পিসিতে গেম খেলেন আর অ্যাসাসিন্স ক্রিডের কথা জানেন না, এমন গেমার খুঁজে পাওয়া যাবে না এটা নিশ্চিত। প্রচণ্ড ব্যবসাসফল এই সিরিজের জনপ্রিয় চরিত্রগুলোর কথা কি ভোলা যায়? চলুন না আরেকবার ঘুরে আসি এই গেমের জগত থেকে?
অ্যাসাসিন্স ক্রিডের জন্ম ফরাসি ভিডিও গেম পাবলিশার ইউবিসফটের হাত ধরে। একই কোম্পানি থেকে বেরিয়েছে ফার ক্রাই, জাস্ট ড্যান্স, প্রিন্স অফ পার্সিয়ার মতো জনপ্রিয় গেমগুলো। তবে সেগুলো নিয়ে কথা হবে অন্য কোনো দিন, আজ কেবল অ্যাসাসিন্স ক্রিডের গল্প।
মূল ঘটনা কী?
গেমের পটভূমি হলো অনেকটা এরকম। দুটো গুপ্ত সংঘ লড়ছে ন্যায়-অন্যায়ের লড়াই। একদিকে গুপ্তঘাতক অর্থাৎ অ্যাসাসিনরা। আরেকদিকে টেম্পলাররা। দুটো সংঘই সত্যি সত্যিই ছিল পৃথিবীতে, সেটা ইতিহাস স্বীকার করে। কিন্তু এই গেম সিরিজে ছায়াগল্প বানিয়ে নেয়া হয়েছে নাটকীয়তা আনবার জন্য। অ্যাসাসিনরা লড়ে আসছে যুগে যুগে শান্তি আর স্বাধীনচেতা হবার জন্য, ফ্রি উইলের জন্য। আর ওদিকে টেম্পলাররা বিশ্বাস করে, যথাযথ নিয়ন্ত্রণই পারে মানবজাতির শান্তি আনতে। এই নিয়ে সহস্র বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে যুদ্ধ। এই যোদ্ধাদেরই কোনো না কোনো বংশধরের ডিএনএতে থেকে যাওয়া জেনেটিক স্মৃতিগুলো দিয়ে ভ্রমণ করা যায় অ্যানিমাস নামক যন্ত্রের ভার্চুয়াল সিমুলেশনের মাধ্যমে। আর এই যন্ত্র চালায় অ্যাবস্টার্গো ইন্ডাস্ট্রিজ, যা কিনা নাইট টেম্পলারদেরই আধুনিক মুখোশ। তাদের উদ্দেশ্য পুরোনো স্মৃতিগুলো ঘেঁটে ‘পিস অফ ইডেন’গুলো বের করা, যেগুলো অসীম ক্ষমতার অধিকারী কিছু ঐতিহাসিক বস্তু। এগুলো দিয়ে ‘ফ্রি উইল’ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কিন্তু অ্যাসাসিনরা কালের গর্ভে এগুলো লুকিয়ে রেখেছে নানা জায়গায়। এভাবেই কখনো অতীত, কখনো বর্তমানে ঘুরে ফিরে রক্তসাগরের বন্যায় এগিয়ে যায় এই গেম সিরিজের অনবদ্য কাহিনী।
কীভাবে এলো এই গেমের আইডিয়া?
২০০৩ সালে বের হওয়া ‘প্রিন্স অফ পার্সিয়া: দ্য স্যান্ডস অফ টাইম’ গেমের পর ইউবিসফটের Patrice Désilets-কে বলা হলো পরের গেমটি বের করতে এই সিরিজেরই। কাজও শুরু হলো। নাম দেয়া হলো ‘প্রিন্স অফ পার্সিয়া: অ্যাসাসিন’, অ্যাসাসিন বলতে হাসান বিন সাবাহ এর জীবনভিত্তিক। কিন্ত গেম বানাতে গিয়ে প্যাট্রিস অনুভব করলেন যে, গেমটি কোনো প্রিন্স বা রাজপুত্রের কাহিনীর সাথে ঠিক যাচ্ছে না। তখন প্রিন্সকে বাদ দিয়ে নতুন আরেকটি সিরিজ শুরু করা হলো, নাম দেয়া হলো অ্যাসাসিন্স ক্রিড। ভ্লাদিমির বাট্রলের উপন্যাস আলামুট থেকে গেমটির কাহিনীর ধারণা নেয়া হয়েছিল।
প্রথম গেম: অ্যাসাসিন্স ক্রিড
২০০৭ সালের নভেম্বরে প্লেস্টেশন ৩ আর এক্সবক্স ৩৬০ এর জন্য বের হয় গেমটি। আর পিসিতে আসে ২০০৮ এর এপ্রিলে। ১১৯১ সালের তৃতীয় ক্রুসেডের সময়কালে অ্যাসাসিন আর টেম্পলারদের দ্বন্দ্ব নিয়ে গড়ে ওঠে পেছনের কাহিনী। আর এদিকে বর্তমানে ডেজমন্ড মাইলস নামের এক লোকের জেনেটিক স্মৃতি ঘেঁটে পিস অফ ইডেন খুঁজতে থাকে অ্যাবস্টার্গো। গেমের নায়ক অ্যাসাসিন আলতায়ীর ইবনে লা’আহাদ গেমারদের মনে জায়গা করে নেন। সাদা পোশাক, মাথায় হুডি, হাতে ব্লেড আর সুউচ্চ চূড়া থেকে সময়ে সময়ে লাফিয়ে পড়া ‘লিপ অফ ফেইথ’ জয় করে নেয় খেলোয়াড়দের মন। তবে সময়ের সাপেক্ষে বেশ কড়া কনফিগারেশন প্রয়োজন ছিল এ গেমের জন্য।
মেটাক্রিটিক গেমটিকে ৭৯% স্কোর দেয়, আর ওদিকে আইজিএন দেয় ১০ এ ৭.৫। গেমটি রিলিজের সময় কল অফ ডিউটি: মডার্ন ওয়ারফেয়ারকে এক নম্বর অবস্থান থেকে সরিয়ে দেয়!
