ব্লেড রানার
সময়টা ১৯৮২ সাল। সাই-ফাই (সায়েন্স ফিকশন) ঘরানার সিনেমা তখনো জেঁকে বসতে পারেনি হলিউডে। হাতেগোনা যে ক’টা সায়েন্স ফিকশন তৈরি হয়েছে, তার সবই এলিয়েন কেন্দ্রিক। ঠিক এসময়ই রিডলি স্কটের হাত ধরে এলো সাই-ফাই ক্লাসিক ‘ব্লেড রানার’। ২০১৯ সালের এক ডিস্টোপিয়ান (Dystopian) পৃথিবীকে চিত্রায়িত করা হয় এই ফিল্মে। ভবিষ্যতের কদর্য পুঁজিবাদী সমাজের চেহারা যেমন দেখানো হয়, তেমনি এই সিনেমার মাধ্যমেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ কেমন হতে পারে তা প্রথমবারের মতো আমরা দেখতে পাই রূপালি পর্দায়। ভবিষ্যৎ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি আরেকটি একক মাত্রা এই সিনেমাকে যুগোত্তীর্ণ করেছে। সেটি হচ্ছে কাহিনীর অতীন্দ্রিয়তা। বলা হয়ে থাকে, ব্লেড রানারই একমাত্র সায়েন্স ফিকশন যেটি কিনা ট্রান্সিডেন্টাল বা অতীন্দ্রিয়। ৮২’র এই ক্লাসিকের সিক্যুয়াল বের হয়েছে কয়েকদিন আগে (ব্লেড রানার ২০৪৯), যেখানে ৩৫ বছর জীবিত রয়েছে এমন সাই-ফাই পাওয়াই দুষ্কর, সেখানে ৩৫ বছর পর একটি সিনেমার সিক্যুয়াল বের হয়েছে এবং তা দর্শক-সমালোচক দুই মহলেই ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ব্লেড রানার কোন পর্যায়ের ক্লাসিক, এ থেকেই কি সেটা বোঝা যায় না?
কাহিনী
একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে টাইরেল কর্পোরেশন একদম মানুষের মতোই অবিকল একধরনের রোবট তৈরি করে যাদেরকে বলা হতো ‘রেপ্লিক্যান্ট’। মানুষের সেবার জন্য একরকম চাকরের মতোই ব্যবহার করা হতো রেপ্লিক্যান্টদের। মানুষের এই শোষণ সইতে না পেরে বিদ্রোহ করে ‘নেক্সাস ৬’ গোত্রের রেপ্লিক্যান্টরা, যারা কিনা মানুষের চেয়েও বেশি শক্তিশালী এবং সমান বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। পৃথিবীতে রেপ্লিক্যান্টদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। রেপ্লিক্যান্ট নিধনের জন্য মাঠে নামানো হয় এক ধরণের পুলিশ ফোর্সকে। তাদের নাম দেয়া হয় ‘ব্লেড রানার’।
২০১৯ সাল, প্রায় সব রেপ্লিক্যান্টকে মেরে ফেললেও চারজন দুর্ধর্ষ রেপ্লিক্যান্ট তখনো মানুষ সেজে মানুষের মাঝে বিচরণ করছে। সর্বশেষ এবং সবচেয়ে দুর্ধর্ষ চার রেপ্লিক্যান্টকে রিটায়ার করার (মেরে ফেলার) জন্য পুলিশ ফোর্স তলব করে প্রাক্তন ব্লেড রানার রিক ডেকার্ডকে (হ্যারিসন ফোর্ড)। চাকরি ছেড়ে দেয়া ডেকার্ড এ দায়িত্ব নিতে না চাইলেও তাকে এ কাজ নিতে বাধ্য করে তার সাবেক বস ব্রায়ান্ট। শুরু হয় ডেকার্ডের মিশন।
ডেকার্ডের দক্ষতা পরীক্ষার জন্য তাকে পাঠানো হয় টাইরেল কর্পোরেশনের মালিক এবং মাস্টারমাইন্ড এল্ডো টাইরেলের কাছে। টাইরেল পরীক্ষা চালাতে বলে তার সহকারী র্যাচেলের উপর। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক লম্বা টেস্ট শেষে ডেকার্ড জানায় র্যাচেল আসলে রেপ্লিক্যান্ট। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে র্যাচেল নিজেও তখনো জানে না যে, সে রেপ্লিক্যান্ট।
