বিটকয়েন গত কয়েক বছর ধরে প্রায় সকল স্তরের মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। সাতোশি নাকামতো বলে একজন বিটকয়েন প্রতিষ্ঠা করেন, কিন্তু এই মানুষটিকে কেউ চেহারায় চিনে না। যা-ই হোক, বিটকয়েনের মূল প্রক্রিয়া হচ্ছে এটি একটি ডিজিটাল মুদ্রাব্যবস্থা, যেটা দিয়ে পিয়ার টু পিয়ার অর্থাৎ লেনদেন করবে যারা, শুধু তারাই এই আদান প্রদান সম্পর্কে জানবে। তৃতীয় কোনো মাধ্যম এখানে কাজ করবে না। তৃতীয় মাধ্যম বলতে ব্যাংক কিংবা অন্য কোনো স্বীকৃত ব্যক্তিকে বোঝায়। এগুলোর হিসাব যে একেবারেই রাখা যাবে না তা নয়। ব্লকচেইন বলে একটি মাধ্যম আছে যেটা বিটকয়েনের ক্ষেত্রে লেজার বুক হিসেবে কাজ করে। তবে এটাতে প্রয়োজন মতো প্রাইভেসি দেয়া যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যেহেতু ব্যাংক ছাড়াই এখন অর্থের আদান প্রদান করা যাচ্ছে, তাহলে কি একটা সময়ে ব্যাংক বলে কিছু থাকবে না? একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই দেশের সকল অর্থ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে বিটকয়েন সাফল্যের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও কি প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে?
এটা অত্যন্ত জটিল একটি প্রশ্ন, কারণ একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবদান অসীম। বিভিন্ন অর্থ ব্যবস্থা কেলেঙ্কারি কিংবা বাজারের টালমাটাল অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিচক্ষণতার সাথে কাজ করতে হয়। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পুরো অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করে যেকোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হয় যা সমাজের সকল মানুষের উপর প্রভাব ফেলবে।
বিটকয়েনের ব্যাপারে আসার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্পর্কে কিছু বলে নেয়া দরকার। যেমন- কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনোপলি অর্থাৎ মুদ্রাব্যবস্থায় একাধিকার ভাবে চালিত হয়। একটি দেশের কিংবা পুরো বিশ্বের আর্থিক সংকটকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই সমস্যা দূর করার জন্য একটি দৃঢ় অবস্থান নিতে হয়। ২০০৭ সালে যে বিশ্বমন্দা দেখা দিয়েছিলো সেটা কাটিয়ে উঠতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর অনেকগুলো কাজের মধ্যে প্রধান প্রধান কাজ হচ্ছে চাকরীর বাজার ব্যবস্থা ঠিকভাবে বজায় রাখা, জিনিসপত্রের দাম সুস্থিত রাখা, একটি দেশের ব্যাংকিং এবং আর্থিক সমষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক মন্দাকালে দেশের ভিতরের অর্থনৈতিক অবস্থা সুদৃঢ় রাখা, দেশের মুদ্রা আদান-প্রদান তত্ত্বাবধান করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই কাজগুলো করে মুদ্রানিয়ন্ত্রণ নীতির মাধ্যমে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের এসব কাজ করার জন্য সুদের হার বাড়াতে বা কমাতে পারে, টাকা তৈরি করতে পারে বা কমিয়ে আনতে পারে। এর মানে হচ্ছে- যদি একটি দেশের অর্থনীতি দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে তাহলে জিনিসপত্রের এবং বিভিন্ন সেবার দাম একই হারে বাড়তে থাকবে। এর ফলে সাধারণ মানুষ সেই দ্রব্য কিংবা সেবাগুলো নিতে পারবে না। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়িয়ে দিবে। এতে যারা ঋণ নিয়ে ব্যবসার কাজে লাগাতে চায় তাদের জন্য সমস্যা হয়ে যাবে, কারণ চড়া সুদে তাদের ঋণ নিতে হবে, আবার তা ফিরিয়ে দিতে হবে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংকগুলোতে টাকা দেয়া বন্ধ করে দিতে পারে। এতে ওসব ব্যাংক থেকেও ঋণ নিতে গেলে চড়া সুদের সামনে পড়তে হবে। এমনটি করলেও আবার সমস্যা হবে- তাত্ত্বিকভাবে দ্রব্যের দাম কমে যাবে। অর্থাৎ অর্থের কাটতি যদি কমে যায় তাহলে দ্রব্যের দাম কমে যাবে এবং চড়া সুদের কারণে ব্যবসায় মন্দা দেখা দিবে। তখন ব্যবসায়ীরা অন্যান্য জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারবে না এবং বিনিয়োগ না করতে পারলে লাভ হওয়ার আশা কম আর তখনই চাকরির বাজারে সংকট দেখা দিবে।
আবার অর্থনীতি যদি ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকে তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমাতে পারে অথবা টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে। সুদ কমানোর ফলে দ্রব্যের দাম কম হবে এবং অন্যদিকে ব্যবসায়ীরাও বিভিন্ন কাজে ঋণ নিতে দ্বিধাবোধ করবে না। অন্যান্য ব্যাংকগুলোকে ধার দেয়ার পরিমাণও বাড়াতে পারবে।
