২০২০ সাল, অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের ৯২ তম আসর। ঐ বছর সবাইকে তাক লাগিয়ে প্রথম বিদেশী ভাষার কোনো চলচ্চিত্র জিতে নেয় সেরা চলচ্চিত্রের পুরষ্কার। ‘ফোর্ড ভার্সাস ফেরারি’, ‘১৯১৭’, ‘জোকার’, ‘ম্যারেজ স্টোরি’, ‘আইরিশম্যান’, ‘জোজো র্যাবিট’-এর মতো বাঘা বাঘা ফিল্মকে পেছনে ফেলে বাজি জেতে কোরিয়ান ফিল্ম ‘প্যারাসাইট’। চারদিক তখন মুখরিত ‘প্যারাসাইট’ বন্দনায়। এর এক বছর পর আবারও কোরিয়ান ইন্ডাস্ট্রির বাজিমাত। তুরুপের তাস ‘স্কুইড গেম’ দিয়ে ওটিটি প্লাটফর্মেও নিজেকে আধিপত্য ভালো করেই প্রমাণ করে দিল দক্ষিণ কোরিয়া। পুরো বিশ্বের মুভি-সিরিজ প্রেমীরা এখন ‘স্কুইড গেম’ জ্বরে পুড়ছে। বন্ধুদের চায়ের টেবিল থেকে সিনেমাহলের গলি- সবখানেই স্কুইড গেমের জয়জয়কার। মুক্তির মাত্র এক মাসের মাথায় সিরিজটি নেটফ্লিক্সের অতীত রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জন করে নেওয়া সেই স্কুইড গেম সিরিজের অজানা সকল তথ্য নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
গল্প নির্মাণ
স্কুইড গেম সিরিজের নির্মাতা হোয়াং ডং ২০০৮ সালে এর গল্প নির্মাণে হাত দেন। তার মাথায় স্কুইড গেম সিরিজের ধারণা আসে ২০০৮ সালের আগেই। তখন তিনি কোরিয়ার এক মাঙ্গা ক্যাফেতে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। Battle Royale, LIAR Game, এবং Gambling Apocalypse: Kaiji মাঙ্গা এক্ষেত্রে তাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। ২০০৯ সালের মধ্যেই এর প্রাথমিক খসড়া দাঁড় করিয়ে ফেলেন তিনি। শুরু থেকেই কোরিয়ার বিভিন্ন প্রোডাকশন হাউজের কাছে স্ক্রিপ্ট নিয়ে গেলেও ‘অদ্ভুত’ ও ‘বাস্তব’ অজুহাতে বারবার তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। হোয়াং ডং রেডিও টাইমসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ২০০৯ সালের দিকে সম্পূর্ণ অপরিচিত ও খুনোখুনি ধাঁচের এই কাহিনীর সাথে দর্শক খাপ খাইয়ে নিতে পারবে কিনা, তা নিয়ে তিনি বিশেষ চিন্তিত ছিলেন। ফলে, এই সিরিজ কতটুকু সফলতার মুখ দেখবে, সেটা নিয়েও কপালে খানিকটা ভাঁজ পড়ে তার।
পরবর্তীতে দ্য কোরিয়া টাইমসকে তিনি জানান,
“১২ বছর পর, ২০২১ সালে পৃথিবীর দৃশ্যপট অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন এরকম অদ্ভুত ও ভায়োলেন্ট সারভাইভাল স্টোরিকে আর দশটা সাধারণ জনরার মতোই গণ্য করা হয়। তাই আমি এর ভায়োলেন্স নিয়ে আর কোনো দুশ্চিন্তা করিনি।”
তিনি আরও বলেন,
“আমি এমন একটা গল্প সাজাতে চাইছিলাম, যা আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের চালচিত্র রূপক অর্থে ফুটিয়ে তুলবে। যা বর্ণনা করবে জীবনের চরম প্রতিযোগিতার ধারাকে। সেখানে আমি এমন সব চরিত্রকে দেখাতে চেয়েছিলাম, যাদের আমরা বাস্তবে হরহামেশাই দেখি।”
নেটফ্লিক্সে ডেভেলপমেন্ট
