১২০০০ বছর ধরে দোর্দণ্ডপ্রতাপে শাসন করছে গ্যালাক্টিক এম্পায়ার। কিন্তু এর পতন শুরু হয়ে গেছে। এরপর আরও একটি এম্পায়ার গড়ে উঠবে, তবে তা পতনের ৩০ হাজার বছর পর। এই দীর্ঘ সময় গ্যালাক্সিজুড়ে চলবে চরম নৈরাজ্য। একমাত্র হ্যারি সেলডন, তার বৈপ্লবিক বিজ্ঞান ‘সাইকোহিস্ট্রি’র মাধ্যমে এই পতনের ধারা বুঝতে পেরেছিলেন।
– ফাউণ্ডেশন (আইজাক আসিমভ)
সায়েন্স ফিকশন ঘরাণার শ্রেষ্ঠ লেখকদের তালিকা করতে গেলে যার নাম প্রথম তিনজনের মধ্যে আসবে তিনি আইজাক আসিমভ (১৯২০-১৯৯২)। ১৯২০ সালে রাশিয়ায় জন্ম নেয়া এই লেখক তিন বছর বয়সে আমেরিকা চলে আসেন। তার সারা জীবন তিনি এখানেই বসবাস করেছেন। কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করা এই ভদ্রলোক বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে ১৯৪৮ সালে যোগদান করেন এবং কর্মজীবনের বাকি সময়টা এখানেই অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে মানুষ তাকে মনে রেখেছে তার সায়েন্স ফিকশন লেখনীর জন্য। তার পরবর্তী সায়েন্স ফিকশন লেখকদের একটা বড় অংশই তার দ্বারা প্রভাবিত। আমরা অনেকেই হয়তো তাকে চিনি রবোটিক্সের তিনটি সূত্রের জনক হিসেবে, যা বাংলাদেশের লেখকরাও ব্যবহার করেছেন। তবে তার সবচেয়ে জনপ্রিয় কাজের কথা চিন্তা করলে ফাউণ্ডেশন সিরিজ সবার আগে আসবে। আজকে এই সিরিজেরই প্রথম পর্ব ‘ফাউণ্ডেশন’ এর কথা আলোচনা করা হবে।
ফাউণ্ডেশন সিরিজের ইতিহাস
আসিমভের নিজের জবানীতে জানা যায়, ফাউণ্ডেশন সিরিজ লেখার মূল প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবন এর লেখা “দ্য হিস্টরি অফ দ্য ডিক্লাইন এন্ড ফল অফ দ্য রোমান এম্পায়ার” থেকে। তবে ফাউণ্ডেশন এর মূল ভিত্তি, সাইকোহিস্ট্রির ধারণা তার মাথায় এসেছিল গ্যাসের আচরণগত সূত্র থেকে, যেখানে সম্মিলিতভাবে গ্যাস মাস হিসেবে এর আচরণ সম্পর্কে পূর্বানুমান করা সম্ভব। সাইকোহিস্ট্রির মূল ধারণা এটাই, যাতে একটি বড় মানবগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব, যখন যাদের সম্পর্কে এই ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে তারা তা জানে না। এই না জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যদি কোনো জনগোষ্ঠী জেনে যায় তাহলে এর প্রেক্ষিতে তাদের আচরণ পরিবর্তিত হয়ে যাবে, এবং তখন সাইকোহিস্ট্রির সূত্র যথাযথভাবে খাটবে না।
ফাউণ্ডেশন এর শুরু হয়েছিল ১৯৪২ সালে “এসটাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশন” ম্যাগাজিনে ছোটগল্প হিসেবে। এর তৎকালীন সম্পাদক, জন ডাব্লিউ ক্যাম্পবেলকে আসিমভ বিভিন্ন সময় তার মেন্টর হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং ফাউণ্ডেশন সিরিজের বিভিন্ন বিষয়ে তার অবদানের কথা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন। এই ম্যাগাজিনে ৮টি ছোটগল্পের পর ১৯৫১ সালে প্রথম বই প্রকাশিত হয় “ফাউণ্ডেশন” নামে, ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় বই এর নাম ছিল “ফাউণ্ডেশন এন্ড এম্পায়ার” এবং ১৯৫৩ সালে এই সিরিজের তৃতীয় বই “সেকেন্ড ফাউণ্ডেশন” প্রকাশিত হয়। এর পরেও আসিমভ ফাউণ্ডেশন নিয়ে বই লিখেছেন, তবে এই তিনটি বইকেই মূল ট্রিলজি ধরা হয়। ১৯৬৬ সালে তার ফাউণ্ডেশন ট্রিলজি সর্বকালের সেরা ফ্রাঞ্চাইজি হিসেবে সম্মানজনক হুগো অ্যাওয়ার্ড লাভ করে।
প্রথম পর্ব: ফাউণ্ডেশন
এই লেখায় শুধু ফাউণ্ডেশন এর কাহিনীর সারসংক্ষেপ তুলে চেষ্টা করবো। মূল গল্পের পটভূমি ব্যাখ্যা করার জন্য উপরের আলোচনার অবতারণা করা।
ফাউণ্ডেশন এর গল্পকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। এর প্রথমভাগ খুব সংক্ষিপ্ত এবং এর ঘটনাপ্রবাহ জীবিত হ্যারি সেলডনকে ঘিরে আবর্তিত। তার ব্যক্তিগত সহকারি গাল ডরনিকের দৃষ্টিতে এই অংশ বর্ণিত হয়েছে।