অস্ট্রিয়ান স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়, যেখানে দাবি করা হয় যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজগুলো অনেকগুলো জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নাকি নিজেদের মত বজায় রাখে এবং নিজেদের সুবিধামতো কাজ করে। তাদের মতে বিটকয়েন বাস্তবায়িত করলে এতসব ঝামেলার ভিতর দিয়ে যেতে হবে না এবং এমনটি করলে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও দরকার পড়বে না।
অনেকের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অর্থনৈতিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হয়। শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ নিয়ে একটি বিতর্ক ছিল। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনোপলি শক্তির অধিকারী হয়ে থাকে, এটি একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান এবং তারা দেশের অর্থনৈতিক নীতি এবং ব্যবস্থাকে নিজেদের মতো করে সাজাতে পারে। এই বিষয়গুলো অনেকে সঠিক দৃষ্টিতে দেখে না বিধায় তাদের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর গুরুত্ব কম। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ এবং রাজনীতিবিদের মতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাঝে মাঝে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নেয় যেটা ব্যাখ্যা করা জটিল হয়ে পড়ে। ভুল বলতে বোঝায় যে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়া বা কমিয়ে দেয়া, আবার যখন তখন সুদের হার বাড়িয়ে দেয়া বা কমিয়ে দেয়া ইত্যাদি। এটা অনেকের কাছে অস্পষ্ট মনে হয় যে, যদি মুদ্রাস্ফীতি কমালে দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে যায় কিংবা মুদ্রাস্ফীতি বাড়ালে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গিয়ে মানুষের ক্রয়ের ক্ষমতার বাইরে চলে যায় তাহলে এরকম সিদ্ধান্ত নেয়ার মানে কী? এরকম কিছু সিদ্ধান্ত এবং নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী কাজ করার জন্য ১৯২৯ সালের Great Depression হয়েছিলো- এমনটাই মত দিয়েছেন ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক চেয়ারম্যান বেন বারনাঙ্কে।
এসব কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ এবং নেতারা বিটকয়েনকে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে অবলম্বন করার পক্ষে মতামত দিচ্ছেন। তাদের যুক্তি এই যে, প্রযুক্তির যুগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো দরকার নেই। তাদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোতে দুর্নীতি হয় এবং এই দুর্নীতির জন্য ক্ষতি হয় সাধারণ জনগণের। গ্রিসে ব্যাংকারদের কারণে তাদের অর্থনীতিতে একটি উদ্বেগের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো। ব্যাংকারদের নিয়ে এমনও কিছু ক্ষোভ শুনতে পাওয়া যায় যে ব্যাংক এবং গ্রাহকদের মাঝে থেকে তারা নিজেরা কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে পার পেয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় বিটকয়েন দিয়ে যদি শুধু এক ব্যক্তির সাথে আরেক ব্যক্তির মধ্যেই লেনদেন হয় এবং যদি এই প্রক্রিয়া ঝামেলা মুক্ত হয় তাহলে এটা বাস্তবায়ন করা উচিত। আবার যুগের সাথে তাল মেলানোর জন্য এবং অন্য দেশের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য হলেও বিটকয়েন যেকোনো দেশে অনুমোদন করা উচিত।
তবে সব জায়গায় আবেগ-অনুভূতি দিয়ে বিচার করলে হয় না। বিটকয়েনের মাধ্যমে লেনদেনের প্রক্রিয়া খুব সহজ হলেও দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে, ট্যাক্স বা করের বিষয়ে খুব সহজেই রেহাই পেয়ে যাবে অনেকেই, আবার দেশের উন্নতির কাজে যে খরচ করা হয় সেগুলো ঠিক ঠিকভাবে বণ্টন করা এবং ঠিক সময়ে সেই অর্থ ফেরত নেয়া, লাভ কেমন হবে, লোকসান কেমন হবে এগুলো বিচার বিবেচনা করা কঠিন হয়ে পড়বে। এসব কাজ কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো খুব ভালোভাবেই করছে। এছাড়া বিটকয়েনের দামের একটা ব্যাপার আছে। সাধারণ মানুষ কীভাবে এত দাম দিয়ে বিটকয়েন কিনবে? অন্যদিকে ব্যাংকে ভুলবশত কোনো লেনদেন হলে সুযোগ থাকে সেটা শুধরে নেয়ার। কিন্তু বিটকয়েনের লেনদেনে সেই সুযোগ নেই। এছাড়া যদি বিটকয়েন অনুমোদন করাও হয় সেটার জন্য যে পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন সেটার জন্যও একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অনেক নীতিগত কাঠামোর পরিবর্তন প্রয়োজন। তাই বিটকয়েন দিয়ে লেনদেনের অনুমোদন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে করা ঠিক হবে কিনা এটা একটা প্রশ্ন। তবে বিটকয়েন বিষয়ে যে সিদ্ধান্তই হোক না কেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধান বা হস্তক্ষেপ থাকলে সেখানে একটি শৃঙ্খলা এবং নিয়মানুবর্তিতা বজায় থাকবে।
ফিচার ইমেজ: protelcom.net