আত্মা সম্পর্কে নানারকম বিশ্বাস প্রচলিত আছে। ধর্ম, দর্শন কিংবা পুরাণে আত্মার ধারণাটি এসেছে বেশ কয়েকভাবে। প্রচলিত বিশ্বাস হলো, কোনো কিছুর মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করার জন্য নিরাবয়ব কোনো সত্ত্বার প্রয়োজন হয় এবং সেটিই হলো আত্মা। আমাদের সকল আবেগ, অনুভূতি, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, স্মৃতি, চিন্তাভাবনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে এই নিরাবয়ব সত্ত্বা।
১৯০১ সালের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস হেভারহিলের একটি নার্সিং হোমে ম্যাকডোগাল ডানকান নামের এক ডাক্তার ছিলেন। ডাক্তার হলেও অতিপ্রাকৃত ব্যাপার নিয়ে তার বেশ আগ্রহ ছিলো। বলা হয়ে থাকে, জীবনের অনেকটা সময় তিনি মৃত্যু নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়েছেন। এছাড়া ধর্মবিশ্বাসী মানুষ হওয়ায় তিনি আত্মায় বিশ্বাস করতেন।
ম্যাকডোগাল মনে করতেন মানুষের শরীরে আত্মা একটি নির্দিষ্ট জায়গা দখল করে। আত্মার জন্য এরকম প্রকল্পিত জায়গা কেন দরকার তার বিশদ ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন তিনি। যেহেতু আত্মা একটি নির্দিষ্ট জায়গা জুড়ে থাকে সেহেতু তার নির্দিষ্ট ভর কিংবা ওজন থাকতে পারে।
তিনি চিন্তা করতে লাগলেন কিভাবে সেই ভরটুকু বের করা যায়। একজন জীবিত এবং মৃত মানুষে তফাৎ কেবল আত্মায়। জীবিত মানুষের আত্মা থাকে কিন্তু মৃত মানুষের থাকে না। মৃত্যুর পরে নশ্বর দেহ বিলীন হয়ে গেলেও আত্মা টিকে থাকে। তার মনে হলো একজন মানুষ যখন মারা যাবে অর্থাৎ তার আত্মা দেহত্যাগ করবে তখন সে কিছু ওজন হারাবে। এই ধারণার উপর ভিত্তি করেই তিনি একটি এক্সপেরিমেন্ট করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
ম্যাকডোগাল যে নার্সিং হোমটিতে ছিলেন সেখানে সংকটাপন্ন অবস্থায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীদেরকে রাখা হতো। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল যক্ষ্মা রোগী। সেই সময়ে কোনো কার্যকর চিকিৎসা না থাকায় তাদেরকে এমনভাবে রাখা হতো যাতে তারা সুস্থ মানুষের সংস্পর্শে না আসে। এই রোগীদের মধ্য থেকে মৃত্যুপথযাত্রী ৬ জনকে তিনি বেছে নিলেন তার পরীক্ষাটি করার জন্য। এদের মধ্যে ৪ জন ছিল যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত, একজন ভুগছিল ডায়াবেটিসে এবং আরেকজন কোন রোগে আক্রান্ত তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ম্যাকডোগাল শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হওয়া রোগীদেরকে বাছাই করেছিলেন, অন্যথায় মারা যাওয়ার মুহূর্তে তাদের নড়াচড়া ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।