নেটফ্লিক্স তখন সারাবিশ্বের ওটিটি প্লাটফর্মে রাজত্ব দখল করে ফেলেছে। এর কন্টেন্টে বৈচিত্র্য দেখে হোয়াং নেটফ্লিক্সের দ্বারস্থ হন। ২০১৯ সালে এসে নেটফ্লিক্স এই গল্প নিয়ে সিরিজ নির্মাণে আগ্রহ দেখায়। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে তারা এই ব্যাপারে অফিসিয়াল ঘোষণা দেয়। স্কুইড গেমের মাধ্যমেই বড় ও আন্তর্জাতিক কোনো প্রোডাকশন হাউজের সাথে পথচলা শুরু হোয়াং ডং হেয়ুকের। মোট ছয়টি গেমের কারণে শুরুর দিকে সিরিজটির নাম ‘রাউন্ড সিক্স’ রাখা হলেও, পরবর্তীতে কোরিয়ার জনপ্রিয় খেলা ‘স্কুইড গেম’ এর নামানুসারে তা পরিবর্তন করা হয়।
মুভির বদলে সিরিজ
ভ্যারাইটিকে দেয়া এক ইন্টার্ভিউতে হোয়াং ডং জানান, এই প্রজেক্ট প্রথমে ফিচার ফিল্ম হিসেবে তৈরি করা হয়। হোয়াংয়ের নির্মাণ তালিকার দিকে তাকালে সেটা নিয়ে অবাক হবার কিছু নেই। সাইলেন্স (২০১১), দ্য ফোর্ট্রেস (২০১৭) এর মতো হিট কোরিয়ান মুভির লেখক ও নির্মাতা তিনি। এছাড়াও, কোরিয়ান ফিল্মের ইতিহাসে অন্যতম সেরা মিউজিক্যাল কমেডি জনরার কোরিয়ান মুভি ‘মিস গ্র্যানি’ও তার হাত ধরেই এসেছে। তিনি ঐ সিনেমার পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার। Still Watching Netflix নামক এক ইউটিউব ভিডিওতে তিনি বলেছেন, আসল মুভিতে গোয়েন্দা পুলিশ জুন-হো নামক কোনো চরিত্রই ছিল না। মুভি থেকে সিরিজ রূপান্তরের সময়ই এই চরিত্রের জন্ম দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, জি-ইয়ং নামে যে মেয়েটি স্যে-বেয়ককে বাঁচাতে নিজের প্রাণ দেয়, প্রথমদিকে সেটা ছিল মূলত এক পুরুষ চরিত্র। কারণ, হোয়াংয়ের কাছে মনে হয়েছিল, পুরুষের বদলে নারী চরিত্র ওই ঘটনার সাথে খাপ খাবে বেশি।
জায়ান্ট ক্রিপি ডল
স্কুইড গেম সিরিজের যেসব দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভাইরাল হয়েছে, সেসবের মধ্যে প্রথম এপিসোডে দেখানো বিশালাকৃতির সেই পুতুল অন্যতম। পুতুলটি মূলত সিরিজ নির্মাণের উদ্দেশ্যে ধার করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল থেকে তিন ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত জিনশন কাউন্টিতে এর দেখা মিলবে।
ফোনকলের বিড়ম্বনা
‘স্কুইড গেম’ না দেখেও সিরিজটির জনপ্রিয়তার মাত্রা অল্প হলেও আঁচ করতে পেরেছেন এক দক্ষিণ কোরীয় নারী। কারণ, কার্ডের পেছনে ছেপে দেওয়া নাম্বার তার ফোন নাম্বারের সাথে মিলে গেছে। মহিলার দাবি, একদিনে প্রায় চার হাজারের মতো কল এসেছিল ওই ফোনে। তিনি প্রথমে বুঝতে পারেননি হঠাৎ করে তার মোবাইলে এত কলের হিড়িক পড়ল কেন? সবাই তাকে স্কুইড গেমে যোগ দেওয়ার কথা বলছে কেন? পরবর্তীতে তার এক বন্ধু জানায়, তার নাম্বার ‘স্কুইড গেম’-এ ব্যবহার করা হয়েছে। অতিরিক্ত ফোন কলের দরুন পাগলপ্রায় মহিলা শেষমেশ ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে নেটফ্লিক্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ ঠুকে দেন। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হুহ কিয়ং-ইয়ং ঐ নাম্বার কেনার জন্য সিম কোম্পানিকে ৮৫,০০০ ডলারের প্রস্তাব দেন। প্রোডাকশন কোম্পানি নেটফ্লিক্স জানিয়েছে, তারা এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। সিরিজ থেকে শীঘ্রই ওই নাম্বারের দৃশ্যও ছাটাই করে দেবে তারা।
পরিসংখ্যান
