যুগে এই-ই নিয়ম হয়ে এসেছে যেন। নগরপিতা, নেতা এবং নেত্রীদের ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত শুধু সাধারণ জনগণই দিয়ে এসেছে। খুব সহজেই বিভেদের আগুন জ্বালিয়ে ভাগ করে দেয়া হয়েছে একই মাটির সন্তানদের। মনে রাখতে হবে, হানাহানি করলে আখেরে মানবতারই মৃত্যু হয়, প্রকৃতির সন্তানকে প্রকৃতি থেকে বঞ্চিত করার মতো অন্যায় আর হয় না।
দাঙ্গার বদলে আসুক সখ্য, ক্ষয়ের বদলে আসুক প্রাচুর্য। ঘৃণা বা হানাহানি নয়, নবদিগন্তের হাত ধরে আসুক শান্তি ও সাম্য।
বইয়ের নাম: পেশোয়ার এক্সপ্রেস- দাঙ্গার গল্প || লেখক: কৃষণ চন্দর
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম