হরর সিনেমার ইতিহাসে ইভিল ডেডের মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করা ফ্রাঞ্চাইজি খুব অল্প সংখ্যকই আছে। ইভিল ডেড ট্রিলজির প্রথম সিনেমাটি অনেক আগেই পেয়েছে ক্লাসিকের মর্যাদা। অতিরিক্ত ভায়োলেন্সের কারণে কিছু দেশে সিনেমাটি নিষিদ্ধ হলেও এখন পর্যন্ত এটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হরর সিনেমাগুলোর একটি, পরিচালক স্যাম রেইমির এক অনবদ্য মাস্টারপিস। হরর এবং ব্ল্যাক কমেডি এ দুইয়ের অসাধারণ সংমিশ্রণ ঘটেছে এখানে।
পুরো ট্রিলজিকে একটি সিরিজ হিসেবে না বলে বরং প্লট এবং চরিত্রের মধ্যে যোগসূত্র থাকা তিনটি আলাদা সিনেমা বলাই ভালো। এই ট্রিলজির প্রথম সিনেমা ‘দ্য ইভিল ডেড‘ মুক্তি পায় ১৯৮১ সালে। দ্য ইভিল ডেড সিনেমাটির কাহিনী মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির পাঁচ শিক্ষার্থী- অ্যাশ, তার বান্ধবী লিন্ডা, তার বোন সেরিল, তাদের বন্ধু স্কটি এবং স্কটির বান্ধবী শেলীকে নিয়ে।
একটি ‘১৯৭৯ ওল্ডসমোবাইল ডেলটা ৮৮’ গাড়ি নিয়ে টেনেসির প্রত্যন্ত এলাকার জনমানবহীন এক কেবিনে তারা স্প্রিং ব্রেকের ছুটি কাঁটানোর জন্য রওনা দেয়। পথিমধ্যে একটি ট্রাকের সাথে সংঘর্ষ হওয়ার হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যায় তারা, যদিও অঘটনের শুরু তখনও হয়নি বলা চলে। এরপর কেবিনে যাওয়ার পথে ভাঙাচোরা নড়বড়ে একটি ব্রিজে তাদের গড়ির চাকা আটকে যায়। ভাঙাচোরা ব্রীজ আর গভীর জঙ্গলে পুরনো কেবিন- হরর সিনেমার জন্য একদম যথোপযুক্ত পরিবেশ। অধিকাংশ হরর মুভির শুরুতেই আসন্ন বিপদের আভাস দেয়া থাকে কিংবা ভীতিকর আবহ সৃষ্টি করা হয়; দ্য ইভিল ডেডের শুরুর অংশটুকু তেমনই। যদিও সামনে কী অপেক্ষা করছে সেটা আন্দাজ করার উপায় নেই।
কেবিনে পৌঁছে সবাই যখন গল্পগুজব করছে সেরিল তখন রুমে ঝুলানো পুরোনো একটি ঘড়ির ছবি আঁকায় ব্যস্ত। হঠাৎ সে খেয়াল করলো ঘড়িটি থেমে গেছে এবং জানালার বাইরে থেকে ক্ষীণ, অশরীরী কন্ঠস্বর শোনা গেলো। কেউ যেন বলছে,”আমাদের কাছে চলে আসো!“। পুরো ব্যাপারটিকে পাত্তা না দিয়ে সে যখন আবার ছবি আঁকা শুরু করতে গেল তখন একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো, নিজের হাতের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো সে। যেন কেউ একজন ভর করেছে তার উপর, যে কিনা সেরিলকে দিয়ে একটি ছবি আঁকিয়ে নিচ্ছে, ভৌতিক মুখাবয়বের প্রচ্ছদ সম্বলিত একটি বইয়ের ছবি!
