১৯৭১ সালে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের আগের অনেকগুলো বছর পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশ ছিল উত্তাল, জনগণ বিভিন্ন আন্দোলনে সরবে দাবী জানিয়ে এসেছে, আদায় করেছে বারংবার। ঝরেছে রক্ত, জেলে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে সাহসী সন্তানদের। কিন্তু এসবই ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক পর্যায়ের চিত্র।
আমাদের মনে রাখতে হবে- সমাজ নামের দালান গঠিত হয় পরিবার নামক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইটের দ্বারা। সেসব পরিবারের প্রতিটির আড়ালেই লুকিয়ে আছে অসংখ্য কাহিনী- কখনো তা প্রিয়জন হারাবার বেদনা, যুদ্ধের যাঁতাকলে পিষ্ট আবেগ-অনুভূতিগুলোর বেঁচে থাকার জন্য অদম্য বিপ্লবগাথা, অথবা নেহাতই পেটপূজোর মতো তুচ্ছতম দৈনিক ঘটনা।
ঢাকা কিংবা দূরগ্রামের বুকে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা সেসব খণ্ড খণ্ড গল্পের ছবিই সাজিদ রহমানের ‘জলরঙ’-এর ক্যানভাসে নানা ছোপে ফুটে উঠেছে।
গল্পের টাইমলাইন বাংলাদেশের জন্মের পূর্বের ও পরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অবস্থিত। কাহিনীর প্রয়োজনে কখনো তা চলে গিয়েছে ছয় দফা আন্দোলনে, ঊনসত্তরের পটভূমিতে, ‘৭১-এর রক্তক্ষয়ী দিনগুলোতে কিংবা এরশাদের একনায়কতন্ত্রের আমলে।
‘জলরঙ’ উপন্যাসের অন্যতম চমকদার ব্যাপার হচ্ছে এর ইতিহাসভিত্তিক বর্ণনা। ফিকশন বইয়ের ভেতর সত্য ঘটনা ও চরিত্রকে অবিকৃত রেখে তুলে আনা কষ্টদায়ক কাজ। বিশেষ করে যখন তা প্রাক-মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী সময়ের মতো সংবেদনশীল বিষয়কে ঘিরে লেখা। লেখক প্রয়োজনে ফুটনোট ব্যবহার করেছেন বাস্তব ঘটনা বা চরিত্রকে চিনিয়ে দেবার প্রয়াসে। তবে তা গল্প উপভোগে বাধা দেয়নি একবারও। ফিকশন ও ফ্যাক্ট চলেছে সাবলীলভাবে, সমান্তরালে।
গল্পের চরিত্র ও স্থান
গল্প নিয়ে কিছু বলা যায় এবার। বইটি মূলত কয়েকটি পরিবার ও তাদের যুদ্ধের পূর্বে, যুদ্ধকালীন ও পরবর্তী সময়ের জীবনকে নিয়ে রচিত হয়েছে। আটপৌরে কিছু মানুষও যে নিঃশব্দে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনের পথে, সেই কাহিনী হয়তো পত্র-পত্রিকার হেডলাইন হয়ে আসে না কখনো। সেসব মানুষ কখনো হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশ্রয়দাতা, কখনো বাধ্য হয়েছেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও আলবদর কমিটির খাতায় নাম লেখাতে, আবার কখনো নিঃশঙ্ক চিত্তে এগিয়ে গিয়েছেন প্রাণ উৎসর্গের জন্য। বন্দুক হাতে না তুলেও মাতৃভূমির পক্ষে লড়াইয়ে কাজ করেছেন তারা। তবে প্রতিটি মুদ্রারই দু-পিঠ আছে। দেশমাতার সাহসী সন্তানেরা যেমন ছিল, তেমনি ছিল বাঙালি জাতির লজ্জা রাজাকারের দল। তাদের দুশ্চরিত্রের সার্থক প্রতিচ্ছবিও ফুটে উঠেছে কলমের আঁচড়ে। আর বীরযোদ্ধারা?
