কিছু কিছু সিনেমা আছে, যেগুলো মুক্তির পর দর্শকের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি করে। সিনেমাকে কোন জনরায় ফেলা যায়, সেই দ্বিধা চেপে বসে মাথায়। ২০২০ এর ৬ নভেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘সনি লিভ‘-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘ওয়েলকাম হোম’ তেমন এক ছবি। সিনেমাটি দেখার পর বিস্ময়ের রেশ থাকবে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে থাকবে দোটানা। কোন ঘরানার সিনেমা দেখলাম এতক্ষণ? হরর, থ্রিলার, নাকি প্যারানরমাল? ক্রাইমেও অনায়াসে ফেলা যাবে যাকে। তবে যা-ই হোক, দর্শককে অস্বস্তি দেবে সিনেমার গল্প, স্বস্তিও দেবে এই ভেবে, “যাক বাবা! অবশেষে সমাপ্তি ঘটলো এর!” এতটা মানসিক ধাক্কা সচরাচর দিতে পারেনি বলিউডের সিনেমা, সমসাময়িক কালে তো একেবারেই না!
“শহর থেকে দূরে জনমানবশূন্য এলাকা। যতদূর চোখ যায় ধূ ধূ করে চারিদিক। মানুষের চিহ্ন নেই। জঙ্গল, ডোবায় ভরপুর। একটি মাত্র দ্বিতল ভবন।” – এমন উপমা দিলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভৌতিক কোনো বাড়ির প্রতিচ্ছবি। ওসব বাড়িতে কেউ যেতে চাইবে না। বিনা দাওয়াতে তো নয়ই, এমনকি নিমন্ত্রণ দিলেও নয়। এমন একটি বাড়ির সামনে এসে মোটরবাইক থামান এক ভদ্রলোক। পিপাসা পেয়েছে তার। কিন্তু বোতলের পানি শেষ। আরও একটি কারণ ছিল দাঁড়ানোর। বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছিল নবজাতকের কান্না, প্রসব বেদনায় কাতর মায়ের চিৎকার।
শুরুতেই দর্শককে একটা ধাক্কা মেরে পরিচালক চলে আসেন আনুজা (কাশ্মিরা ইরানি) নামক চাকরিজীবী নারীর কাছে, যিনি এক সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। মাঝবয়সী, অবিবাহিত নারী। বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। হবু স্বামী চায় না তিনি চাকরি করুক। ওদিকে আনুজা চান নিজের পায়ে দাঁড়াতে। এই দাঁড়াবার ইচ্ছার অবশ্য দাম নেই কারো কাছে। বাবাকে জানালে তিনিও সায় দেন হবু জামাইয়ের পক্ষে। পারিবারিক কলহের বাধা অতিক্রম করে একা একজন নারী কর্মস্থলে যায়, সেখানেও নতুন সহকর্মী পুরুষ আড়চোখে কামনার দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। বড়বাবুকে জানালে তিনি দায়সারা ব্যবস্থা নেন। ভাবখানা এমন, এ আর আহামরি কী! অফিসে সহকর্মীর সঙ্গে এগুলো একটুআধটু হয়ই। ঠিক এখানে এসে আমরা পরিচিত হই সমাজের এক শ্রেণীর সাথে যারা নারীর প্রতি হওয়া অবমাননাকে স্বাভাবিক মনে করে এবং মজা লুটে।
পরের দৃশ্যে সহকর্মী নেহাকে (শ্রদ্ধা থিগলে) নিয়ে আনুজা বের হয় আদমশুমারি করতে। তালিকায় সবার শেষে থাকা বাড়ির অবস্থান সমন্ধে খাতায় ঠিকঠাক তথ্য নেই। আনুজার স্কুটারে চড়ে দুজন বেরিয়ে পড়ে অনুসন্ধানে। একসময় পেয়েও যায়। জনমানবহীন ওই বাড়িতে যেতে নেহার মন সায় দেয় না। আনুজা ভাবে- একবার যখন এলাম, একটা মাত্র বাড়ি বাকি; শেষ করেই যাই। ক’টাই বা প্রশ্ন আর! বাড়ির দরজায় নক করতেই ঝুম বৃষ্টি নামে! বেশ কিছুক্ষণ কড়া নাড়ার পর দরজার ফাঁকে দেখা যায় এক তরুণীকে। ভেতরে প্রবেশ করে ওরা দুজন। ঘরের তরুণীর নাম প্রেরণা (টিনা ভাটিয়া)।
সেই তরুণী গর্ভবতী। সন্তান প্রসবের সময় সন্নিকটে। আদমশুমারির বিষয়ে প্রশ্ন করে আনুজা! ঠিক তখন সে গোলমালের আভাস পায়। ঘরে কতজন সদস্য আছে- জিজ্ঞেস করলে প্রেরণা উত্তর দেয়। এটি প্রথম সন্তান কি না জানতে চাইলে সে না-সূচক উত্তর দেয়। অথচ বাড়িতে কোনো সন্তানের অস্তিত্ব নেই। প্রেরণার নির্লিপ্ত জবাব- বাচ্চারা মরে যায়! সেখান থেকে চলে আসলেও আনুজার মাথা থেকে যাচ্ছিল না সেখানকার অদ্ভুতুড়ে পরিবেশ এবং প্রেরণার রহস্যময়তা! নেহাকে একপ্রকার জোর করে রাজি করিয়ে কিছুদিন পর দুজন রওনা হয় সেই বাড়ির দিকে!
