‘মানি লন্ডারিং’ বিশ্বজুড়ে একটি সমস্যার নাম। মূলত মানি লন্ডারিং এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা কিংবা সম্পদকে বৈধ করে নেওয়া হয়। এই কারণেই মানি লন্ডারিংকে বলা হয়ে থাকে ‘ফাইনান্সিয়াল ডিটারজেন্ট’। কাপড় পরিষ্কারের ডিটারজেন্ট দিয়ে ময়লাযুক্ত কাপড়কে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলার পর যেমন আর বলা যায় না কী ধরনের ময়লা কাপড়ে লেগেছিলো, ঠিক তেমনই মানি লন্ডারিং হয়ে যাওয়ার পরে এর প্রাথমিক উৎস খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। ফলে সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষের জন্য সে অবৈধ উপার্জনকারীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই কর ফাঁকি দেওয়া ধনকুবের থেকে শুরু করে মাদক পাচারকারী সবার কাছেই এই মাধ্যমটি বেশ জনপ্রিয়। কানাডিয় এক অর্থনীতিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর প্রায় ৫৯০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত অর্থকে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বৈধ করে নেওয়া হয়।
তবে মানি লন্ডারিং এর ব্যাপারে অনেকের যে ভুল ধারণাটি বিদ্যমান সেটি হলো, শুধুমাত্র বিদেশে টাকা কিংবা সম্পদ পাচারের মাধ্যমে লন্ডারিং করা হয়ে থাকে। ব্যাপারটি কিন্তু মোটেও সেরকম নয়। বরং এটি মানি লন্ডারিং করার একটি উপায় মাত্র। দেশের অর্থনৈতিক গণ্ডির ভিতরে রেখেও অবৈধ সম্পদকে বৈধ করা যায়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয়ে থাকে ‘ডমেস্টিক লন্ডারিং’। চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে করা হয়ে থাকে মানি লন্ডারিং।
মূলত তিনটি ধাপে করা হয়ে থাকে মানি লন্ডারিং।
- অবৈধ অর্থ কিংবা সম্পদকে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঢুকানোর মাধ্যমে শুরু হয় মানি লন্ডারিং। এটি হতে পারে ভুয়া ব্যাংক একাউন্ট কিংবা ডিপোজিটের মাধ্যমে ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ টাকা জমা রাখার মাধ্যমে। অর্থনীতির পরিভাষায় এই ধাপটি পরিচিত ‘Placement’ নামে ।
- এরপর শুরু করা হয় লেনদেন। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে অর্থ যদি ব্যাংকে ‘প্লেসমেন্ট’ করা হয় তা একটি একাউন্ট থেকে ক্রমান্বয়ে শত শত ভুয়া একাউন্টে লেনদেন শুরু করা হয়। এই ধাপকে বলা হয় ‘Layering’।
- শেষ ধাপ পরিচিত ‘Integration’ বা ‘সমন্বয়করণ’ নামে। অর্থাৎ এই ধাপে পুরো অবৈধ সম্পদটিকে বৈধভাবে বিনিয়োগ করা হয়। ফলে অবৈধভাবে আয়ের মাধ্যমে অর্জিত টাকাকে শনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে যায়।
যদিও মানি লন্ডারিংকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য তিনটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে, কিন্তু সবসময়ই যে এই তিনধাপেই ব্যাপারটি ঘটে এমন কিন্তু নয়। ইলেক্ট্রনিক মানি, অফশোর ব্যাংকিং, ডার্ক ওয়েবের কারণে মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়াটি আরো জটিল হয়ে উঠেছে।
যেভাবে করা হয়ে থাকে লন্ডারিং
মানি লন্ডারিং করার সবচেয়ে পুরাতন পদ্ধতিটি হলো ‘ক্যাশ স্মাগলিং’ বা অর্থ পাচার। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূলত অন্য পণ্যের আড়ালে অবৈধভাবে টাকা এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাচার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দশ হাজার ডলার আরেক দেশে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সন্ত্রাসী কিংবা মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ চোরাচালানের জন্য বেছে নেয় অন্য যেকোনো পণ্য। আর সেই পণ্যের আড়ালে টাকা পাচার করা হয়। তবে কাস্টমস ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই পদ্ধতি অনেকটাই অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। তবে অন্যান্য পদ্ধতিও আছে। এর মধ্যে একটি হলো ‘ম্যানিপুলেটেড ইনভয়েসিং‘।
ম্যানিপুলেটেড ইনভয়েসিং কী?