তাদের ছাড়া গল্প হয় নাকি?
তবে দিনশেষে সবার একটি পরিচয়ই মুখ্য হয়ে ওঠে- রক্তমাংসে গড়া খুব সাধারণ কয়েকজন মানুষ। যাদের মনে প্রেম আছে, মান-অভিমান আছে, জেদ আর আতঙ্ক আছে, আছে চিরচেনা ঘর আর পিতৃপ্রদত্ত প্রাণ হারাবার ভয়।
গল্পের বড় একটি অংশ চিত্রিত হয়েছে পুরান ঢাকার অলিগলিতে; ভোজনরসিক পাঠকসমাজও সম্ভবত খুশি হবেন বেশ কিছু মুখরোচক খাবারের বর্ণনা পড়ে, বিশেষত ঝুনুর পোলাওয়ের কথা না বললেই নয়। ঢাকাভিত্তিক কাহিনী হয়েই আটকে থাকেনি গল্পটি, প্রয়োজনে তা ছুটে গেছে গ্রামে-গঞ্জে, বন্দরে। যে মধ্যবিন্দুকে কেন্দ্র করে বৃত্ত এঁকেছেন লেখক, সেই মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু বাস্তব ঘটনাপুঞ্জি উঠে এসেছে কাহিনীর মোড়ে মোড়ে। বিখ্যাত কয়েকটি যুদ্ধ আর দুঃসাহসিক অভিযানের বর্ণনা পড়ার সুযোগ পাবে পাঠক।
গল্পের পেছনের গল্প
লেখক সাজিদ রহমানের এটি প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। সাবলীল বর্ণনাভঙ্গি ও টুকরো টুকরো সুতো জোড়া দিয়ে গল্প বোনার ক্ষমতা দেখে বেশ অবাক হতে হয়। বইয়ের শেষে নির্ঘণ্টে রেফারেন্সের বহর দেখে যে কেউ বিস্মিতবোধ করবেন। লেখকের ভাষ্যমতে- এটি একাধারে কাল্পনিক উপন্যাস, মেমোয়ার ও ঐতিহাসিক দলিলও বটে। কারণ আনোয়ার, সুফিয়া, মহিউদ্দিন মীরধা, শফিক, নাসিমা, নূর মোহাম্মদ- চরিত্রগুলোকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন তিনি। কখনো স্বচক্ষে, কখনো কল্পনায়।
মুক্তিযুদ্ধ-আশ্রিত উপন্যাস হয়েও হয়নি ‘জলরঙ’, কারণ এতে মিশে আছে আরও কিছু সময়ের গল্প। যা প্রভাব রেখে গেছে বাংলাদেশের ইতিহাসে, রাজনৈতিক পটভূমি গড়ে ওঠার পেছনে। সেজন্যই বহুরূপী তকমা গায়ে সেঁটে সার্থক উপন্যাসের শ্রেণী সহজেই উৎরে যেতে পারে তা।
খুঁটিনাটি
ডায়েরি বাইন্ডিং-এর বইটির প্রোডাকশন কোয়ালিটি চমৎকার। শক্তপোক্ত বাঁধাই, ২২০ গ্রাম জ্যাকেট আর ক্রিম পেপার বইটিকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদের জন্য সাধুবাদ প্রাপ্য আরিফুল হাসানের।
উন্নতির জায়গা
উন্নতির জায়গা বলতে, কিছুটা ছাড় দেয়া যায় ‘প্রথম লেখা’ হিসেবে। রাজনৈতিক তথ্য পড়বার সময় মনে হচ্ছিল সরাসরি পত্রিকার কাটিং পড়ছি। তথ্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আরেকটু মুনশিয়ানার ছাপ আশা করি ভবিষ্যতে দেখা যাবে। এছাড়া কিছু কিছু বাক্যে প্রাঞ্জলতার অনুপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। ঘটনা বর্ণনা করার সময় থার্ড পার্সন ন্যারেটিভ থেকে আচমকা ফার্স্ট পার্সনে রূপ নিয়েছে। নামের