ফল খেলে শরীর ভালো থাকে, ফলে অনেক ভিটামিন, অসুস্থ হলে ফল খেতে হয়- কথাগুলো খুব পরিচিত লাগছে না? কেবল আপনিই নন, ফল নিয়ে এই কথাগুলো আমাদের সবাইকেই কমবেশি শুনতে হয়েছে। অবশ্য, ফল জিনিসটাই এত স্বাস্থ্যকর আর সুস্বাদু যে, একে নিয়ে এমন না বলাটাই অস্বাভাবিক। উৎসব, সাধারণ সময়, মেহমানদারী, পূজা, বিয়ে- সবখানে ফলের উপস্থিতি থাকবেই। চলুন, আজ এসব নয়, বরং অন্য কিছু নিয়ে কথা বলি!
ফলে ভিটামিন আছে, খনিজ আছে- আরো কত কী! তবে আপনার খুব পরিচিত ফলগুলোর যে কিছু মজার মজার ইতিহাসও রয়েছে সেটা কি জানেন? আজ চলুন ফল নয়, বরং ফলের সেই মজার আর অন্যরকম গল্পগুলো দিয়েই উদরপূর্তি করা যাক।
কিউই- তোমার নাম কী?
কিউই ফলের নাম আসলেই মনে পড়ে যায় নিউজিল্যান্ডের কথা। কিউই নামের এক প্রকার পাখি প্রচুর পরিমাণে দেখা যায় নিউজিল্যান্ডের আকাশে। আর সেই পাখির গায়ের সাথে ফলের অনেকটা মিল আছে বলেই এমন নামকরণ হয়েছে ফলটির। ব্যস! এটুকু আমাদের সবার জানা। কিন্তু কিউই ফলের ইতিহাসটা আরো অনেক বড়। কত শত হাতই না ঘুরতে হয়েছে তাকে!
যাত্রা শুরু হয় চীন থেকে। সেখানে ‘ম্যাকাউ পিচ’ নামে পরিচিত ফলটি বানরের খুব পছন্দের ফল ছিলো। পরবর্তীতে, ইংলিশরা এর নাম দেয় ‘চাইনিজ গুজবেরি’। কারণ? কারও জানা নেই! বিংশ শতাব্দীতে নিউজিল্যান্ডের এক কলেজ প্রধান চীন থেকে ফলের কিছু বীজ নিয়ে আসেন। ‘চাইনিজ গুজবেরি’ চলে আসে নিউজিল্যান্ডে। একটা সময় ফলটি রপ্তানি করা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেসময় এর নাম বদলে ‘মেলোনেট’ রাখা হয়। নামটা অবশ্য ধোপে টেকেনি বেশিদিন। পরে নিজেদের দেশের পাখির সাথে মিলিয়ে ফলের নাম রাখা হয়- ‘কিউই’। আর এখন? নিউজিল্যান্ডের বাৎসরিক প্রায় কয়েক কোটি টাকা আনতে সাহায্য করে কিউই ফল!
আনারস নিয়ে কাড়াকাড়ি
আনারস নিয়ে মানুষের ভালোলাগার শুরুটা অনেক আগের। মিষ্টি স্বাদের এই ফলটিকে সব অনুষ্ঠান আর উৎসবেই রাখা হয়ে সবসময়। তবে ইউরোপিয়ানদের হাতে আনারস আসে কলম্বাসের মাধ্যমে। নিজের দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রায় আনারস খুঁজে পান তিনি। বেশ প্রাচীন আর আদিম এক গোত্রের মৃত কিছু মানুষের পাশে পড়ে ছিলো ফলটি। তবে সেসময় মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য খুব একটা সহজপ্রাপ্য না হওয়ায় আনারসকে রাজকীয় খাবার হিসেবেই ব্যবহার করা হতো।
আমেরিকায় আনারস দিয়ে টেবিল সাজানোর ব্যাপারটা তো ছিলো রীতিমতো সৌভাগ্যের বিষয়। খাবার টেবিলে আনারস নারীদের কাছে অসম্ভব আরাধ্য একটি দ্রব্য ছিলো। এত বেশি দুষ্প্রাপ্য ছিলো ফলটি যে, একটা সময় আমেরিকায় ভাড়া দেওয়া হতো আনারস! সম্মানের বিষয় হওয়ায় নিজের অনুষ্ঠানে ভাড়া করে আনারস নিয়ে, সেটিকে দেখিয়ে, প্রশংসা কুড়িয়ে তারপর আবার ফিরিয়ে দেওয়া- রেওয়াজটা বেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিলো সেসময়।
টমেটো নয়, বিষ!