২০২১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মুক্তির পরপরই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে স্কুইড গেম। ১২ অক্টোবর রাতে নেটফ্লিক্স এক টুইট বার্তায় জানায়, তাদের পূর্বের সব রেকর্ড তছনছ করে দিয়েছে সিরিজটি। মাত্র ১০ দিনের মাথায় ৯০টি দেশে সিরিজ র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে উঠে আসে ‘স্কুইড গেম’, যার মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া, এবং হংকং অন্যতম। ১৯ সেপ্টেম্বর যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে সিরিজ র্যাঙ্কিংয়ে সিরিজটির অবস্থান ছিল ৮ নাম্বারে, এরপরের দিন তা একলাফে উঠে আসে দ্বিতীয় স্থানে। ২১ সেপ্টেম্বর তা সিরিজ র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষস্থান দখল করে ফেলে, যা এর আগে কোনো কোরীয় সিরিজ করতে পারেনি।
১২ অক্টোবর পর্যন্ত সারাবিশ্বে প্রায় ১১ কোটি ১০ লাখ দর্শক দেখেছিল সিরিজটি। এর আগে সবচেয়ে বেশি ভিউজের রেকর্ড ছিল ব্রিটিশ রোমান্স সিরিজ ‘ব্রিজারটন’-এর দখলে। প্রচার হওয়ার ২৮ দিনের মধ্যে মোট ৮ কোটি ২০ লাখ মানুষ দেখেছিল এটি। সিরিজের বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে নেটফ্লিক্স মোট ১৩টি ভিন্ন ভাষায় ডাবিংয়ের পাশাপাশি ৩১টি ভাষার সাবটাইটেল সাথে দিয়ে দেয়। সিরিজের প্রথম সিজনে খরচ হয়েছে ২১.৪ মিলিয়ন ডলার, যা নেটফ্লিক্সের দ্য ক্লোজার, ডেভ শ্যাপেল থেকেও কম। হিসেব করলে প্রতি এপিসোডে গড়ে ২.৪ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু লাভের ঘড়া পূর্ণ হয়ে উপচে গেছে বহুগুণ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রায় ৮৯০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয়ের মাধ্যমে স্কুইড গেম নেটফ্লিক্সের ক্যারিয়ারে অন্যতম সুপার-ডুপার ব্লকবাস্টার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্বিতীয় সিজন
সিরিজটির দ্বিতীয় সিজন আসবে কিনা তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। তবে এই ব্যাপারে মুখ খুলেছেন পরিচালক হোয়াং। তার ভাষায়,
“স্কুইড গেমের দ্বিতীয় সিজন নিয়ে বর্তমানে আমার সেভাবে কোনো পরিকল্পনা নেই। কিন্তু যদি দ্বিতীয় কিস্তি পর্দায় আনতে হয়, তবে আমি তা একা আনব না। সেজন্য আমি দ্বারস্থ হবো অভিজ্ঞ পরিচালক ও গল্পলেখকদের, যারা সাগর সেঁচে মুক্তো বের করে আনতে ওস্তাদ। কারণ প্রথম সিজনের গল্প লিখতে আমাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দুই এপিসোডের গল্প লিখতে সময় লেগেছে ছ’মাসের কাছাকাছি।”
অভিনয়ে অভিষেক
দক্ষিণ কোরিয়ার পকেটমার হোইয়ন জাং চরিত্র দিয়েই অভিনয় জগতে স্থলাভিষিক্ত হন স্যে-বেয়ক। এর আগে তিনি ‘Korea’s Next Top Model’ এর চতুর্থ সিজনে মডেলিংয়ের পাশাপাশি, Vogue ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে জায়গা করে নিয়েছিলেন। স্কুইড গেম দিয়ে অভিনয়ে হাতেখড়ির পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন তার ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যা ১৫ মিলিয়নের ঘর ছুঁয়েছে। সকল কোরীয় অভিনেত্রীকে পিছনে ফেলে জাং হো ইয়ন ইন্সটাগ্রামে এখন সর্বোচ্চ ফলোয়ারের মালিক। রাতারাতি মডেল থেকে জনপ্রিয় অভিনেতা হবার গল্পের মূল নির্ণায়ক অবশ্যই স্কুইড গেম। পরিচালক হোয়াং জাং এর অডিশন টেপ দেখে বলেছিলেন,
