১৯৩৩ সাল। সিনেমা নির্মাণের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কিংবা কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজারি তখনও ডেভেলপ হয়নি। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদের পর্দায় প্রদর্শন করতে হলে ওই প্রাণীর অবয়বখচিত পোশাক পরিধান করাই ছিল একমাত্র ভরসা। আনাড়ি সেই সিনেমাযুগেই পরিচালক মেরিয়ান কুপার সাদা-কালো পর্দায় আনলেন অতিকায় প্রাণী কিং কং এর সিনেমা। ভূয়সী প্রশংসায় ভেসেছিল ১৯৩৩ সালের সেই কিং কং।
এরপর বিভিন্ন কমিক, মাঙ্গা, সিরিজ ও চলচ্চিত্রের বদৌলতে উত্তরোত্তর কাল্পনিক এই দানবদের জনপ্রিয়তার লেখচিত্র শুধু ঊর্ধ্বমুখীই হতে থাকে। গড়ে ওঠে দানব বা মনস্টারদের আলাদা এক জগত। ১৯৭৬ সালে জন গুইলেরমিন তৈরি করেন কিং কং সিনেমার প্রথম রিমেক। এই সিনেমা ততটা সফলতার মুখ দেখেনি। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালে প্রখ্যাত হলিউড নির্মাতা পিটার জ্যাকসন বানিয়ে ফেলেন কালজয়ী সিনেমা কিং কং। বক্স অফিস ও সমালোচক, দুই মহলেই আগুন ধরিয়ে দেয় এই চলচ্চিত্র, উন্মোচন করে সিজিআই এবং ভিএফএক্স সিনেমার নতুন দ্বার। এরই মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা প্রায় আদিম পৃথিবীর টাইটানদের নিয়ে গঠিত মনস্টারভার্স। ২০১৪ সালে গডজিলা সিনেমার হাত ধরেই শুরু হয় মনস্টারভার্সের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। তুমুল দর্শকপ্রিয়তা কুড়ানো এই মনস্টারভার্সের অজানা কিছু দিক নিয়েই আজকের এই আলোচনা।
যেভাবে শুরু…
মনস্টারভার্সের বীজ সুপ্তাবস্থায় ছিল ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জাপানের গডজিলা মুভির মধ্যে। গডজিলাকে জাপানে গজিরা বলে ডাকা হয়। জাপানের তোহো কোম্পানির কাছে ছিল গজিরা ক্যারেক্টারের স্বত্ব। এই ফ্র্যাঞ্চাইজির শুরুটা তোহোর অধীনেই হয়েছিল, গজিরা মুভির মাধ্যমে। আমেরিকাতে এই সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল গডজিলা নামে। এই পর্যন্ত এই ফ্র্যাঞ্চাইজির মোট ৩৭টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, যার মধ্যে ৩২টি জাপানি, আর বাকি ৫টা হলিউডে।
মনস্টারভার্সের সূচনা
সবকিছু ঠিক থাকলে ২০১৪ সালের কয়েক বছর আগেই দেখা মিলত মনস্টারভার্সের। আশির দশকে আমেরিকান ডিরেক্টর স্টিভ মাইনার ‘গডজিলা: দ্য কিং অভ মনস্টার’ থ্রিডি মুভি বানাতে চেয়েছিলেন। যে কারণে তিনি তোহো প্রোডাকশন কোম্পানির সাথে মিলে এই মুভির স্ক্রিপ্ট আর স্টোরির উপর কাজ শুরু করে দেন। স্টিভ মাইনার এখানে স্টপ মোশনের সাথে সাথে এক অ্যানিম্যাট্রনিক পাপেট গডজিলা ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এর প্রোডাকশনের খরচ অনেক বেশি বিধায় তাকে এক স্টুডিও থেকে আরেক স্টুডিওর দরজায় ঘুরতে হয়েছিল। ১৯৯২ সালে ‘TriStar Pictures‘ গডজিলার ট্রিলজি বানানোর জন্য এর স্বত্ব কিনে নেয়। কিন্তু ১৯৯৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ট্রিলজির প্রথম সিনেমা গডজিলা মুক্তি পাবার পর তা বক্স অফিস এবং সমালোচক দুই মহলেই আলোর মুখ দেখতে না পাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় ট্রিলজির কাজ।
