বর্তমান বিশ্বে টিকে থাকার জন্য কী কী গুণ থাকা প্রয়োজন এমন প্রশ্নের উত্তরে যদি একটি তালিকা তৈরি করতে বলা হয়, তাহলে নেটওয়ার্কিং একেবারে শুরুর দিকে থাকবে। নেটওয়ার্কিং ব্যাপারটি অনেকটা জালের মতন। একজন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার অর্থ আপনি কেবল তার সাথে পরিচিত হচ্ছেন না, বরং তার চিন্তাধারা, নিজস্ব জগত, ভালো লাগা-না লাগার সাথেও আপনি নিজেকে পরিচিত করছেন।
নেটওয়ার্কিং নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রচুর বই লেখা হয়েছে। তার মধ্যে কেইথ ফেরাজির ‘Never Eat Alone‘ অন্যতম। চলুন, জেনে আসা যাক ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট সেলার এ বইটি সম্পর্কে!
কেইথ ফেরাজি তিপ্পান্ন বছর বয়সী একজন আমেরিকান উদ্যোক্তা এবং লেখক। তবে এর চেয়েও বড় পরিচয় হলো, তিনি একেবারে রুট লেভেল থেকে উঠে আসা একজন মানুষ, যিনি একজন ক্যাডি (গলফ খেলোয়াড়ের সহায়ক) হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন। কীভাবে সম্ভব হল তার এ অসাধারণ পথচলা? Never Eat Alone বইটিতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
কোনো ক্লাব বা গ্রুপের সদস্য হওয়া
নেটওয়ার্কিং বা কারো সাথে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রথম শর্ত হলো নিজেদের মধ্যে কোনো পারস্পরিক ক্ষেত্র তৈরি করা। এই ক্ষেত্র তৈরি করার সহজতম উপায় কোনো ক্লাব কিংবা গ্রুপের সদস্য হওয়া।
আমাদের স্কুল, কলেজ কিংবা ভার্সিটিতে অসংখ্য ক্লাব, গ্রুপ বা সংগঠন রয়েছে। একটু খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেই ক্লাব বা সংগঠনগুলোতে নির্দিষ্ট কিছু দিন পর পর আড্ডা বা মিটিং বসে। নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরার এর চেয়ে ভাল সুযোগ আর কী হতে পারে! পাশাপাশি সেই ক্লাবগুলো মাঝে মাঝে নানা অনুষ্ঠানও আয়োজন করে। অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে কেবল ক্লাবের সদস্যদের সাথে নয়, বরং অনুষ্ঠানের অতিথি বা স্পন্সরদের সাথেও আপনার পরিচয় হয়ে যেতে পারে। আপনার নিজের ভাল লাগা বা আগ্রহ অনুসারে আজকেই হয়ে যান আপনার স্কুল, কলেজ বা ভার্সিটির ক্লাবের সদস্য!
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে… না তবুও একলা চলা যাবে না
একটা কথা আছে, “আপনি যদি দ্রুত যেতে চান, একা যান। কিন্তু যদি আপনি অনেক দূর যেতে চান, তবে অনেককে সাথে নিয়ে যান।” কথাটি কোনো অংশে ভুল নয়। আপনি একজন একক স্বত্ত্বা হিসেবে কখনো সব ধরনের কাজে পারদর্শী হতে পারবেন না। কোনো না কোনোভাবে আশেপাশের মানুষদেরকে আপনার প্রয়োজন হবে। তাদের সাহায্য ছাড়া আপনি খুব বেশি দূর এগোতে পারবেন না। নেটওয়ার্কিংয়ের গুরুত্ব ঠিক এখানেই।
ধরা যাক, তুমি নিজে একটা ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করতে চাচ্ছেন। এখন, তুমি যে পণ্যটি উৎপাদন করতে চাচ্ছেন, সেই সম্পর্কে আপনার ভাল ধারণা থাকতে পারে। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে আপনি আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। সেই পণ্যের প্রচারের জন্য আপনার কারো সাহায্য প্রয়োজন। তেমনিভাবে, ওই পণ্যের মান নির্ধারণ করার জন্যও আপনার কারো উপর নির্ভর করতে হবে। অর্থাৎ, আপনি একা কখনো পুরো ব্যবসা দাঁড় করাতে পারছেন না। আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র এমনই। একা কখনো কারো পক্ষে খুব বেশি পথ চলা সম্ভব নয়।