ডিনারের সময় হঠাৎ করে বেজমেন্টের দরজা খুলে গেলে অ্যাশ এবং স্কট সেখানে যায় কী ঘটছে দেখার জন্য। এখানেই তারা খুঁজে পায় Naturom Demonto বা Necronomicon Ex-Mortis নামক একটি বই, যা কিনা Book of the Dead নামের একটি মিশরীয় বইয়ের সুমেরীয় সংস্করণ। এই বইটির ছবিই সেরিল এঁকেছিল কিছুক্ষণ আগে। এর সাথে তারা খুঁজে পায় একটি টেপ রেকর্ডার, যেখানে বলা আছে এই বইটি সম্পর্কে। বলা হয়ে থাকে, শয়তানের উপাসকরা এই বইটি লিখেছিল মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য। মানুষের রক্ত দিয়ে লেখা এই বইয়ের কিছু লাইন, যা মন্ত্রের মতো, ঠিকভাবে পড়লে শয়তানের জগতের সাথে যোগসূত্র স্থাপন হবে। তারা যখন টেপ রেকর্ডারটি চালু করলো, তখনই ঘটলো বিপত্তি। ওখানে রেকর্ড করা ছিল কেবিনের মালিকের কন্ঠে পঠিত বইয়ের কিছু অংশ। যে কারণে জঙ্গলের গভীর থকে উঠে আসে শয়তানের দল। কেবিনের বাইরের প্রতিটি গাছের উপরেও ভর করে অশরীরী আত্মা, অন্যদিকে এই জঙ্গল থেকে বের হওয়ার একমাত্র ব্রিজটিও পুরোপুরি ভেঙে গেছে। অ্যাশ আর তার বন্ধুদের জন্য পালাবার আর কোনো পথ খোলা নেই!
ট্রিলজির দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ দ্য ইভিল ডেড সিনেমার সিক্যুয়েল ‘ইভিল ডেড টু: ডেড বাই ডন‘ মুক্তি পায় ১৯৮৭ সালে। দ্য ইভিল ডেড যেখানে শেষ হয়, এই সিনেমা শুরু হয় সেখান থেকেই। শুরুতে প্রথম পর্বের শুরুর কিছু অংশ দেখানো হয়, যে কারণে অনেকে শুরুতে একে দ্য ইভিল ডেড সিনেমার রিমেক ভেবে ভুল করেন। এখানে চরিত্রগুলো আলাদা। পর্দায় আবির্ভাব হয় কেবিনের মালিকের মেয়ে, তার বন্ধু এবং আরও দুজন লোকের। আবারও শুরু হয় অশরীরি আত্মাদের সাথে অ্যাশের লড়াই।
এই সিনেমায় কমেডির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে আরও বেশী। অ্যাশের সাথে ভূতদের মারামারির কিছু দৃশ্য দেখলে হাসি চেপে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। কিন্তু তারপরই হয়তো আসবে রক্ত হিম করে দেওয়া কোনো ভৌতিক দৃশ্য! অল্প বাজেটের একটি হরর সিনেমা থেকে যতটুকু ভয় একজন দর্শক হজম করতে পারেন, ততটুকু দেয়ার কোনো ত্রুটি রাখা হয়নি।
ট্রিলজির তৃতীয় এবং শেষ পর্ব ‘আর্মি অব ডার্কনেস‘ মুক্তি পায় ১৯৯২ সালে। এই সিনেমায় কমেডির পরিমাণ আরও বেশী এবং ভৌতিক দৃশ্য আরও কম। সঠিকভাবে বললে সিনেমাটি দেখলে ভয়ের চেয়ে হাসি পাবে বেশী। সিনেমার শুরুতে দেখা যায়, অ্যাশ মধ্যযুগের ইউরোপে চলে এসেছে। কীভাবে এল তা বোঝার জন্য দেখতে হবে আগের পর্বটি। সেখানকার লোকজন বিশ্বাস করে আকাশ থেকে নেমে আসবে এমন একজন ব্যক্তি যে কিনা শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করবে তাদেরকে। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও অ্যাশ পুনরায় শয়তানের দলের মুখোমুখি বাধ্য হয়। শুরু হয় অ্যাশের নতুন লড়াই। আর্মি অব ডার্কনেস আগের সিনেমা দুটোর মতো নয়, বরং বলা যায় একরকম সহজপাচ্য পপকর্ণ মুভি। রোমান্স এবং ব্যতিক্রমধর্মী অ্যাকশন দৃশ্য দুটোই আছে এখানে।