আমরা যখন কোনো পণ্য বা সেবা ক্রয় করি তার একটি প্রমাণপত্র আমাদের দেওয়া হয়। এই প্রমাণপত্রে পণ্যটির দাম, ক্রয়ের তারিখ এরকম তথ্যাদির উল্লেখ থাকে। এটিকে বলা হয় ইনভয়েস কিংবা পণ্য ক্রয়ের স্মারক।
ইনভয়েসকে কাটাছেড়া করে মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়াকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়।
- ওভার ইনভয়েসিং
- আন্ডার ইনভয়েসিং
ওভার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে কোনো একটি পণ্যকে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামের ইনভয়েস কিংবা চালানপত্র বানিয়ে অন্য দেশে পণ্য রপ্তানি করা হয়। ফলে আমদানীকারক পণ্যের মূল্য হিসেবে খুব সহজেই বিপুল পরিমাণ অর্থ অন্য দেশে থাকা রপ্তানিকারকের কাছে চোরাচালান করে দিতে পারেন। আর যেকোনো দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য এই প্রক্রিয়াটিকে অনুসরণ করে চোলাচালানকারীকে ধরা কঠিন। পাশাপাশি ভুয়া চালানপত্র তৈরি করে খুবই সাধারণ মালামাল আমদানি-রপ্তানি করার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করে দেয় সন্ত্রাসী চক্র। আর আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করার সাথে সাথে অর্থের উৎস খুঁজে বের করা আরো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।
আন্ডার ইনভয়েসিং এ ঠিক উল্টো কাজটি করা হয়ে থাকে। বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক দামে পণ্য রপ্তানি করে দেওয়া হয়। ফলে পণ্যের বাজারমূল্য বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমদানিকারকের কাছে পৌঁছে যায়। শিল্পকর্ম কিংবা অন্য যেকোনো মূল্যবান সামগ্রী চোরাচালানের জন্য সন্ত্রাসীচক্র এই আন্ডার ইনভয়েসিং ব্যবহার করে থাকে। এতে একদিকে যেমন শুল্ক ফাঁকি দেওয়া যায়, ঠিক তেমনই বিপুল পরিমাণ অর্থ খুব সহজেই পাচার করা যায়।
পাশাপাশি ইনভয়েস ব্যবহার করে নিত্যনতুন আরো নানা ধরনের প্রতারণার উদ্ভব হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যেমন, সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে একই পণ্যের জন্য একাধিক ইনভয়েস বানিয়েও পাচার করা হচ্ছে টাকা।
বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং মানি লন্ডারিং
সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমেও অনেক ধনকুবের তাদের অর্থ পাচার করছেন অন্য দেশে। জাতিসংঘের হিসেবানুযায়ী ২০১৩ সালে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ করা হয়েছে এমন স্থানের তালিকায় প্রথম অবস্থানে ছিল ‘ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ‘। তেইশ হাজার জনসংখ্যার সেই দ্বীপপুঞ্জে বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিলো বিরানব্বই বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থনীতিবিদদের আশংকা অনুযায়ী এই অর্থের বিপুল পরিমাণই মানি লন্ডারিং এর জন্য করা হয়েছে। শুধু ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ নয়, এই তালিকায় আছে এন্ডোরা, ভানুয়াতু, মোনাকো আর ক্যানিম্যান দ্বীপপুঞ্জের মতো দেশগুলো।
বৈদেশিক বিনিয়োগের অন্যতম আরেকটি উপায় হলো বিদেশে সম্পত্তি ক্রয়। এর মাধ্যমে এক দেশে অর্জিত অর্থ সহজেই অন্য দেশে স্থানান্তর করা যায়। ২০১৬ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় একশত বিলিয়ন পাউন্ড সেই বছর লন্ডনে এসেছিলো এই বৈদেশিক সম্পত্তি ক্রয়ের খাতে।
আর এই অর্থের বেশীরভাগই বিভিন্ন দেশ থেকে লন্ডারিং এর মাধ্যমে লন্ডনে এসে পৌঁছেছে। এমনকি নিউ ইয়র্ক, সিঙ্গাপুর, হংকং সহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বিলাসবহুল সম্পত্তি, ফ্ল্যাট কিংবা প্রমোদতরী ক্রয়ের বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে টাকাকে মানি লন্ডারিং এর মাধ্যমে বৈধ করে নিচ্ছেন ধনকুবেররা।
আসছে বিটকয়েন, বাড়ছে লন্ডারিং
বিটকয়েন সহ বিভিন্ন ধনের ডিজিটাল কারেন্সির ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ছে মানি লন্ডারিং। মূলত বিটকয়েন বা এই জাতীয় কারেন্সি ব্যবহার করার জন্য ব্যক্তির পরিচয় দিতে হচ্ছে না। তাই বিটকয়েন সহ ডিজিটাল কারেন্সির ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে মানি লন্ডারিং এর মতো অর্থনৈতিক অপরাধ ধরা কঠিন হয়ে পড়ছে।
কীভাবে ধরা হয় এই অপরাধীদের
শুরুতেই বলা হয়েছে, মানি লন্ডারিং একটি জটিল প্রক্রিয়া। তবে এ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপেই সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা থাকে অপরাধীকে ধরার।
অর্থাৎ একজন ব্যক্তি বা সংগঠন যখন ভুয়া একাউন্ট খুলে টাকা জমা রাখছেন এবং সেই টাকা ক্রমান্বয়ে অন্য একাউন্টে স্থানান্তর করছেন তখন যদি তাকে পাকড়াও না করা যায়, তবে পরবর্তীতে তাকে ধরা কঠিন হয়ে পড়ে। পাশাপাশি মানি লন্ডারিং এর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের ক্ষমতার প্রভাব, ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা, আমদানি-রপ্তানিতে যথাযথ নজরদারীর অভাবের কারণে আসল অপরাধীরা অনেক সময়ই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
ফিচার ইমেজ: andariya.com