
একটি অসম প্রেমের গল্প। সুকুদা (সুকুমার) গল্পের প্রধান চরিত্র; বলা যায় লেখক নিজেই, যার জবানিতে বইটি লেখা। আর আছে ‘ছুটি’, যে কিনা স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। সমাজের তোয়াক্কা না করে সুকুদাকে ভালোবেসে একা থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
সুকুদার বউ আছে, ছেলে আছে। সে জীবনে সুখী নয়। আর তখনই সুকুদার জীবনে আগমন ঘটে ছুটির। নতুন করে সে বাঁচতে শেখায় লেখককে। কিন্তু এদিকে সুকুদা, যে কিনা ছুটিকে ভালোবাসে ঠিকই; কিন্তু ভালোবেসে বিয়ে করা বউকে যে ভালোবাসে না, এমনটা ভাবতে পারে না। তার প্রতিও তার থাকে অনেক ভালোবাসা, কিংবা দায়িত্ববোধ, যা তাকে মাঝেমাঝে ছুটির সাথে মেলামেশা করতে বাধা দেয়। সম্পর্কের টানাপোড়নে বয়ে চলে জীবন।

বরাবরই দেখা যায়, লেখকেরা উদাসীন থাকেন তাদের সম্পর্ক নিয়ে, জড়িয়ে পড়েন অন্য একটি সম্পর্কে। কিন্তু কেন? চিরায়ত এই বিষয় নিয়ে লেখা এই বইটি।
সম্পর্কের টানাপোড়েনের বাইরে আছে লেখকের আকর্ষণীয় প্রকৃতি বর্ণনা। বরাবরই বুদ্ধদেব গুহ প্রকৃতি আর স্থানের বর্ণনা বেশ ভালোভাবে দেন, এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। এছাড়া, লেখক পার্শ্বচরিত্রগুলোকে খুব যত্ন করে ফুটিয়ে তুলেছেন। সুকুদা, যে একটা সময় চেয়েছে শুধুই সফল হতে, তার কথায়,
“পুরুষেরা কি কাজে সফল না হয়ে বাঁচতে পারে?”
সে চায় যশ, মান, খ্যাতি। তার কাছে টাকাটা ছিল পরের ব্যাপার, আগে যশ-মান। কেননা, সে জানে, প্রফেশনে যার যশ-খ্যাতি থাকবে, টাকা-পয়সা তার কাছে এমনিতেই চলে আসবে। সে ছুটে চলে। এসবের পেছনে ছুটতে ছুটতে যখন সফলতা এলো, নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে, তার কাছে শুধু সফলতাই আছে, তাছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তার কাছ থেকে তার স্ত্রী-সন্তান অনেক দূরে চলে গেছে। সুখ নামক বস্তুটি তার আওতার বাইরে। যদিও সে ফিরে আসতে চাইল, কিন্তু একটা সময় পর কেউই আর ফিরতে পারে না।
এদিকে রমা চেয়েছিল, তার স্বামী সফল হোক এবং একইসাথে তাকে সময় দিক, তার সঙ্গে ঘুরতে বের হোক, সিনেমায় যাক, বন্ধুদের পার্টিতে থাকুক। চিরকাল বেশিরভাগ মেয়ে যা চেয়ে এসেছে।
কিন্তু তার স্বামীর পক্ষে এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড রাখা সম্ভব হয়নি। সফল হতে গিয়ে আর সময় দিতে পারেনি রমাকে। একইসঙ্গে দু’টি দিক মানিয়ে চলা খুবই কঠিন বিষয়, যা সবাই পারে না। সুকুমারও পারেনি। তাই রমাও দূরে চলে গেছে। তার মতে, যে আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করল, তারই এখন আমার দিকে তাকানোর সময় হয় না। তবে আমি কেন তার দিকটা ভাবব? আমি কেন আমার জীবনে এগিয়ে যাব না?