“যেন ঈশ্বর আমাকে এক মহামূল্যবান উপহার পাঠিয়েছেন। আমি স্যে-বেয়ক চরিত্রের জন্য যেমন অভিনেতা খুঁজছিলাম, হো-ইয়ন যেন তার সুস্পষ্ট প্রতিরূপ।”
বিহাইন্ড দ্য মাস্ক
হোয়াং সিরিজের মুখোশ পরিহিত প্রহরীদের এমন লুক দিতে চেয়েছিলেন, যাতে তাদের দেখে ‘বয় স্কাউট’ লাগার পাশাপাশি সুঠাম দেহের পুরুষও মনে হয়। একটি বসতিতে পিঁপড়ারা সংঘবদ্ধভাবে বসবাসের মাধ্যমে শৃঙ্খলা মেনে যার যার কাজ করে থাকে, প্রহরীদের মাধ্যমে সেই জিনিসই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। আর মুখোশের অবয়ব কোরিয়ার ঐতিহ্যবাহী হাওয়েটাল মাস্ক থেকে অনুপ্রাণিত। এ ব্যাপারে টিমের কস্টিউম ডিজাইনার বলেন,
“মুখোশগুলোর উপরে এমনভাবে তিনটি চিহ্ন (বৃত্ত, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ) আঁকা হয়েছে, যেন তা পিঁপড়ার মুখের অগ্রভাগ ফুটিয়ে তোলে। আর এটাই ছিল আমাদের ফাইনাল ডিজাইন।”
হোয়াং বলেন,
“উপর থেকে গেমের কলকাঠি নাড়া ধনকুবের রাঘব-বোয়ালদের মুখোশ দিয়ে তাদের ক্ষমতা বোঝান হয়েছে।
একেকটি হিংস্র পশুর মুখোশ দিয়ে সেখানে উপস্থিত ধনবানদের মনের পশুকে ব্যক্ত করা হয়েছে।”
কোরিয়ান গেম
সিরিজে যেসকল গেম দেখানো হয়েছে, তার সবগুলোই কোরিয়ার জনপ্রিয় কিছু গেমের আদলে তৈরি। এর বেশিরভাগ হোয়াং আবার বাল্যকালে খেলেছেন। সিরিজে জি-হানকে যে পদ্ধতিতে হানিকম্ব ক্যান্ডি চাটতে দেখা গেছে, সেই পদ্ধতি হোয়াং মূলত তার বাল্যকালে ব্যবহার করতেন।
তিনি বলেন,
“এভাবে চাটার মাধ্যমে হানিকম্ব ক্যান্ডির নির্দিষ্ট আকৃতি বের করে আমি এক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী পর্যন্ত হয়েছিলাম। প্রতিযোগীদের কাছে যদিও এটা অস্বস্তিকর, তবুও এই পদ্ধতি আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই পদ্ধতি ক্যামেরায় কতটুকু কার্যকর হবে, কতটুকু ফুটিয়ে তুলতে পারব, তা নিয়ে খানিক সন্দেহ ছিল। সেজন্য হানিকম্ব ক্যান্ডি দৃশ্য-ধারণের আগের রাতে একটু দুশ্চিন্তায় ছিলাম।”
স্কুইড গেম খেলাটি সত্তর ও আশি দশকে কোরিয়ায় মারাত্মক জনপ্রিয় ছিল। কোরিয়ান ভাষায় এর আসল নাম Ojingeo। তবে গেমটির কিছু ভ্যারিয়েশনের মধ্যে ‘স্কুইড গাইসন’, ‘স্কুইড টাক্কারি’ অন্যতম। গেমটিতে মূলত তিনটি জ্যামিতিক চিহ্ন, যথাক্রমে বৃত্ত, ত্রিভুজ, ও চতুর্ভুজ বিদ্যমান। এগুলো পুরো সিরিজেই প্রহরীদের ক্রম নির্দেশ করেছে। তিনি কোরিয়ার আরও কিছু শিশুতোষ গেম এই সিরিজের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন; যেমন- ‘গংগি’, ‘ডং’, ‘ডংডেমুন’, ‘হানা ইচি মোনমে’ ইত্যাদি। কিন্তু সেসকল গেম সিরিজে খাপ না খাওয়ায় পরবর্তীতে সেগুলোকে বাদ দিতে হয়।
গং ইয়োর ক্যামিও
