৯০-এর দশকের সময়টা হয়তো এতটা রঙিন হতো না, যদি মীনা আর মিঠুর জুটি না থাকত। দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শিশুদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে জীবন চলার শিক্ষা দেওয়া সেই সময় থেকে আজ অবধি চলছে এই মীনা কার্টুনের মাধ্যমে। শুধু শিশুদের ক্ষেত্রেই নয়, বড়দের অনেকের জীবনেই ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছিলো এবং এখনও আনছে নয় বছরের ছোট্ট মীনা এবং তার প্রাণপ্রিয় বুদ্ধিমান বন্ধু মিঠু। কার্টুনে পাখি হলেও তার চিন্তাশক্তি অনেকের চেয়েই উন্নত ও মার্জিত। জীবনমুখী শিক্ষা প্রদানকারী এই দুই বন্ধুর কৃতিত্ব কখনোই ভোলার মতো নয়। একইসাথে এদের জনক, যার জন্য হাজারো মেয়ে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে, সকলে ছেলে-মেয়ে উভয়কে সমান গুরুত্ব দিতে শিখেছে- সেই রাম মোহনকেও কখনো ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। তিনি হলেন আমাদের সকলের প্রিয় মীনা কার্টুনের স্রষ্টা ও পরিচালক।
জাতিতে তিনি একজন ভারতীয়। আর ভারতের অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় তিনি ‘ফাদার অব ইন্ডিয়ান অ্যানিমেশন’-এর উপাধিও লাভ করেন। ১১ অক্টোবর, ২০১৯ সালে মুম্বাইয়ে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছেন রাম মোহন। এ সময় তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। ভারতের অ্যানিমেশন বিষয়ক ওয়েবসাইট অ্যানিমেশন এক্সপ্রেসে তার মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করা হয়।
১৯৩১ সালে ভারতের মাদ্রাজে জন্মগ্রহণ করেন এই বিখ্যাত কার্টুনিস্ট রাম মোহন। পড়াশোনাও করেছেন মাদ্রাজে। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেই ফিল্ম এবং অ্যানিমেশনের জগতে যাত্রা শুরু করেন তিনি।
অ্যানিমেশনের জগতে রাম মোহন
রাম মোহনের পেশাগত জীবনের শুরু হয় ১৯৫৬ সালে। গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়াস কার্টুন ফিল্মস ইউনিটের ফিল্ম ডিভিশনে চাকরি নেওয়ার মাধ্যমে তার এই যাত্রার আরম্ভ ঘটে। তবে ১৯৬৮ সালের নাগাদ তিনি ফিল্ম ডিভিশন ছেড়ে দিয়ে প্রাসাদ প্রোডাকশনের অ্যানিমেশন ডিভিশনের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন৷ অ্যানিমেশনের প্রতি প্রবল আকর্ষণের দরুন নিজ উদ্যোগে ‘রাম মোহন বায়োগ্রাফিক্স’ নামে নিজের প্রোডাকশন কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত কিছু কমার্শিয়াল প্রজেক্টে কাজ করত প্রতিষ্ঠানটি। জাপানের চলচ্চিত্র নির্মাতা ইউগো সাকোর সাথে মিলে ‘রামায়ণ: দ্য লিজেন্ড অভ প্রিন্স রাম’ (১৯৯২) নামক অ্যানিমেটেড ফিচার পরিচালনাও করেন।
ঐ সময়ে আধুনিক অ্যানিমেশনের বিষয়টি ভারতের মানুষের কাছে নতুন ছিল। এটি একটি চমকপ্রদ একটি বিষয়ও বটে। এর সাথে আবার ভারতের মতো হিন্দু-প্রধান দেশে এরকম একটি অ্যানিমেটেড ফিচার যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এছাড়াও ভারতীয় বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অ্যানিমেশনের পুরো কিংবা আংশিক কাজ করে বেশ সুনাম অর্জন করেন রাম মোহন। বি আর চোপড়ার ‘পতি পত্নী অর ও’ (১৯৭৮)-এ একটি অ্যানিমেটেড গান, সত্যজিৎ রায়ের ‘শতরঞ্জ কা খিলাড়ি’-এর একটি অংশ এবং মৃণাল সেনের একটি হিন্দি ছবি ‘ভুবন সোম’-এ অ্যানিমেশনের কাজ করে দেন তিনি। তাছাড়া ‘বিবি ও বিবি’, ‘কামচোর’ এবং ‘দো অউর দো পাঁচ’-এর মতো ছবিতেও তার কাজের নমুনা পাওয়া যায়।