অ্যাসাসিন্স ক্রিড টু
প্রথম গেমের তুমুল জনপ্রিয়তার পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি ইউবিসফটকে। ২০০৯ সালে তারা নিয়ে আসে অ্যাসাসিন্স ক্রিড টু। শুধু যে তারা আশ মেটাতে পেরেছিল সেটা বললে ভুল হবে, আশাতীত ভালো একটি গেম তারা উপহার দেয় গেমারদের। এখনো পর্যন্ত কোটি কোটি গেমারদের কাছে সিরিজের সেরা গেম এই দ্বিতীয় গেমটিই। এ গেমের মাধ্যমেই কিংবদন্তী এৎজিও অডিটরে দ্য ফিরেঞ্জে-কে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। গেমটিতে গেমাররা ঘুরে বেড়াতে পারেন রেনেসাঁর যুগের ইতালির ফ্লোরেন্স, ভেনিস, তুস্কানি আর ফর্লিতে। রাস্তায় রাস্তায় আর ছাদের আনা কানাচে দৌড়াতে দৌড়াতে কখন যে প্রাচীন ইতালিতে হারিয়ে যাবেন আপনি টেরই পাবেন না। আর জেস্পার কিডের অসাধারণ মিউজিক আপনাকে ভুলিয়ে দেবে বাস্তব জীবনের কথা। আস্থা আর বিশ্বাসঘাতকতার এক অনন্য কাহিনী। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকেও আমরা পেয়ে যাই এ গেমে। তাছাড়া মাকিয়াভেলি আর পোপ চতুর্থ আলেক্সান্ডার তো আছেনই।
পিসি গেমটি মেটাক্রিটিকে ৮৬% আর আইজিএন-এর কাছে পায় ১০ এ ৯.২!
অ্যাসাসিন্স ক্রিড: ব্রাদারহুড
২০১০ সালে এলো অ্যাসাসিন্স ক্রিড: ব্রাদারহুড। এবারও তুমুল জনপ্রিয় চরিত্র এৎজিও। আগের পর্ব যেখানে শেষ, সেখান থেকেই শুরু। তাই এখানেও রেনেসাঁ যুগ চলছে। বরজিয়া পরিবারকে ধ্বংসের জন্য অ্যাসাসিনদের ছুটে চলা। আর বর্তমান সময়ে ডেজমন্ড বাহিনীর ২০১২ সালের মহাপ্রলয় এড়ানোর চেষ্টা।
গেমটি জিতে নেয় অনেকগুলো পুরষ্কার। মেটাক্রিটিকের কাছ থেকে পায় ৮৮% আর আইজিএন দেয় ১০ এ ৮।
অ্যাসাসিন্স ক্রিড: রেভেলেশন্স
এৎজিও ট্রাইলজিকে পূর্ণতা দিতে ২০১১ সালে বাজারে আসে অ্যাসাসিন্স ক্রিডঃ রেভেলেশন্স। এবার এৎজিওই নায়ক বটে, তবে বুড়ো। এবার কনস্টান্টিনোপল ঘুরে আসার সুযোগ পান গেমাররা। এর মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে এৎজিওর কাহিনীর।
মেটাক্রিটিক এ গেমটিকে ৮০% স্কোর দেয়। ওদিকে আইজিএন দেয় ১০ এ ৮.৫।
অ্যাসাসিন্স ক্রিড থ্রি
২০১২ সালে ইউবিসফট নতুন চরিত্র নিয়ে আসে সিরিজে। আধা ইংলিশ আর আধা মোহাক রেড ইন্ডিয়ান অ্যাসাসিনের নাম এবার রদুনহগেইদূন। তাকে কনর নামেও চেনে। এ গেমটিতে নতুন ধরনের গেমপ্লে আনা হয়, আর কাহিনী চলে আমেরিকান রেভ্যলুশনের সাথে সাথে (১৭৫৪-১৭৮৩)। গেমটির জন্য ইউবিসফট Anvil Next ইঞ্জিন বানিয়েছিল। ১২ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয় গেমটির।
মেটাক্রিটিক আগেরটির মতোই গেমটিকে ৮০% স্কোর দেয়। ওদিকে আইজিএন এটিকেও দেয় ১০ এ ৮.৫।
পরের গেমের আগে ‘অ্যাসাসিন্স ক্রিড: লিবারেশন’ নামের আরেকটি গেমও মুক্তি দেয়া হয়।