এতক্ষণ যা বলা হলো, তা সিনেমার প্রথম পনেরো মিনিটের চিত্র। পরিচালক ইচ্ছে করেই খানিকটা সময় নিয়েছেন কাহিনীতে ঢুকতে। টুকরো টুকরো দৃশ্যে দর্শককে বুঝিয়েছেন, সামনে ঝড় আসতে চলছে। প্রস্তুত থাকুন। আনুজা এবং নেহা ঐ বাড়িতে প্রবেশ করার পর থেকে আর এক সেকেন্ডও চোখ সরানোর উপায় থাকবে না। হলিউডী সিনেমায় আমরা দেখে থাকি, প্রতি পদক্ষেপে উত্তেজনা, ভয় কাজ করে। দর্শকের মনস্তত্ত্ব নিয়ে খেলতে পারঙ্গম তারা। বলিউড কিংবা ভারতের অন্যান্য ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সাইকোলজি নিয়ে অসংখ্য পরিচালক নাড়াচাড়া করলেও ‘ওয়েলকাম হোম’ যেন সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে।
‘ওয়েলকাম হোম’ চলচ্চিত্রটির বেশ কয়েকটি ধাপ আছে। ভিডিও গেমে যেমন একটার পর একটা লেভেল শেষ করে যত সামনে এগোনো যায় ততই কাঠিন্য অপেক্ষা করে, অনুরূপভাবে এখানেও দর্শক তা খুঁজে পাবেন। দেখতে দেখতে হয়তো ভাববেন, যাক দুর্দশা শেষ হলো। ঠিক ন্যানোসেকেন্ডের মাথায় নতুন চমক। এরপর আরেকটা, আবার আরেকটা। রহস্যময় বাড়িতে আনুজা আর নেহা রীতিমতো ভয়ঙ্কর সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে থাকেন।
বাড়ির ভেতরে যাওয়া যাক। বিশাল বাড়িতে মাত্র চারজন মানুষ। লীলা (অক্ষিতা অরোরা), যিনি বাড়ির কর্ত্রী; গনশ্যাম (শশী ভূষণ), বাড়ির প্রধান পুরুষ; প্রেরণা, যার রহস্য উন্মোচন করতে আনুজাদের দ্বিতীয় দফা আগমন; এবং ভোলা (বলোরাম দাস), বাড়ির কাজের লোক। এর বাইরে বাড়ির একপাশে একচালা আউট হাউজ এবং মাঝে গোয়ালঘর। গনশ্যাম কথা বলতে পারলেও মৌনব্রত (কথা না বলার প্রতিজ্ঞা) রাখে সিনেমার পুরোটা সময়। লীলার নির্দেশে নাটাই ঘুরলেও নাটাইয়ের মূল চরকা অন্য কারো হাতে। লীলাও সময়ের কাছে অসহায়! তবু সিনেমার প্রধান ভিলেনের আসল গুটি লীলাই! ভোলা সম্ভবত সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্র। একটি সিনেমায় আপনি যখন কারো মৃত্যু কামনা করবেন কিংবা সেই চরিত্রের চূড়ান্ত পরিণতিতে শিস বাজাবেন, বুঝতে হবে চরিত্রটি আপনার ভেতরে যেতে সক্ষম! ‘ওয়েলকাম হোম’-এ এমন একটি চরিত্র পর্দায় সদম্ভে ঘুরবে পুরো সময়।
‘ওয়েলকাম হোম’কে আগাগোড়া নিঁখুত নির্মাণের তকমা অনায়াসে দেওয়া যায়। পরিচালনা, লোকেশন, সিনেমাটোগ্রাফি, আবহসঙ্গীত, অভিনয়- সর্বত্র সর্বজনের মুন্সিয়ানা বিদ্যমান। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে এই চলচ্চিত্রটি। ভারতীয় উপমহাদেশের মারাত্মক সামাজিক সমস্যার আলোকে তৈরি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যে ঘষামাজা করেন অঙ্কিতা নারাং। অঙ্কিতা এর আগে ‘কাই পো চে’ সিনেমা ও দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর জনপ্রিয় ছবি ‘থুপাক্কি‘র বলিউড রিমেক ‘হলিডে‘তে ছিলেন। একক কৃতিত্বে এখন অবধি সেরাটা দিয়েছেন ‘ওয়েলকাম হোম’-এ।