আরএম-ইউএসএল
অ্যানিমেশন নিয়ে সবসময়ই বেশ আশাবাদী ছিলেন রাম মোহন। অ্যানিমেশনে তরুণ প্রজন্মকে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আরএম-ইউএসএল অ্যানিমেশন। তার পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত অ্যানিমেশন কোম্পানি ‘রাম মোহন বায়োগ্রাফিক্স’ সেই সময়ের ভারতের প্রধান পোস্ট প্রোডাকশন স্টুডিও ‘ইউনাইটেড স্টুডিওস লিমিটেড’-এর সাথে মিলে যাত্রা শুরু করে এই অ্যানিমেশন হাউজটির। কোম্পানিটির মালিক এবং অ্যানিমেশনের গুরু রাম মোহনের লক্ষ্য ছিলো এমন একটি অ্যানিমেশন হাউজ নির্মাণ করা, যার মধ্যে কাজ করার মতো যথেষ্ট জায়গা ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকবে। উল্লেখ্য যে, হাউজটি প্রায় ৫,০০০ বর্গফুটের ছিল যেখানে ১৩টি অ্যানিমো ওয়ার্ক স্টেশন রয়েছে।
রাম মোহন একটি সাক্ষাৎকারে বলেন যে, ১৯৯৭ সালের আগে রাম মোহন বায়োগ্রাফিক্সে শিল্পীদের অভাবে বেশি বড় কাজ করা সম্ভব হতো না। বেশিরভাগ সময় ছোট ছোট কমার্শিয়াল অ্যাড ও প্রজেক্ট করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এই কোম্পানির কাজ। গুরুত্বপূর্ণ ও বড় কাজগুলোর জন্য বৈদেশিক কোম্পানির সহযোগিতা প্রয়োজন হতো। উদাহরণস্বরূপ তিনি মীনা কার্টুনের কথা বলেছিলেন। ১৯৯২ সালে মীনা কার্টুনের কাজ শুরু করলে তার সাথে শুধুমাত্র ২০-২৫ জন শিল্পী কাজ করতেন। সেজন্য তিনি ম্যানিলার ফিল-কার্টুনসের সহায়তা নেন। অর্থাৎ, প্রথম কিছু পর্ব ম্যানিলা শহরেই নির্মিত হয়।
পার্টনারশিপ করার ফলে আরএম-ইউএসএলের কাজ করার ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পায়। আর এর ফলেই মীনার ১২ মিনিট করে তিনটি পর্ব তৈরি করা সম্ভব হয়৷ আবার পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য সারা কার্টুনের ১৬ মিনিটের পর্বের জন্য কাজ করে রাম মোহনের কোম্পানিটি। সারার চরিত্রটি হলো আফ্রিকার একটি কিশোরীর।
এই চরিত্রের মাধ্যমে আফ্রিকায় মেয়েদের সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়। ‘অ্যাডভেঞ্চার অভ অলিভার টুইস্ট’-এর দু’টি ২৪ মিনিটের পর্ব এবং সিঙ্গাপুর টেলিভিশনের ‘জো কিল্লাত’-এর ১৩টি ২৪ মিনিটের পর্ব প্রস্তুত করার দায়ভারও পড়ে এই কোম্পানির উপর। এসব কাজ সফলভাবে শেষ করেন আরএম-ইউএসএল। একটু আগে যে অ্যানিমেটেড ফিচার রামায়ণের কথা বলছিলাম, সেই ১৩৫ মিনিটের ফিচারও নির্মিত হয় আরএম-ইউএসএলে।
রাম মোহনের আরএম-ইউএসএল শুধু অ্যানিমেশনের কাজেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তরুণ প্রজন্মকে এই ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে এবং নতুনদের কাজ করার সুযোগ দিতে আর্ট স্কুল থেকে শিল্পীদের বাছাই করে তাদের জন্য ছয় থেকে আট সপ্তাহের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত।
মীনা কার্টুনে রাম মোহনের অবদান