এই সিনেমার পরিচালক এবং প্রযোজক ইভিল ডেড ফ্রাঞ্চাইজির স্রষ্টা স্যাম রেইমি। তার সাথে অ্যাশ চরিত্রে অভিনয় করা ব্রুস ক্যাম্পবেল ছোটবেলার বন্ধু, বড় হয়েছেন একসাথে। বলা যায় এই দুজন মিলেই তৈরি করেছেন আজকের এই ইভিল ডেড সাম্রাজ্য। ট্রিলজির প্রথম পর্ব দ্য ইভিল ডেড সিনেমাটি বানানোর আগে তারা দুজন মিলে বেশ কিছু স্বল্প বাজেটের শর্টফিল্ম বানিয়েছিলেন, যেগুলো ছিল মূলত কমেডি ঘরানার। ইটস মার্ডার নামের শর্টফিল্মটি বানানোর সময় একটি সাসপেন্স দৃশ্য শ্যুট করতে গিয়ে হরর ধাঁচের সিনেমা বানানোর প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠলেন তারা। বানালেন ‘উইদিন দ্য উডস‘ নামের একটি হরর শর্টফিল্ম, যার বাজেট ছিল মাত্র ১,৬০০ ডলার! কিন্তু পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা বানানোর জন্য দরকার আরও বিশাল বাজেট। বিভিন্ন প্রযোজকের কাছে ধরনা দিয়ে এবং আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধবদের থেকে ধার করে শেষমেশ তারা তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার ডলার যোগাড় করতে পারলেন। এরপর পরিচিত মানুষজনদের মধ্য থেকেই বাছাই করা হয়েছিল অভিনেতা-অভিনেত্রী।
ওই সময়টাতে এ ধরনের একটি সিনেমা বানানোর জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তি ছিল না। ক্যামেরা থেকে শুরু করে সম্পাদনা পর্যন্ত সবজায়গাতেই এক ধরনের চ্যালেঞ্জের ব্যাপার ছিল। কিন্তু সব জায়গাতেই দক্ষতার ছাপ রেখেছেন পরিচালকসহ অন্যান্য কলাকুশলীরা। যদিও মাত্র ১৩ জন ক্রু মিলে এত স্বল্প বাজেটে এরকম সিনেমা কীভাবে বানিয়েছিলেন সেটি শুনলে চোখ কপালে উঠে যাওয়ার কথা। জঙ্গলের মধ্যে যে কেবিনটিতে শ্যুট করা হয়েছিল, সেখানেই গাদাগাদি করে থাকতো সবাই। ব্রিজের ধারে শ্যুট করতে গিয়ে একদিন জঙ্গলে হারিয়ে গেলো পুরো দলটি। সিনেমার শ্যুটিংয়ের শেষদিকে প্রচন্ড ঠান্ডায় শেষপর্যন্ত কেবিনের আসবাবপত্র পুড়িয়ে শরীর গরম রাখতে হয়েছিল তাদেরকে!
বর্তমান সময়ের মতো স্পেশাল ইফেক্টের ব্যাপার ছিল না তখন। জঙ্গলের মধ্যে Shaky Cam টেকনিক ব্যবহার করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাদেরকে। মেকআপের উপর ভরসা করেই ভৌতিক দৃশ্যগুলো পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে হয়েছিল। একধরনের সিরাপ ব্যবহার করে কয়েক গ্যালন কৃত্রিম রক্ত বানানো হয়েছিল। আর কিছু মৃত মুরগী কোপানো হয়েছিল মাংস কাঁটার শব্দ যোগ করা জন্য!