লক্ষ্য যখন নির্দিষ্ট, তখন সাফল্য সুস্পষ্ট
ছোটবেলায় রচনা শেখার সময় আমরা পড়েছিলাম, “লক্ষ্যবিহীন জীবন পাল ছাড়া নৌকার মতন।” আর এখন বড়বেলায় এসে সেই কথার গুরুত্ব হাড়ে হাড়ে অনেকেই টের পাচ্ছে। Never Eat Alone বইটিতে লেখক লক্ষ্য স্থির করার সময় তিনটি বিষয় খেয়াল রাখতে বলেছেন- ১. নিজের প্যাশন বা আগ্রহ খুঁজে বের করা, ২. নিজের লক্ষ্যগুলো কাগজে লিখে রাখা, এবং ৩. পরামর্শ নেওয়ার মতো কিছু মানুষের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার একটি পরীক্ষা করা হয়েছিল। সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। দেখা গেল, ৮৪% ছাত্র-ছাত্রী তাদের লক্ষ্য স্থির করেনি। ১৩% শিক্ষার্থী তাদের লক্ষ্য স্থির করেছে, কিন্তু তা লিখে রাখেনি। মাত্র ৩% শিক্ষার্থী তাদের লক্ষ্য স্থির করে কাগজে লিখে রেখেছে।
আপাতদৃষ্টিতে তেমন গুরুত্ববহ মনে না হলেও এ পরীক্ষার ফলাফল ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কয়েক বছর পর দেখা গেল, তের শতাংশ যারা তাদের লক্ষ্য স্থির করেছিল, তাদের আয় বাকি চুরাশি শতাংশ থেকে প্রায় দ্বিগুণ। অন্যদিকে তিন শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী, যারা তাদের লক্ষ্য কাগজে লিখে রেখেছিল, তাদের আয় বাকি সাতানব্বই শতাংশের আয়ের দশ গুণ!
প্রয়োজনের পূর্বেই প্রস্তুতি নিন
প্রয়োজন হওয়ার পর সবকিছু নিয়ে চিন্তাভাবনা করা বা পদক্ষেপ নেওয়ার একধরনের প্রবণতা আমাদের সবার মধ্যে রয়েছে। নেটওয়ার্কিং বা কারো সাথে পরিচিত হওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা একই ধরনের ভুল করে থাকি। অথচ, এটা কখনো ভেবে দেখি না যে কেবল প্রয়োজনের সময় যদি আমরা কোনো মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার বা সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করি তাহলে সেই মানুষের মনে হতেই পারে যে, প্রয়োজন হয়েছে বলে আমরা তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করছি। বিরূপ ভাব তৈরি করার জন্য এতটুকু চিন্তাই যথেষ্ঠ।
আজ থেকে পাঁচ বছর পরে আপনার যদি নিজের কোনো প্রতিষ্ঠান শুরু করার পরিকল্পনা থেকে থাকে, তবে পাঁচ বছর পরে নয়, বরং আজকে থেকেই একটি তালিকা তৈরি করে শুরু করে দিন সেই মানুষগুলোর সাথে যোগাযোগ। দেখবেন পাঁচ বছর পর আপনার সাথে মানুষগুলোর সম্পর্ক কেবল দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে আবদ্ধ থাকবে না।
দ্বিধাবোধকে দূরে সরিয়ে দাও
একটা সময় ছিল যখন আমি খুব লাজুক প্রকৃতির ছিলাম। কারো সামনে কথা বলতে বা মুখ ফুটে কিছু চাইতে খুব লজ্জা পেতাম। এখনও আমার সেই লাজুক প্রকৃতি তেমন পরিবর্তন হয়নি ঠিক, তবে এখন আর আগের মতন চুপ করে বসে থাকি না। সাহস করে বলে ফেলি।
একবার এক দাওয়াতে গেলাম। খেতে বসার পর আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম পরিচিত কেউ আমার সাথে নেই। যা-ই হোক, খাওয়া শুরু করলাম। সবাই একেবারে কবজি ডুবিয়ে খাচ্ছে। এদিকে খাওয়া শুরু করার কিছুক্ষণ পর আমার প্লেট খালি, কেউ সেদিকে তাকাচ্ছে না। আর আমি লজ্জায় কাউকে বলতে পারছি না, খাসির রেজালার বাটিটা আমার দিকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। অগত্যা, অতটুকুতেই খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ি।