ওই বছরের ১০ এপ্রিল বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ম্যাকডোগাল প্রথমবারের মতো মৃতপ্রায় একজন যক্ষ্মা রোগীকে তার এক্সপেরিমেন্টের জন্য নিয়ে আসেন। উদ্দেশ্য ছিলো মৃত্যুর পূর্ব ও পরমুহূর্তে রোগীর ওজনের তারতম্য থেকে আত্মার ওজন বের করা। এ সময় তার সহযোগী ছিলেন জন স্প্রাউল নামক আরেকজন ডাক্তার। ওজন মাপার জন্য রোগীটির সম্পূর্ণ বিছানা জুড়ে ওজন পরিমাপক যন্ত্র কিংবা দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা হলো। তখনকার প্রযুক্তি বিবেচনা করলে ওই যন্ত্রটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ছিল, যা এক আউন্সের দুই দশমাংশ (৫.৬ গ্রাম) পর্যন্ত ভরের তারতম্যকে হিসাব করতে পারতো। এছাড়া রোগীর আত্মীয়স্বজন বা অন্য কোনো জায়গা থেকে যাতে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা তৈরী না হয় সেদিকেও কড়া নজর রাখা হলো। অবশ্য ম্যাকডোগাল দাবি করেছিলেন, রোগীর কোনো ধরনের সমস্যা হতে পারে এরকম কোনো কাজ তার দল করেনি।
তিন ঘন্টা চল্লিশ মিনিট ধরে ওই রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হলো। এই সময়টুকুতে তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। শ্বসনের ফলে দেহের আর্দ্রতা কমে যাওয়া এবং ঘাম বাষ্পীভূত হয়ে যাওয়ার কারণে জীবিত থাকা অবস্থায় রোগীটি প্রতি ঘন্টায় ধীরে ধীরে এক আউন্স করে ওজন হারাতে থাকে। ওজন কমে যাওয়ার পরও ম্যাকডোগাল এবং তার দল পুরো সময় জুড়ে পরিমাপক যন্ত্রটির ভারসাম্য বজায় রেখেছিলেন। এরপর রাত ৯টার দিকে লোকটি যখন মারা যায় তখন একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটলো। ডানকানের ভাষ্যমতে,
ওজন পরিমাপক যন্ত্রটির কাঁটা ভারসাম্য অবস্থা থেকে সশব্দে একটু নিচে নেমে গেলো অর্থাৎ রোগীর দেহ কিছু ওজন হারিয়েছে! আমি হিসেব করে দেখলাম ওজন হ্রাসের পরিমাণ এক আউন্সের তিন-চতুর্থাংশ কিংবা ২১.৩ গ্রাম প্রায়। দেহের আর্দ্রতা কমে যাওয়া কিংবা ঘাম শুকানোর কারণে সেকেন্ডের ব্যবধানে ওজনের এই হ্রাস সম্ভব নয়। এর আগে আমরা দেখেছি প্রতি ঘন্টায় রোগীটি মাত্র এক আউন্স করে ওজন হারিয়েছিলো। যদিও মৃত্যুর পর রোগীর দেহ থেকে মূত্র নির্গত হয়েছিলো, কিন্তু বিছানা থেকে তা বাষ্পীভূত হয়ে যাবার আগেই ওজনের এই হ্রাস সংঘটিত হয়।
শেষ সম্ভাব্য যে ব্যাপারটি ওজন কমে যাওয়ার জন্য দায়ী হতে পারে তা হলো শ্বাস-প্রশ্বাসের কারণে ফুসফুস থেকে বাতাস বেরিয়ে যাওয়া। কিন্তু পরীক্ষণটি করার আগে আমি বিছানার উপর শুয়ে গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েও পরিমাপক যন্ত্রটিতে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করিনি। এ থেকে যা বোঝা যায় তা হলো ফুসফুস থেকে বাতাস বেরিয়ে যাওয়ার কারণে রোগীর ওজন কমেনি, বরং অন্য কিছু একটা তার দেহ ত্যাগ করেছে। আমি মনে করি সেই কিছু একটা হলো তার আত্মা।