সিনেমা বানানো শেষ হয়ে গেলে স্যাম রেইমি ঠিক করলেন বড়সড় একটি প্রিমিয়ার করবেন। একটি থিয়েটারে মুক্তি দিয়ে মোটামুটি ভালো সাড়া পেলেন দর্শকদের কাছ থেকে। এরপর কান চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটি প্রদর্শনের জন্য অনুমতি পান তিনি। তখন বিশ্বখ্যাত আমেরিকান লেখক স্টিফেন কিংয়ের নজরে আসে সিনেমাটি। দ্য ইভিল ডেডের ভূয়সী প্রশংসা করলেন তিনি। তার সবচেয়ে প্রিয় পাঁচটি হরর সিনেমার একটির মধ্যে রাখেন এই সিনেমাকে। দ্য ইভিল ডেড সম্পর্কে তিনি বলেন, “The most ferociously original horror film of the year“। তার এই উক্তি সিনেমাটির প্রচারণার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
থিয়েটারে প্রথমে ভীড় কম থাকলেও এরপর থেকে ধীরে ধীরে দর্শকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। শেষপর্যন্ত প্রত্যাশার চেয়ে অনেক গুণ বেশি সাফল্য পায় বক্স অফিসে। বিশ্বজুড়ে সব মিলিয়ে প্রায় চব্বিশ লাখ ডলার আয় করে সিনেমাটি, যা মোট বাজেটের প্রায় আট গুণ। প্রথম পর্বের জনপ্রিয়তাকে পূুজি করে এবং আরও বড় বাজেটের কল্যাণে পরবর্তী দুটো সিনেমাও আশানুরূপ সাফল্য পায়। যদিও অনেকের কাছে এই ট্রিলজির প্রথম পর্বটিই সেরা। ইভিল ডেড ট্রিলজির রয়েছে শক্তিশালী একটি ফ্যানবেজ, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কাল্ট ফিল্মগুলোর তালিকায় থাকবে এটি। এছাড়া অনেক সমালোচকও মনে করেন, হরর সিনেমার জগতে ইভিল ডেড সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং জনপ্রিয় একটি নাম।
২০১৩ সালে ইভিল ডেড নামে মুক্তি পেয়েছে আরেকটি সিনেমা, অনেকটা রিমেক বলা যায় একে। কিন্তু ট্রিলজির মূল চরিত্র অ্যাশের বদলে এসেছে মিয়া অ্যালেন নামের আরেকটি চরিত্র। সম্প্রতি এই ফ্রাঞ্চাইজি থেকে নির্মিত হয়েছে অ্যাশ ভার্সেস ইভিল ডেড নামের একটি টেলিভিশন সিরিজ। ক্লাসিক ওই ট্রিলজি থেকে কাহিনী নিয়ে বানানো হয়েছে এই টিভি সিরিজটি, যার মূল চরিত্রে আছে অ্যাশ। ভবিষ্যতে অ্যাশ এবং মিয়া অ্যালেনের যুগলবন্দী দেখা যেতে পারে পর্দায়- এমন ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। ইভিল ডেড ভক্তদের জন্য সুখবরই বটে! এখনই শেষ হয়ে যাচ্ছে না ইভিল ডেডের রাজত্ব আর এই সিনেমার আইকনিক চরিত্র অ্যাশের লড়াই।
এক নজরে ইভিল ডেড ট্রিলজি
প্রথম সিনেমা: দ্য ইভিল ডেড (The Evil Dead)
জনরা: হরর
আইএমডিবি রেটিং: ৭.৫দ্বিতীয় সিনেমা: ইভিল ডেড টু(Evil Dead II)
জনরা: কমেডি, হরর
আইএমডিবি রেটিং: ৭.৮তৃতীয় সিনেমা: আর্মি অব ডার্কনেস (Army of Darkness)
জনরা: কমেডি, হরর
আইএমডিবি রেটিং: ৭.৬
ফিচার ইমেজ: IMDB