এরপর জাপানি পরিচালক ইয়োশিমিতসু বান্নো গডজিলাকে নিয়ে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন এক আইম্যাক্স মুভি। কিন্তু তোহো কোম্পানি ২০০৯ সালে গডজিলার স্বত্ব ‘লিজেন্ডারি পিকচার্স’-এর সাথে শেয়ার করে ফেলে। এখান থেকেই শুরু হয় মনস্টার ইউনিভার্সের যাত্রা। ২০১৪ সালে ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রথম মুভি গডজিলা সফল হবার সাথে সাথেই মনস্টারভার্সের পরবর্তী সিনেমার ঘোষণা দেওয়া হয়।
যেভাবে দেখতে হবে মনস্টারভার্স
নির্দিষ্ট টাইমলাইন মেনে মনস্টারভার্স দেখতে হলে নিচের ক্রম অনুসরণ করতে হবে।
- কং: স্কাল আইল্যান্ড (২০১৭)
- স্কাল আইল্যান্ড (২০২৩) [এটি ৮ পর্বের একটি অ্যানিমেশন, যা সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে]
- গডজিলা (২০১৪)
- গডজিলা অ্যান্ড দ্য টাইটান্স (আপকামিং) [অ্যাপল টিভি প্লাস প্লাটফর্মে আসতে যাওয়া এই সিরিজের টাইমলাইন ‘গডজিলা’ (২০১৪) এবং ‘গডজিলা: কিংস অভ মনস্টারস’ (২০১৯), এই পাঁচ বছরের মাঝামাঝি কোনো এক সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। ]
- গডজিলা: কিং অভ মনস্টারস (২০১৯)
- গডজিলা ভার্সেস কং (২০২১)
- গডজিলা ভার্সেস কং: দ্য নিউ এম্পায়ার (আপকামিং)
অনেকে ১৯৯৮ সালের গডজিলা এবং ২০০৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কিং কং সিনেমাকে মনস্টারভার্সের অংশ মনে করলেও, এগুলো মনস্টারভার্সের অংশ নয়।
গডজিলার অনুপ্রেরণা
‘Godzilla’ (1998) সিনেমাতে গডজিলার অবয়ব সমালোচনার শিকার হলে, ২০১৪ সালের গডজিলার অবয়ব নির্মাণে জাপানিজ ট্র্যাডিশনাল গডজিলাকে অনুসরণ করা হয়েছিল। গডজিলার চেহারা সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য পরিচালক কুকুর, ভালুক, আর ঈগলের মুখমণ্ডল নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তিনি এই কথা মাথায় রেখেছিলেন যে, গডজিলার চেহারা অতিমাত্রায় ভয়ংকর বা খুব বেশি আকর্ষণীয়, কোনোটাই হওয়া যাবে না। এই মুভিতেই প্রথম গডজিলার ভেতর ফুলকা যুক্ত করে দেন পরিচালক, যাতে সে পানিতে থাকা দ্রবীভূত অক্সিজেন গ্রহণ করে সমুদ্রের নিচে দিব্যি ঘুরে বেড়াতে পারে। ৩৫৫ ফুট উচ্চতা এবং ৫৫০ ফুট লম্বা লেজ নিয়ে ২০১৪ সালের গডজিলা ছিল ঐসময় পর্যন্ত গডজিলার সবচেয়ে বৃহৎ সংস্করণ।
কিং কংয়ের স্বত্ব নিয়ে ঝামেলা
কিং কংকে মনস্টারভার্সে দেখানোর পিছনে বিশেষ এক কারণ বিদ্যমান। মজার ব্যাপার হলো, কিং কং এর অফিসিয়াল রাইটস কারও হাতেই নেই। সে হিসেবে কিং কং একটি পাবলিক ডোমেন ক্যারেক্টার। এই চরিত্রের স্রষ্টা হলেন আমেরিকান চলচ্চিত্র পরিচালক মেরিয়ান সি কুপার। ১৯৩৩ সালে তিনি কিং কং সিনেমার মাধ্যমে এই প্রাণীকে দর্শকদের সাথে পরিচিত করান। এই মুভির প্রযোজনা সংস্থা ছিল ‘RKO Radio Pictures’, যারা কুপারের অগোচরেই এই ক্যারেক্টার রাইটস নিজেদের করে নিতে চাইছিল। ১৯৬০ এর দশকে সেই প্রতিযোগিতায় নাম লেখায় জাপানি তোহো কোম্পানি। এজন্য ১৯৬২ সালে আসে গডজিলা আর কিং কংয়ের প্রথম ক্রসওভার। ওদিকে কিং কংয়ের কমিক পাবলিশাররাও এর রাইট ক্লেইম করতে থাকে। এই অবস্থা দেখে, ১৯৭৫ সালে ইউনিভার্সাল পিকচার্স আর ডিনো ডে লরেন্টিস পিকচার্স স্টুডিয়ো মেরিয়ান কুপারের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। ফলে আদালতের রায়ে কিং কংকে পাবলিক ডোমেইন ক্যারেক্টার হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