সেদিনের সেই দাওয়াতে আমি যদি লজ্জার কথা না ভেবে মুখ ফুটে বলে ফেলতাম, তাহলে আমাকে অর্ধেক খেয়ে উঠে আসতে হত না। তবে সেদিনের দাওয়াত আমাকে অনেক বড় এক শিক্ষা দিয়েছে। কখনো কারো কাছে কোনো প্রয়োজনের কথা বলতে দ্বিধান্বিত হওয়া উচিত না। এখানে লজ্জার কিছু নেই। আপনি মুখ ফুটে বলা ছাড়া আপনার সামনের মানুষটি কখনোই বুঝবে না আপনি তার কাছে কী চান।
অপর পাশের মানুষটিকে কিছু দিন
আমাদের মানব জাতির একটি স্বভাব হলো- আমরা সবসময় কিছু না কিছু পাওয়ার আশায় থাকি। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো, কেবলমাত্র পাওয়ার আশা করে কোনো সুসম্পর্ক তৈরি করা যায় না। কারণ, অপর পাশের মানুষ, যার কাছ থেকে আমরা পাওয়ার আশা করছি, তিনি নিজেও একজন মানুষ। তাই তিনিও আমাদের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা করাটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
“Give and Take” বলে একটি বিষয় সমাজে প্রচলিত আছে। নেটওয়ার্কিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটির গুরুত্ব অনেক বেশি। আপনার কাছ থেকে যদি অপর পাশের মানুষটি কিছু না পায়, তাহলে আপনি তাকে আপনার কাজে সবসময় পাশে পাওয়ার আশা করতে পারেন না।
আমাদের জগতের প্রত্যেকটি সম্পর্ক এমন দেওয়া-নেওয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। তবে দেওয়া-নেওয়ার এ ব্যাপারটি সবসময় যে আর্থিক সাহায্য কিংবা বস্তুগত কোনো সাহায্যের মধ্যে আবদ্ধ থাকবে এমন কোনো কথা নেই। আপনার ভার্সিটির কিছু সিনিয়রের সাথে আপনার খুব ভাল সম্পর্ক। তাদের কাছ থেকে আপনি আর্থিক কোনো সাহায্য পান বা অন্য কোনো ধরনের সাহায্য পান এমন কিন্তু না। তবে তাদের ব্যবহার এবং আচরণ আপনাকে তাদের সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি করতে সাহায্য করেছে। অথবা তাদের সাথে আপনার কোনো না কোনো পারস্পরিক ক্ষেত্র রয়েছে, যার কারণে আপনি তাদের সাথে কথা বলে আনন্দ পান, চলাফেরা করতে পছন্দ করেন।
আপনি সবসময় কোনো মানুষকে আর্থিক বা বস্তুগত সাহায্য না-ও করতে পারেন, তবে আপনার সুন্দর এবং রুচিশীল ব্যবহার আপনাকে তাদের সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি করতে সাহায্য করবে। তাই কারো সাথে পরিচিত হওয়ার আগে সেই মানুষটির পছন্দ-অপছন্দের জায়গাগুলো নিয়ে আমাদের কাজ করা উচিত। অনেক সময় দেখা যায়, কারো সাথে পরিচিত হওয়ার পর তার সাথে আলাপ চালানোর মতন কোনো বিষয় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি যদি আগে থেকে সেই মানুষটির পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলো জেনে নেন, তার সর্বশেষ কাজ সম্পর্কে তথ্য নিয়ে রাখেন, তার কাজের কোন কোন বিষয়গুলো আপনার ভাল লেগেছে তার একটি তালিকা তৈরি করে ফেলেন এবং সেই ব্যক্তিটি সম্পর্কে গুগল করে তার সম্পর্কে জেনে নিন, তাহলে এ ধরনের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে না।
নেটওয়ার্কিংয়ের আদ্যোপান্ত তো জানা হলো, এবার তাহলে কৌশলগুলো কাজে লাগানোর পালা!