বিভ্রাটও পড়ায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটিয়েছে, যেমন- মেজর রহমান একাধিকবার মেজর বিপ্লব হয়ে গিয়েছেন, কর্নেল আজিম হয়েছেন আসিম। বইয়ে লাইন স্পেসিং দু’রকমের দেখা গিয়েছে, যা কিছুটা দৃষ্টিকটু। ব্যাকরণ ও প্রুফরিডিং সংক্রান্ত বেশ কিছু ভুলভ্রান্তি চোখে পড়েছে। সবগুলো ত্রুটিই পরবর্তী মুদ্রণে শুধরে নেয়া সম্ভব।
কাহিনী সংক্ষেপ
জলরঙে আঁকা ছবি নাকি প্রধানত দু’ধরনের। স্বচ্ছ আর অস্বচ্ছ। আমি বলি, না। ছবি কখনও অস্বচ্ছ হতে পারে না। বাঁকগুলো হয়তো অস্বচ্ছ মাধ্যমের সাহায্যে মূলবিন্দুতে পৌঁছোয়। তবে উদ্দেশ্য একটাই- যারা ছবি দেখছে, তাদের জন্য একটি স্বচ্ছ, স্পষ্ট অর্থ তৈরি করা।
এই বইকে পাঠকেরা কীভাবে নেবেন? কিছু চরিত্রের সম্মিলন ঘটিয়েছি। জীবনের বাঁকে বাঁকে তাদের দৃশ্যপট আঁকার চেষ্টা করেছি। কারও জীবন হয়েছে জলের মতোই টলটলে, স্বচ্ছ। কারও জীবন অশান্ত আবহাওয়ায় সমুদ্রের জলের মতো উত্তাল, প্রলয়ঙ্করী। সময়কাল? উপন্যাসটিকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বললে ভুল করবেন। মুক্তিযুদ্ধনির্ভর উপন্যাস এটি নয়। তবে আমাদের মহান যুদ্ধে কিছু মানুষের জীবন আর দিনযাপন কেমন ছিল, তার একটি ছবি আঁকার চেষ্টা করেছি আমার ঠাসবুনোনি লেখার ক্যানভাসে। এদের মাঝে কেউ কেউ আমার জীবনের সাথে জড়িত, কাউকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। জলরঙকে কেউ যদি মেমোয়ার হিসেবেও দাবি করেন, তাতে আপত্তি করব না। যুদ্ধের খণ্ড খণ্ড ছবি আছে, প্রেম-ভালোবাসা আছে, বিচ্ছেদ আছে, মিলন আছে, বিষাদমাখা আখ্যান আর আছে মন ভালো করে দেবার মতো কিছু মুহূর্ত। ক্যানভাসে জলরঙে আঁকা ছবি শেষ করলাম। ছবিটা কেমন হলো, তা বিচার করার দায়িত্ব পাঠকের ওপর ন্যস্ত করে দিলাম…
লেখক পরিচিতি
জন্মস্থান পুরাতন ঢাকার নারিন্দায়, মাতুলালয়ে। এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। আদী প্রকাশন, পরিবার, ব্যবসা আর নানা ঝক্কির মাঝেও নিজের লেখকসত্ত্বাকে কখনও তিনি বিলীন হতে দেননি। সময় পেলেই বসে গিয়েছেন কী-বোর্ডের সামনে। অনুবাদ করেছেন, লিখেছেন ছোটগল্প। ‘ব্ল্যাক’ নামের একটি সমকালীন মৌলিক গল্প সংকলন এসেছে তার হাত ধরে। অবসরে দেশে-বিদেশে ঘুরতেও বেশ পছন্দ করেন। নিজের ঔপন্যাসিক সত্ত্বাকে এবারের বইমেলায় তিনি পাঠকদের সামনে এনেছেন।
বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে
বই: জলরঙ
লেখক: সাজিদ রহমান
প্রকাশনী: আদী প্রকাশন
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৩০৪
মুদ্রিত মূল্য: ৪৬০টাকা