হাস্যকর শোনালেও সত্যি যে, প্রায় দুই শতক ধরে টমেটোকে বিষাক্ত বলেই ভেবে এসেছিলো ইউরোপিয়ানরা। এতে অবশ্য তাদের খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। চমৎকার রঙ, বিষাক্ত ফলের সাথে বংশগত যোগাযোগ আর দুয়েকটা বিচ্ছিন্ন মৃত্যুর ঘটনা- এ সবকিছু মিলেই তৈরি হয়েছিলো টমেটো সংক্রান্ত ভয়। তবে আমেরিকায় মোটেও এই ভীতি ছিলো না। প্রত্যন্ত কিছু গ্রাম বাদে সবাই খাবারে টমেটো ব্যবহার করতো। টমেটোর প্রথম আর প্রধান পরিচিতিটা হয় গৃহযুদ্ধের সময়।
টমেটো খেতে সুস্বাদু এবং সেইসাথে একে জমিয়ে সংরক্ষণ করে রাখাটাও বেশ সহজ হওয়ায় যুদ্ধের সময় টমেটোর ব্যবহার বেড়ে যায়। যুদ্ধে অংশ নেয়া সৈনিকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে টমেটো। আর শেষমেশ, ১৮৮০ সালে ইতালিয়ানদের পিজ্জার মধ্য দিয়ে ইউরোপেও প্রবেশ করার সুযোগ পায় টমেটো।
আপেল- সে অনেক আগের কথা!
আপেল নিয়ে গল্পের শুরুটা আজকে নয়। নানারকম পৌরাণিক কাহিনী আর ধর্মীয় লিখিত স্থানে আপেলের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সেগুলোর কোনটাই বর্তমান আপেলের গল্প নয়। আমেরিকায় নতুন মানুষগুলোকে স্বাগতম জানাতে জনি অ্যাপলসিড প্রচুর পরিমাণ আপেলের গাছ লাগায়। তবে তাতে করে খুব একটা লাভ হয়নি। আপেল খেতে কেউই বিশেষ পছন্দ করতো না সেসময়।
কারণটা ছিলো আপেলের সহজলভ্যতা আর তিক্ততা। ঠিক পড়েছেন! আজকের আপেলের মতন এত ভালো আর সুস্বাদু তখন ছিলো না তখনকার আপেলগুলো। সেগুলোর বেশিরভাগ প্রজাতিই ছিলো স্বাদে তেতো এবং আকারে ছোট। পরবর্তীতে অনেক চেষ্টায় আপেলের মান বাড়ানো হয়। তবে খাওয়ার চাইতে বেশি ব্যবহার করা শুরু হয় অ্যাপল সাইডার হিসেবে।
রাজকীয় খাবার স্ট্রবেরি
আজকে আমরা পথেঘাটে স্ট্রবেরি পড়ে থাকতে দেখি। স্ট্রবেরি, স্ট্রবেরি ভর্তা- সবকিছুই অনেক সহজলভ্য। ভালো লাগছে? কিনে ফেলুন। ভালো লাগছে না? তাহলে ফেলে দিন! একটা সময় কিন্তু ব্যাপারটা এতো সহজ ছিলো না। সেসময় স্ট্রবেরি ছিলো রাজকীয় খাবার।