অ্যাসাসিন্স ক্রিড ফোর: ব্ল্যাক ফ্ল্যাগ
ক্যারিবিয়ান সাগরে দস্যুপনা চালানোর সুযোগ করে দিয়ে ২০১৩ সালে বাজারে ইউবিসফট নিয়ে এলো অ্যাসাসিন্স ক্রিড ফোর: ব্ল্যাক ফ্ল্যাগ। আগের গেমের সাথেই চরিত্রের আত্মীয়তা ঠিক রাখা হয়। মূল চরিত্র এবার এডওয়ার্ড কেনওয়ে। সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের পাইরেট+অ্যাসাসিনগিরি চালাতে পারবার কারণে প্রবল জনপ্রিয় হয় গেমটি। ব্রায়ান টাইলার সুর দেন এ গেমে। পাইরেটদের গানে, আর রাতের আঁধারে সাগরে জাহাজ ছুটিয়ে চলতে আপনার এক বিন্দু বোরিং অনুভব হবে না!
মেটাক্রিটিক গেমটিকে ৮৪% স্কোর দেয়। ওদিকে আইজিএন এটিকেও দেয় ১০ এ ৮.৫।
২০১৪ সালেই অনেকটা এ গেমের মতোই আরেকটি গেম ছাড়ে ইউবিসফট, নাম হয় অ্যাসাসিন্স ক্রিড: রোগ (Rogue)। এ গেমটি কাহিনী মিলিয়ে দেয় পরের গেম ‘ইউনিটি’র সাথে। মূল গেম না হলেও জনপ্রিয়তা পায় এটি।
অ্যাসাসিন্স ক্রিড: ইউনিটি
আর্নো ভিক্টর ডোরিয়ানের সাথে সাথে আপনি এ গেমে ঘুরে বেড়াবেন ফ্রেঞ্চ রেভ্যলুশনের প্যারিসে। গেমটি বের হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। এ গেমের মধ্য দিয়ে সিরিজটিতে মাল্টিপ্লেয়ার শুরু করা হয়। তবে গেমটিতে অনেক বাগ থাকার কারণে সমালোচিত হয়।
মেটাক্রিটিক রেটিং: ৭০/১০০। আর আইজিএন রেটিং: ৭.৮/১০।
অ্যাসাসিন্স ক্রিড: সিন্ডিকেট
ভিক্টোরিয়ান লন্ডনে অ্যাসাসিন জ্যাকব আর এভি ফ্রাই নামক দুজন জমজ ভাই-বোন হয়ে আপনাকে খেলতে হবে গেমটি। ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া গেমটি বেশ প্রশংসা পায়।
মেটাক্রিটিক রেটিং: ৭৪/১০০। আর আইজিএন রেটিং: ৮.২/১০।
অ্যাসাসিন্স ক্রিড: অরিজিন্স
২০১৭ সালের অক্টোবরে বের হয় এ গেমটি। এবার কাহিনী খ্রিস্টপূর্ব ৪৮ সালে, টলেমিক যুগের মিসরে, নায়কের নাম মেডজ্যা। ফারাও ত্রয়োদশ টলেমি, তার বোন ক্লিওপেট্রা সদ্যই মারা গিয়েছেন। কীভাবে অ্যাসাসিনদের ব্রাদারহুডের সূচনা হলো সেটিই এ গেমে দেখানো হয়। টেম্পলাররা এখানে অর্ডার অফ দ্য এনসিয়েন্টস। গেমটি সমালোচকদের অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে।
মেটাক্রিটিক রেটিং: ৮৪/১০০। আর আইজিএন রেটিং: ৯/১০।
এছাড়াও ফাঁকে তালে আরো অনেকগুলোই ছোটখাটো গেম বেরিয়েছে এ সিরিজের, এমনকি মুভি আর বইও বেরিয়ে গিয়েছে। তারপরেও প্রতি বছর এক জাতের গেম বের হওয়া কারো কারো মতে একঘেয়েমির কারণ। তাছাড়া এ সিরিজটি মূলত প্রিন্স অফ পার্সিয়া আর না বের হবারও কারণ। সে যা-ই হোক, গেমাররা বহুদিন হয়ে গিয়েছে অ্যাসাসিন্স ক্রিড টু এর মতো স্বাদ পান না সিরিজে, এখন এটাই দেখবার পালা নতুন আঙ্গিকে গেমটি গেমারদের কতটা সন্তুষ্ট করতে পারে!
ফিচার ইমেজ: Wccftech