সিরিজের অন্যতম আকর্ষণ ছিল কোরিয়ান অভিনেতা গং ইয়ো। জনপ্রিয় কোরিয়ান জোম্বি মুভি ‘ট্রেন টু বুসান’ এর কল্যাণে কোরিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বেই আজ তিনি সমাদৃত। ঋণের দায়ে ফেঁসে যাওয়া মানুষকে লাল-নীল কার্ডের বাজির মাধ্যমে তিনি রাস্তা থেকে তুলে মরণখেলায় অংশগ্রহণ করিয়েছেন। তবে, পরে তাকে আর দেখা যায়নি। এর আগে তিনি পরিচালক হোয়াং এর সাথে ‘সাইলেন্স‘ মুভিতে কাজ করেছিলেন। তাই স্কুইড গেম সিরিজে পরিচালক তাকে ছোট্ট একটি ক্যামিও দেওয়ার অনুরোধ করলে মানা করেননি তিনি।
সেট ডিজাইন
সিরিজের শুটিং সেট হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার ড্যাইজন শহরকে বেছে নেয়া হয়েছে। সেখানকার অনেক সাউন্ড স্টেজ এবং স্টুডিও ব্যবহার করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং ছিল মার্বেল গেমের সেট তৈরি করা, যা বানাতে গিয়ে প্রোডাকশন দলের অনেক সময় ব্যয় হয়। খেলোয়াড়দের শোবার ঘর তৈরির ধারণা পরিচালক নিয়েছেন পিঁপড়ার বাসা থেকে। আর রঙচঙে গোলকধাঁধা সদৃশ সিঁড়িগুলোর নকশা তিনি করেছেন ডাচ শিল্পী এম. সি. এশ্চারের রিলেটিভিটি (১৯৫৪) স্কেচ থেকে। সকল খেলোয়াড়ের শোবার ঘরেই মূলত কী কী গেম খেলতে হবে, এর ইঙ্গিত দেওয়া ছিল। প্রথমদিকে খেলোয়াড়দের বিছানাসংখ্যা বেশি হওয়ায়, সেগুলো কারও চোখে পড়েনি।
পরবর্তীতে রাতে বিশৃঙ্খলা শুরু হবার পাশাপাশি, খেলোয়াড়ের সংখ্যা কমে যাওয়ায় তা আস্তে আস্তে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সিরিজের কাহিনী অনুযায়ী গেমে মোট ৪৫৬ জন খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বৃদ্ধ লোকের শার্ট নাম্বার ছিল ০০১, এবং সিরিজের মূল চরিত্র ‘সিউং গি-হুন’ শার্ট নাম্বার ছিল ৪৫৬। মজার ব্যাপার হলো, শুটিং সেটে সত্যি সত্যি মোট ৪৫৬ জন মানুষ উপস্থিত ছিল। প্রতি গেমে যতজন মানুষ মরেছে, শুটিং সেট থেকে ঠিক ততজন করেই মানুষ কমেছে।
আলী আব্দুল
স্কুইড গেম সিরিজের চরিত্রগুলোর মধ্যে যে ক’টা চরিত্র মন কেড়ে নিয়েছে, তাদের মধ্যে পাকিস্তানি অভিবাসী ‘আলী আব্দুল’ অন্যতম। অত্যন্ত সহজ-সরল ও পরোপকারী গোছের এই মানুষটি অনেকেরই প্রিয় চরিত্র। আলী আব্দুল চরিত্রের কুশীলব অনুপম ত্রিপাঠী মূলত একজন ভারতীয়। ২০১০ সালে ‘কোরিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব আর্টস’-এ পড়ার জন্য তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় পাড়ি জমান। তবে, কোরিয়ান ইন্ডাস্ট্রিতে এটাই তার প্রথম কাজ নয়। ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জনপ্রিয় কোরিয়ান মুভি ‘Ode to My Father’-এ তিনি এক শ্রীলঙ্কান চরিত্রে ক্যামিও দেন। স্কুইড গেমের চরিত্রগুলোর মধ্যে গুগল সার্চে তিনি শীর্ষে আছেন।
‘স্কুইড গেম’ সিরিজ জগতে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। ইংরেজি ভাষার সিরিজ না হয়েও কাঁপিয়ে দিয়েছে পৃথিবী। কোয়ালিটি বজায় থাকলে বিশ্বজয়ের ক্ষেত্রে ভাষা তেমন বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। স্কুইড গেম, ডার্ক, লা কাসা দে পাপেল ইংরেজি ভাষার সিরিজ না হয়েও সারাবিশ্বে যেভাবে দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেছে, তা সিরিজ জগতে অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।