স্ট্রবেরির জন্মস্থান একইসাথে ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকা। অবশ্য সেসময়ের স্ট্রবেরি কিন্তু ঠিক আজকের মতন ছিলো না। না এতো রসালো, না এতো বড়। সান কিংয়ের পরিকল্পনানুসারে রাজকীয় হস্তক্ষেপেই তৈরি হয় বর্তমান স্ট্রবেরির ইতিহাস। এরপর অবশ্য ফলটি ভ্রমণ করে অনেকটা পথ। ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই ফ্রেজিয়ার নামে এক গুপ্তচরকে পাঠান চিলি আর পেরুর দুর্গ থেকে খবরাখবর নিতে। তার ইচ্ছে ছিলো স্পেনের সিংহাসন দখল করার। তবে ফ্রেজিয়ার কেবল খবরাখবরই নয়, সাথে করে কিছু স্ট্রবেরিও এনেছিলো সেবার। চিলিয়ান সেই স্ট্রবেরি অবশ্য এতো সহজে জন্ম নেয়নি ফ্রান্সে। আর তারপর? নতুন, পুরনো সবরকমের স্ট্রবেরি মিশে সুস্বাদু আর চমৎকার স্ট্রবেরির জন্ম দিলো। কেমন সেই স্ট্রবেরিগুলো? সে তো আপনার জানাই আছে!
কুসংস্কার ভর্তি অ্যাভাকোডা
জনপ্রিয়তা তো দূরের কথা, নিজের অস্তিত্ব নিয়েই বেশ সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলো অ্যাভাকোডা। বরফ যুগের পরের কথা। এর আগে নিজের বংশবৃদ্ধির জন্য অতিকায় প্রাণীদের উপরে নির্ভরশীল ছিলো ফলটি। বিশাল আকারের হওয়ায় আর দশটা ফলের মতন পাখিরা এদের বীজ বা আঁটিকে বয়ে নিতে পারেনি। আর তাই বরফযুগ শেষ হওয়ার সাথে সাথে নির্বংশ হওয়ার দশা হয় এটির।
অ্যাভাকোডাকে বাঁচাতে তখন এগিয়ে আসে মানুষ। মধ্য আমেরিকায় সফলভাবে উৎপন্ন হয় অ্যাভাকোডা। ফলের ব্যবহারও শুরু হয় তখন থেকে। মজার ব্যাপার হলো, সেসময় অ্যাভাকোডাকে গর্ভধারণে সহায়ক বলে মনে করা হতো। আর তাই, কৃষকেরা মাঠে অ্যাভাকোডার চাষ করার সময় কুমারী মেয়েদের ঘরের ভেতরে থাকতে বলা হতো। কে জানে যদি সত্যি সত্যি সন্তানধারণ করে ফেলে তারা!
চীনা আপেলের নতুন রূপ
কমলা ফল হিসেবে খুব যে জনপ্রিয় ছিলো, তা কিন্তু না। মনে করা হয় ভারত কিংবা চীনে প্রথম জন্ম নেয় এই কমলা গাছ। তখন অবশ্য একে কেউ ‘কমলা’ বলে ডাকতো না। আপেলের সাথে সাদৃশ্য থাকায় ‘চাইনিজ আপেল”’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলো কমলা। এমনকি খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ অব্দের লেখনীতেও কমলার উল্লেখ পাওয়া যায়। নিজের দ্বিতীয় সমুদ্র যাত্রায় কেবল আনারস নয়, কমলাকেও বগলদাবা করে নিয়ে গিয়েছিলেন কলম্বাস। সেখানে এর গাছ সবচাইতে প্রথমে রোপন করেন বলেই ধারণা করা হয়। তারপর আস্তে আস্তে পৃথিবীর সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে কমলা!