আর অন্যদিকে আছে ছুটি, যে কিনা আধুনিক যুগের স্মার্ট মেয়ে, যে তার নিজের পছন্দ-অপছন্দ সর্ম্পকে স্পষ্ট ধারণা রাখে, তার কী চাই না চাই- সে মুখের উপর বলতে পারে, আত্মবিশ্বাসের সাথে একা একাই নিজের জীবন কাটাতে পারে।
মূল চরিত্রগুলোর থেকে পার্শ্বচরিত্রে যারা আছে, তাদেরকেই ভালো লেগেছে বেশি। শৈলেন, মিসেস কার্নি, মি. বয়েলস, লাবু, প্যাট, নয়নতারা, সোনালী চুলের বেণি দোলানো মেয়েটা। সবথেকে পছন্দের চরিত্র প্যাট, যার একটি পা নেই। ওর কথা যখন পড়েছি, তখন ‘ফরেস্ট গাম্প’ মুভির লেফটেন্যান্ট ড্যানের কথা মনে পড়েছে, যে কারো সাহায্য চায় না। একা একাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। যার জীবনবোধটাই আলাদা। খুব তীব্র লেগেছে এই চরিত্রটি।
এখানে প্যাটের অনেকগুলো কথা আছে তার মধ্যে একটি,
“যেসব লোক অন্যের করুণার উপর ভর করে বাঁচে, তারা দশটা পা থাকলেও চলতে পারে না। আই অ্যাম হ্যাপি দ্যাট আই ক্যান ম্যানেজ উইদাউট এনিবডি’জ হেল্প।”
আমার এমন চরিত্রগুলো বেশ ভালো লাগে, ছুটি আর সুকুদাকে ছাড়িয়ে গেছে এই চরিত্রটি।
এরপর আছে শৈলেন। আমাদের আশপাশে মাঝেমধ্যে দেখা যায় এমন কিছু ছেলেকে, যারা হুটহাট অল্প কিছুতে বেশ খুশি হয়ে পড়ে, মাঝরাতে গলা ছেড়ে গান গায়, কাউকে সম্মানের স্থানে বসালে, বন্ধু ভাবলে তার কাছেই ছুটে যায় আনন্দে দুঃখে, কাউকে ভালোবেসে ফেললে তাকেই জীবন ভেবে নেয়, তার জন্য সব কিছু করতে পারে, এমনকি মরতেও।
শৈলেন চরিত্রটি খুব অল্প জায়গা জুড়ে আছে বইয়ের, তারপরেও মনে রাখার মতো চরিত্র। শৈলেনের প্রতি লেখকের উদাসিনতা যে এত খারাপ লেগেছে, বলার অপেক্ষা রাখে না।
এদিকে সোনালী চুলের মেয়েটার ঘোড়া ছুটিয়ে আসা, মি. বয়েলসের মৃত্যুর সময়কার পরিস্থিতি; এ সকল বর্ণনা এত সুন্দর করে দেওয়া যে, এগুলো না দেখা সত্ত্বেও স্মৃতিতে রয়ে যাবে অনেকদিন। এরকম কিছু হয়তো কখনো দেখা হবে না, কিন্তু দেখলে এ সকল মুহূর্তে কীরকম অনুভূতি হয়, লেখক তা বুঝিয়ে দিয়েছেন।

প্রায় সব মানুষই সারাজীবন এমন কাউকে খুঁজে বেড়ায়, যে কিনা তার খারাপ লাগা সময়ে তার দিকে একটু উষ্ণতার হাত বাড়িয়ে দিবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। নিজের উষ্ণতার ভার নিজেকেই নিতে হয়, নিজের উষ্ণতার জন্য অন্য কারো কাছে কখনো হাত বাড়াতে নেই। এটাই বইয়ের মূল বক্তব্য।
বইয়ের একটি গান দিয়ে রিভিউ শেষ করি,
“Show me the way to go home.
I am tired,
And I want to go to bed;
Show me the way to go home.”
বইয়ের নাম: একটু উষ্ণতার জন্য || লেখকের নাম: বুদ্ধদেব গুহ
প্রকাশনী: আনন্দ পাবলিশার্স || অনলাইন প্রাপ্তিস্থল: রকমারি