৯০-এর দশকে দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে উপমহাদেশে যখন নারীদের অধিকার অনবরত ক্ষুণ্ণ হতে থাকে এবং নারী-পুরুষের বৈষম্য নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় অনুভব করা যায়, তখন ইউনিসেফ এমন একটি কার্টুন তৈরির উদ্যোগ নেয়, যা শুধু মানুষদেরকে বিনোদনই দেবে না, বরং নারী বা মেয়েদের প্রতি তাদের দৃষ্টিতে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। তাছাড়া অন্যান্য সামাজিক সমস্যাকে সকলের সামনে তা তুলে ধরে সমাধানও দেখিয়ে দেওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট চরিত্র সৃষ্টি করার চেষ্টা করে ইউনিসেফ। সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য কিন্তু অতি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের একটি মুখাবয়ব সৃষ্টির জন্য তখন রাম মোহনের দ্বারস্থ হয় প্রতিষ্ঠানটি। রাম মোহন নিজ হাতে রং তুলিতে আঁকেন আমাদের সকলের প্রিয় মীনাকে। মীনা কার্টুনের প্রতিটি চরিত্রই ফুটে ওঠে রাম মোহনের আঁকা ছবিতে। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মীনা কার্টুন সিরিজের ১৬টি পর্ব তিনি নিজেই পরিচালনা করেন।
এই প্রজেক্টে তার এই কাজের সাথে ইউনিসেফের পাশাপাশি যোগ দিয়েছিল বাংলাদেশের টুনবাংলা। এই সিরিজের প্রথম দিকের পর্বগুলো নির্মিত হয় ফিলিপাইনের ম্যানিলা শহরে অবস্থিত হান্না-বারবারা স্টুডিওতে। আর বাকি পর্বগুলো নির্মিত হয় ভারতের রাম মোহন স্টুডিওতে। মেয়ে শিশুদের সমস্যা ও সমাধানগুলো সুন্দর করে তুলে ধরার কারণে বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়াতেও মীনা কার্টুনের পরিচিতি বাড়ে। আর এর দরুন রাম মোহনের পরিচিতিও বাড়তে থাকে। মূলত বাংলায় নির্মিত হলেও হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, ফারসি, পর্তুগিজ, নেপালি ও পশতু ভাষায়ও সম্প্রচারিত হয় মীনা কার্টুন। ১৯৯৬ সালে রাম মোহন মীনা কার্টুনের এই সিরিজের জন্য কমিউনিকেশন আর্টস গিল্ডের ‘হল অভ ফেম’ অ্যাওয়ার্ডে আজীবন সম্মাননা লাভ করেন।
রাম মোহন ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অ্যানিমেশন নিয়ে কাজ করে গেছেন। ভারতের অ্যানিমেশন ডিভিশনকে তিনি এমন এক পর্যায় নিয়ে যান, যা সম্পর্কে কেউ কখনো ভাবতেই পারেনি। শুধু তা-ই নয়, নতুন প্রজন্মকে এই ডিভিশনে আসতে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে এবং এর পৃষ্ঠপোষকতায় কখনোই কোনো কার্পণ্য করেননি। এসব অবদানের জন্য তিনি ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ অ্যাওয়ার্ড পান। তাছাড়া তিনি আরো দু’টি জাতীয় পুরস্কার পান। এর মধ্যে একটি ছিল পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ের উপর নির্মিত ছবি ‘বাপ রে বাপ’-এর জন্য। আর অন্যটির ছিল- ‘ইউ সেইড ইট’-এর জন্য। ভারতের অ্যানিমেশন ডিভিশনে তার মূল্যবান অবদানের জন্যই তাকে ‘ফাদার অভ ইন্ডিয়ান অ্যানিমেশন’ বলা হয়। আর আমাদের প্রিয় মীনা কার্টুনের নির্মাতা হিসেবে রাম মোহনের অবদান আমাদের অ্যানিমেশন সেক্টরেও কম নয়। তার মতো একজন প্রতিভাবান কার্টুনিস্টকে বিদায় জানানো অত্যন্ত দুঃখজনক বটে।