প্রথম রোগীকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার পরই ডানকানের মনে হতে লাগলো তিনি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের দোড়গোড়ায় পৌঁছে গেছেন। ওই বছরের বিভিন্ন সময়ে তিনি আরও পাঁচজন রোগীকে নিয়ে তার এই এক্সপেরিমেন্টটি করেন। দ্বিতীয় রোগীও ছিলো যক্ষ্মায় আক্রান্ত এবং তাকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রায় পাঁচ ঘন্টা ১৫ মিনিট পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিলো। মৃত্যুর সাথে সাথে শুরুতে ওই রোগী ১৪ গ্রামের মতো ওজন হারায়। এরপর আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা গেলো রোগীটি আরও ২৮ গ্রামের মতো ওজন হারিয়েছে। তৃতীয় রোগীর ক্ষেত্রেও মারা যাওয়ার এক মিনিট পর মোটামুটি একই ধরনের ফলাফল পাওয়া গেলো।
চতুর্থ এক্সপেরিমেন্টের সময় ওজন পরিমাপক যন্ত্রটি ঠিকমতো বসানো হয়নি, যে কারণে ম্যাকডোগাল ওই ফলাফল বাতিল করে দেন। পঞ্চম এক্সপেরিমেন্টের ক্ষেত্রে রোগী মারা যাওয়ার মুহূর্তে ধীরে ধীরে ওজন কমতে থাকে, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এরপর ধীরে ধীরে মৃতদেহের ওজন বাড়তে থাকে এরপর আবার ওজন কমে ১৫ মিনিট পর পরিমাপক যন্ত্রের কাঁটা স্থির হয়। দেখা যায় রোগীর দেহ মোট ১০ গ্রামের মতো ওজন হারিয়েছে। ষষ্ঠ রোগী বিছানায় নেয়ার মাত্র পাঁচ মিনিট পর মারা যায়, যে কারণে কোনো ধরনের ফলাফল পাওয়া সম্ভব হয়নি। এভাবে মাত্র ৬ জন রোগী নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার পর ম্যাকডোগাল এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, মানুষের আত্মার ভর ২১ গ্রাম! যা তার প্রথম এক্সপেরিমেন্টে পাওয়া ফলাফলের কাছাকাছি। অবশ্য ম্যাকডোগাল স্বীকার করেছিলেন, সঠিক ফলাফল পাওয়ার জন্য এই এক্সপেরিমেন্টটি আরও কয়েকবার করে দেখতে হবে।
নিজ ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে ডানকানের ধারণা ছিলো কুকুরের কোনো আত্মা নেই। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি ১৫টি কুকুরের উপর একই এক্সপেরিমেন্ট চালালেন। কিন্তু ১৫ টি মৃতপ্রায় কিংবা অসুস্থ কুকুর তিনি স্বাভাবিকভাবেই খুঁজে পাননি। ধারণা করা হয়, এই কাজের জন্য স্বাস্থ্যবান কুকুরগুলোকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত করা হয়েছিলো। এজন্য পরবর্তীতে অনেকে তার সমালোচনা করেছেন।
পরীক্ষণে দেখা গেলো, মারা যাওয়ার পর কুকুরগুলোর ওজনের কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি হয়নি। এ থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, কুকুরের কোনো আত্মা নেই!