পরিচালক হিসেবে পুস্কর মহাবল গল্প বেছে নিয়েছেন ডার্ক এবং সেনসেটিভ একটি ইস্যু নিয়ে। তাতে শতভাগ সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। সাঁই ভোপের সিনেমাটোগ্রাফির প্রশংসা করতে হবে। পরিচালকের ভাবনাসমগ্রকে এতখানি জীবন্ত করেছেন যে, কেবল সিনেমাটোগ্রাফিতে বুঁদ হয়ে থাকা যাবে অবলীলায়। আবহ সঙ্গীত ছাড়া আসলে বাকি সব পানসে। মেঘদীপ বসু নির্ভার করেছেন সিনেমার ঊর্ধ্বতনদের। মেঘদীপ এর আগে দঙ্গল, ধোনি দ্য আনটোল্ড স্টোরি, ছিঁছোড়ে, এয়ারলিফট, রাত আকেলি হ্যায়-এর মতো চলচ্চিত্রের সঙ্গীত বিভাগে কাজ করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই ওয়েলকাম হোম-এর সঙ্গীত নিয়ে পাঁড় ভক্তদের আলাদা আগ্রহ ও প্রত্যাশা তৈরি হয়। মেঘদীপ তা যেভাবে মিটিয়েছে, এর চেয়ে ভালো আসলে হওয়া কঠিন। আরেকটু বলে রাখা ভালো, এই সিনেমার প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন ছ’জন। পরিচালক মহাবল এবং চিত্রনাট্যকার অঙ্কিতার পাশাপাশি প্রযোজক হিসেবে ছিলেন পরেশ রাওয়াল।
চিত্রনাট্য, পরিচালনা, ক্যামেরার কাজ, সঙ্গীত অথবা লোকেশন- সবই পানসে হতো যদি অভিনয়ে ফাঁক থাকতো। তা হতে দেয়নি একজনও। প্রত্যেকে নিজস্ব চরিত্রকে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তুলেছেন। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রে কলাকুশলীদের নিজেদের উজাড় করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ওয়েলকাম হোম এর টিম চরিত্রের সাথে মিলেমিশে এতটাই একাকার হতে পেরেছে, দর্শক ভুলে যাবে চোখের সামনে সিনেমা চলছে।
চলচ্চিত্র একটি সমাজের প্রতিবিম্বস্বরূপ। নানাবিধ অসঙ্গতি ধরা দেয় সিনেমার জালে। সেসবের অনেকগুলো আমাদের চারপাশে রোজ ঘটে। কেউ কেউ সেটা স্বাভাবিকের নজরে দেখে। আবার এমন অপ্রত্যাশিত ও অপ্রকাশিত ঘটনা হুটহাট বেরিয়ে আসে, যা দেখেশুনে আঁতকে উঠি আমরা। আমরা কোথায় গেলে নিরাপদ?
বিশেষত নারীরা? তারা নির্যাতনের শিকার বেশি হয়ে থাকেন। কিন্তু ‘ওয়েলকাম হোম’ বারেবারে বোঝাবে, মানুষরূপী পশুদের সামনে আদতে কেউই নিরাপদ নয়। নারী-পুরুষ-শিশু ঐসব নরপশুর সামনে নিদারুণ অসহায়। মনুষ্যত্বের ছিঁটেফোঁটা যাদের ছুঁতে পারে না, কান্নায় যারা পাশবিক সুখ পায়, তাদের কাছে মনুষ্যত্ব পাবার আশা রাখা বাতুলতা। মানুষ তবু আশায় বাঁচে, সুখকে পুনরায় ঘরে স্বাগত জানাবার করুণ আকুতি আশার পালে হাওয়া দেয়।