স্কাল আইল্যান্ডের টাইমলাইন
শুরুর দিকে ‘কং: স্কাল আইল্যান্ড’ (২০১৭) সিনেমার কাহিনি ১৯১৭ সালের টাইমলাইনে নির্মিত হবার কথা ছিল। কিন্তু এই সিনেমার পরিচালক জর্ডান ভট-রবার্টস এই টাইমলাইনের ওপর লিখা স্ক্রিপ্ট নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। এজন্য তিনি প্রোডাকশন হাউজকে আমেরিকা-ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরবর্তী সময়কে নিয়ে আসার পরামর্শ দেন। স্কাল আইল্যান্ড সিনেমাটি ছিল ‘Apocalypse Now’ (1979) মুভি থেকে অনুপ্রাণিত। ‘কং: স্কাল আইল্যান্ড’ মুভির প্রাথমিক রানটাইম ছিল তিন ঘণ্টার কাছাকাছি। পরে সম্পাদনার ছুরি-কাঁচি চালিয়ে একে ২ ঘণ্টায় নিয়ে আসা হয়।
অ্যানিমেশন থেকে অনুপ্রেরণা
কং: স্কাল আইল্যান্ড সিনেমার বিভিন্ন দানব সদৃশ প্রাণী ও জীব-জন্তুকে ফুটিয়ে তুলতে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে ১৯৯৭ সালের জাপানি এপিক হিস্টোরিক্যাল ফ্যান্টাসি অ্যানিমেশন ‘Princess Mononoke‘। তবে এই সিনেমায় আরও একটি মনস্টার দেখানোর কথা ছিল। শিংযুক্ত এই বাঘ মুভির অফিশিয়াল আর্ট বুকে ইকারাস টাইগার নামে পরিচিত ছিল। কাহিনিটা এমন ছিল, এই বাঘের আক্রমণে একজন সৈন্য মারা যাবে।
একে ডিজাইন করার জন্য পরিচালক জর্ডান ভট-রবার্টস ২০০৬ সালের ওকামি ভিডিয়ো গেমের এক পশু থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন। শুধু ইকারাস টাইগার নয়, সিনেমা থেকে আরও অনেক প্রাণীর দৃশ্য বাদ পড়েছে, যা মুভির চিত্রনাট্যে বাড়তি সৌন্দর্য যোগ করতে পারত।
টাইটান গিডোরা
‘গডজিলা: কিং অভ মনস্টারস’ (২০১৯) সিনেমায় যে কয়টা কাইজু বা টাইটান দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হয়েছিল, তাদের মধ্যে টাইটান গিডোরা অন্যতম। এই টাইটানের স্বভাব-চরিত্র নির্ধারণের জন্য কিছু সরীসৃপ ও রাজ গোখরা থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে। এর অবয়ব তৈরি করা হয়েছে পূর্বদেশীয় ড্রাগন অনুযায়ী। তবে কিং গিডোরা একক কোনো সত্তা নয়, এতে তিনটি ভিন্ন সত্তা রয়েছে। মধ্যের মাথাটাকে বলা হয় আলফা, যে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান।
বক্স অফিস
বক্স অফিসে মনস্টারভার্সের সিনেমাগুলো টাইটানদের মতোই দাপট দেখিয়েছে। দর্শকদের মাঝেও এই ফ্র্যাঞ্চাইজি তুমুল জনপ্রিয়। যেকোনো মুভি ইউনিভার্সের মতো এটাও নিজস্ব গতিতে এগোচ্ছে। এই পর্যন্ত আসা ৪ মুভিতে প্রোডাকশন হাউজ ৬৭০ মিলিয়ন ডলার লগ্নি করে ঘরে তুলেছে প্রায় ১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বক্স অফিসের হিসেব মতে পুরোটাই ছিল লাভজনক প্রজেক্ট। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় করেছে কং: স্কাল আইল্যান্ড মুভিটি। ১৮৫ মিলিয়ন ডলারের এই মুভিটি বক্স অফিসে আয় করেছিল ৫৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।