১৯০১-০৭ সাল পর্যন্ত ম্যাকডোগাল তার গবেষণার ফলাফলকে কোথাও প্রকাশ করেননি। এরপর ১৯০৭ সালের মার্চ মাসের ১১ তারিখে নিউ ইয়র্ক টাইমসে তার ওই গবেষণাটি নিয়ে একটি খবর ছাপা হয়। খবরের শিরোনাম ছিল এরকম, “চিকিৎসক মনে করেন, আত্মার ওজন আছে”। এরপর তার এই গবেষণা একই বছরের এপ্রিলে জার্নাল অব দ্য আমেরিকান সোসাইটি ফর ফিজিক্যাল রিসার্চ এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত জার্নাল আমেরিকান মেডিসিনে প্রকাশিত হয়।
আমেরিকান মেডিসিনের মতো একটি নির্ভরযোগ্য জার্নালে পরীক্ষণটি প্রকাশ পাওয়ার পর এই গবেষণা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। ম্যাকডোগালের গবেষণার পদ্ধতিটিকে অবৈজ্ঞানিক, ত্রুটিযুক্ত এবং তার ফলাফলটিকে সুষ্পষ্টভাবে ধোঁকাবাজি বলে উল্লেখ করা হয়। প্রথমে চিকিৎসক অগাস্টাস পি. ক্লার্ক এই গবেষণার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং গবেষণার সময় মৃতদেহের ভর ২১ গ্রাম কী করে কমলো তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। মৃত্যুর পরপরই ফুসফুস রক্তকে শীতল করা বন্ধ করে দেয়। ফলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এর পরপরই শরীর থেকে ঘাম নিঃসরণ হয়। মৃতের শরীর থেকে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে পানি বের হয়ে যাওয়ার কারণেই ভর কমে যায়। কিন্তু কুকুরের কোনো ঘর্ম গ্রন্থি নেই, তাই মৃত্যুর পর তাদের ভর কমে যায় না।
গবেষণায় অল্প নমুনা নেওয়ার সমালোচনা করা হয় এবং বলা হয়ে থাকে, ছয়জন রোগীর মধ্যে শুধুমাত্র একজনের জন্যই ম্যাকডোগালের হাইপোথিসিস প্রযোজ্য। এছাড়া ১৯০১ সালের প্রযুক্তির সাহায্যে কীভাবে ম্যাকডোগাল একজন মানুষের মৃত্যুর তাৎক্ষণিক মুহূর্তকে বুঝতে সক্ষম হলেন? অনেকেই মনে করেন ম্যাকডোগাল যেভাবে আত্মার ওজন বের করেছেন তার জন্য তাকে কৃতিত্ব দান করা তো দূরের কথা, তার এই গবেষণায় যে কিছু প্রমাণ হয়েছে সেটিও মনে করা উচিত না। ১৯০১ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত এই এক্সপেরিমেন্টের কোনোরকম পুনরাবৃত্তি করা হয়নি। কেন হয়নি তার অনেক কারণ আছে অবশ্য।
তাহলে, বিজ্ঞান কি বলে আত্মা সম্পর্কে? বিজ্ঞান কিছুই বলে না, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু, ১০০ বছরেরও বেশি সময় পূর্বে ম্যাকডোগাল নামক একজন ডাক্তার অদ্ভুত একটি গবেষণার মাধ্যমে এভাবে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন মানবদেহে আত্মার অস্তিত্ব। গবেষণাটি অত্যন্ত ত্রুটিযুক্ত হলেও তার সেই গবেষণার প্রভাব এখনও পর্যন্ত বিদ্যমান। আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে কথা বলতে গেলে তার গবেষণার ফলাফলের কথা অনেককেই উল্লেখ করতে দেখা যায়।
অনেকেই এখনো বিশ্বাস করেন, আত্মার ভর নাকি ২১ গ্রাম! ২০০৩ সালে হলিউডে ২১ গ্রাম নামে একটি সিনেমা মুক্তি পায়, যেখানে এই গবেষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সিনেমাটি অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এর সাথে ম্যাকডোগালের ওই গবেষণাটিকেও জনপ্রিয় করে তোলে। ওই সিনেমার শেষ সংলাপগুলো এরকম,
কতগুলো জীবন আমরা পাই? কতবার আমরা মারা যাই?
তারা বলে, যখন আমরা মারা যাই, তখন ঠিক ২১ গ্রাম হারাই।
কী থাকে ওই ২১ গ্রামের মধ্যে? কী হারাই আমরা? কিংবা কী অর্জন করি?
২১ গ্রাম। পাঁচটি নিকেলের ওজন। একটি হামিং বার্ডের ওজন। কিংবা একটি চকলেট বারের ওজন।
কী থাকে ওই ২১ গ্রামের মধ্যে?
– ২১ গ্রাম (২০০৩)
ফিচার ইমেজ- deviantart.com