এম্পায়ারের আসন্ন পতন নিয়ে হ্যারি সেলডন এবং তার সহযোগীরা মিথ্যা আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন- এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে সেলডন তাদের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। এম্পায়ারের ১২,০০০ বছর ধরে পুঞ্জিভূত জ্ঞানের সমন্বয়ে এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি করা, যা মানবজাতি পতন পরবর্তী সময়ে কাজে লাগাতে পারবে। বিচারক তাদের দুটি বিকল্পের একটি বেছে নিতে বলেন: মৃত্যু অথবা নির্বাসন। সেলডন নির্বাসনের রাস্তা বেছে নেন। বয়সের কারণে তাকে যেতে না হলেও তার সাথে যারা ছিলেন তাদেরকে পাঠান হয় গ্যালাক্সির প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট্ট গ্রহ টার্মিনাসে, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ নেই বললেই চলে এবং জীবনধারণের জন্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই গ্রহে এসে সেলডনের কিছু সহযোগী এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি অব্যাহত রাখেন। তারা এনসাইক্লোপিডিস্ট নামে পরিচিতি পান এবং এরাই টার্মিনাসের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। নির্বাসন গ্রহণ করার পর সেলডন গালের কাছে ব্যাখ্যা করেন যে তিনি সাইকোহিস্ট্রির সাহায্যে আগে থেকেই এ বিষয়ে জানতেন এবং টার্মিনাসে নির্বাসন তার মূল পরিকল্পনার একটা অংশ।
বইয়ের দ্বিতীয় পর্বে আমরা দেখতে পাই টার্মিনাসে একটি বর্ধিষ্ণু জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যাদের অনেকের জন্ম এখানেই। এনসাইক্লোপিডিস্টরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। গ্যালাক্সির দূরতম প্রান্তে গ্যালাক্টিক এম্পায়ারের অবক্ষয় অব্যাহত রয়েছে, এবং টার্মিনাসের চার প্রতিবেশি গ্রহ কার্যত স্বাধীন রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাদের সবার লক্ষ্য টার্মিনাসে তাদের উপনিবেশ স্থাপন, কারণ একমাত্র টার্মিনাসের কাছে আছে পারমাণবিক প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি কুক্ষিগত করতে একটি প্রতিবেশী গ্রহ “আনাক্রিয়ন” তাদের চরমপত্র পাঠায়। তারা টার্মিনাসের পারমাণবিক প্রযুক্তি তাদের কাছে সমর্পণ করতে বলে, অন্যথায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হুমকি দেয়।
এই পরিস্থিতিতে টার্মিনাসের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে স্যলভর হার্ডিন এনসাইক্লোপিডিস্টদের সাথে দেখা করেন এবং তাদের পরামর্শ দেন আনাক্রিয়নকে ঠেকানোর ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু তাদের এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি ছাড়া অন্য বিষয়ে মাথা ঘামানোর অনীহা লক্ষ্য করে নিজেই টার্মিনাসের শাসনভার নিয়ে আনাক্রিয়নকে প্রতিহত করার পরিকল্পনা করেন। এর মধ্যে সেলডন ভল্ট নামে পরিচিত একটি কক্ষ প্রথমবারের মতো খোলার সময় চলে আসে, এবং এনসাইক্লোপিডিস্টদের সাথে হার্ডিন কক্ষে প্রবেশ করেন যখন বাইরে তার সমর্থকরা টার্মিনাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছিলেন। এখানে এসে তারা এক বড় ধাক্কা খান, যখন হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি হিসেবে হ্যারি সেলডন আবির্ভূত হন এবং ঘোষণা করেন যে এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি করার কথা আসলে একটা ধাপ্পা, টার্মিনাসের মূল উদ্দেশ্য পতন পরবর্তী ১,০০০ বছরের মধ্যে সেকেন্ড গ্যালাক্টিক এম্পায়ার তৈরি করা, যার দ্বারা ৩০,০০০ বছরব্যাপী নৈরাজ্য এড়ানো সম্ভব হবে। সাইকোহিস্ট্রির সাহায্যে তিনি ব্যাখ্যা করেন, টার্মিনাসের জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে যে তারা নির্দিষ্ট সময় পর পর একটি পূর্বনির্ধারিত সঙ্কট বা “সেলডন ক্রাইসিস” এর মুখোমুখি হবেন এবং এর থেকে উত্তরণের একটিমাত্র রাস্তাই, যা খুবই সুস্পষ্ট, তাদের সামনে খোলা থাকবে। এবং ইতিহাসের পরিক্রমায় এখান থেকে সেকেন্ড গ্যালাক্টিক এম্পায়ার তৈরি হবে, যার জন্য তিনি গ্যালাক্সির বিপরীত শেষপ্রান্তে দুটি ফাউণ্ডেশন স্থাপন করেছেন।
এরপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। স্যলভর হার্ডিন টার্মিনাসের ক্ষমতা দখল করে নেন এবং সেলডনের বর্ণিত একটিমাত্র রাস্তা, যা তিনি সেলডন বলার সাথে সাথেই বুঝতে পেরেছিলেন, অবলম্বন করে আনাক্রিয়নকে প্রতিহত করেন কোনো সামরিক শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই।
এই ঘটনার পরে এ বইতে আরও দুটি সেলডন ক্রাইসিস বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ক্রাইসিসের সময় স্যলভর হার্ডিন টার্মিনাসের মেয়র হিসেবে আরেকবার বিরুদ্ধ শক্তির কবল থেকে একে রক্ষা করেন। প্রথম ক্রাইসিসের পর তিনি টার্মিনাসের পারমাণবিক প্রযুক্তিকে ধর্মের মোড়কে ঢেকে ফেলেন এবং প্রতিবেশী গ্রহগুলোকে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দেন এই শর্তে যে, এর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা টার্মিনাসের মনোনীত ব্যক্তিদের, যারা প্রিস্ট নামে পরিচিত হয়, তাদের কাছে থাকবে। এই প্রযুক্তিকে ঐশ্বরিক আশীর্বাদ হিসেবে টার্মিনাসের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রহগুলোর কাছে হার্ডিন তুলে ধরতে সমর্থ হন, এবং এর মাধ্যমেই তিনি টার্মিনাসকে রক্ষা করেন।
তৃতীয়, এবং বইতে বর্ণিত সর্বশেষ ক্রাইসিস আসে এমন এক সময় যখন টার্মিনাস তার পারমাণবিক ধর্মকে পুঁজি করে আশেপাশে একটা বড় অংশ পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছে। এই সময়ের প্রেক্ষাপটে তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে “থিওক্রাটিক” গোষ্ঠী, যারা ধর্ম ব্যবহার করে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে আগ্রহী, এবং “ট্রেডার” বা বণিকসমাজ, যারা টার্মিনাসের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি কাজে লাগিয়ে অন্যান্য গ্রহকে একটি অর্থনৈতিক ফেডারেশনের মাঝে নিয়ে আসতে চায়। এই ক্রাইসিসের নেতৃত্ব দেন হুবার ম্যলো, এবং টার্মিনাসের নতুন মেয়র হিসেবে তার সময় থেকেই ধর্মভিত্তিক রাজ্যবিস্তার পরিহার করে টার্মিনাস তার অর্থনৈতিক এবং টেকনোলজিক্যাল ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অন্যান্য গ্রহকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করার নীতি বেছে নেয়।
সভ্যতার উত্থান ও পতন: ধর্ম ও অর্থনীতি
অন্যান্য সায়েন্স ফিকশনের চেয়ে ফাউণ্ডেশনের বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে মানবসমাজের পরিক্রমা দেখান হয়েছে, ভবিষ্যতের প্রযুক্তি এখানে গৌণ এবং ভিনগ্রহের প্রাণী, রোবট এসব কিছুই নেই। আসিমভ যেভাবে ধর্ম ও অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে সাম্রাজ্য বিস্তার দেখিয়েছেন সেটা কি ঐতিহাসিকভাবে সত্য নয়? আমরা যদি পৃথিবীর ইতিহাস দেখি তাহলে এটা খুব সহজেই বুঝতে পারব যে আসিমভ যেভাবে দেখিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ধর্ম ও পরে অর্থনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগান হয়েছে। এবং অনেক সভ্যতার উত্থান-পতনের সাথে এ দুটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সুতরাং ফাউণ্ডেশন যতটা ভবিষ্যতের গল্প, ঠিক ততটাই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।
ফাউণ্ডেশন এমন একটি সিরিজ, যা সব পাঠকেরই একবার পড়া উচিত। এতে বৈজ্ঞানিক তথ্যের কচকচানি নেই, রমরমা রোমান্স, গা শিহরানো অ্যাকশন কোনোটাই নেই। কিন্তু তারপরও পাঠক পড়তে বসলে শেষ না করে উঠতে পারবেন না। এখানেই আসিমভের মুনশিয়ানা। এই বই এবং সিরিজ পরবর্তী সময়ে লেখকদের যেমন প্রভাবিত করেছে, তেমনি অন্যান্য ধারার অনেক মানুষকে চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে। এর মধ্যে খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান থেকে শুরু করে অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তি আছেন। সুতরাং আসিমভের ফাউণ্ডেশন কোনো সাধারণ সাই-ফাই নয়, বরং একে চিন্তার খোরাক জোগানোর মতো কালজয়ী সাহিত্য বললে অত্যুক্তি হবে না।
ফাউন্ডেশন সিরিজের সবগুলো বই একত্রে পড়তে ক্লিক করতে পারেন এই লিঙ্কেঃ