চার দূবৃত্ত রেপ্লিক্যান্টের খোঁজে মাঠে নামে ডেকার্ড। অপরদিকে সকল সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা ডেকার্ডের হৃদয়ে জন্ম নেয় অসহায় র্যাচেলের জন্য হালকা দুর্বলতা। মানুষ-রেপ্লিক্যান্টের দেয়াল ভেঙে কি ডেকার্ড র্যাচেলকে ভালবাসতে পারবে? চার রেপ্লিক্যান্ট, যারা কিনা মানুষের চেয়েও শক্তিশালী, তাদের রিটায়ার করে ডেকার্ড নিজে কি এই মিশন জীবিত অবস্থায় শেষ করতে পারবে? উত্তর জানতে হলে দেখতে হবে সিনেমাটি।
ব্লেড রানার রিক ডেকার্ড চরিত্রে হ্যারিসন ফোর্ড ছিলেন অনবদ্য। ‘স্টার ওয়ার্স’, ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’ এর মতো অসংখ্য নামকরা মুভিতে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করলেও আজও ব্লেড রানারই তার সবচেয়ে বড় পরিচয়। চারবার অস্কার নমিনেশন পাওয়া রিডলি স্কটের সেরা কীর্তি ধরা হয় ব্লেড রানারকে (যদিও ব্লেড রানারের জন্য অস্কার নমিনেশন পাননি)। ব্লেড রানার আসলে উল্লেখযোগ্য কোনো পুরস্কারই পায়নি। কারণ ১৯৮২ সালে কেউই যুগের চেয়ে এগিয়ে থাকা এই মুভির জন্য প্রস্তুত ছিল না। বক্স অফিসে ফ্লপ হবার পাশাপাশি সমালোচকদের কাছেও তেমন সাড়া পায়নি তখন। নব্বইয়ের দশক থেকে মূলত মানুষ ব্লেড রানারের মাহাত্ম্য বুঝতে শুরু করে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় অন্য সাই-ফাইগুলোর দিকে তাকালেই। আধুনিক সাই-ফাইগুলো যেসকল উপাদানের উপর ভিত্তি করে করা হয়, তার প্রায় সবকিছুরই মজুদ দিয়েছে ব্লেড রানার। সায়েন্স ফিকশন জগতে ব্লেড রানারকে একটি অনন্য ট্যাগ দেয়া হয়- ‘The film that started it all’।
সিক্যুয়াল: ব্লেড রানার ২০৪৯
২০০৭ সাল থেকেই রিডলি স্কট ব্লেড রানারের সিক্যুয়াল বানানোর চিন্তা করে আসছিলেন। অনেক কানাঘুষোর পর ২০১৪ সালে তিনি ঘোষণা দেন, ব্লেড রানারের সিক্যুয়াল হচ্ছে। তবে তিনি নিজে পরিচালনা না করে পরিচালকের আসনে বসান সমালোচক নন্দিত ফ্রেঞ্চ-কানাডিয়ান পরিচালক ডেনি ভিলনুভকে। প্রখ্যাত সিনেম্যাটোগ্রাফার রজার ডেকিন্সকে দেয়া হয় ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফির দায়িত্ব। প্রধান চরিত্রে রাখা হয় ‘লা লা ল্যান্ড’ খ্যাত রায়ান গসলিংকে। সাইড কাস্টও তারকাবহুল। সিনেমার প্রধান ভিলেন হিসেবে রয়েছেন অস্কারজয়ী অভিনেতা জারেড লেটো। রয়েছেন রবিন রাইট, ডেভ বাতিস্তা, এনা ডি আর্মাসরাও। এবং মূল আকর্ষণ হিসেবে হ্যারিসন ফোর্ড ফিরে এসেছেন আইকনিক রিক ডেকার্ড চরিত্রে।
কাহিনী
টাইরেল কর্পোরেশন ভূপতিত হওয়ার পর বহুদিন বন্ধ ছিল রেপ্লিক্যান্ট উৎপাদন বন্ধ ছিল। দীর্ঘ সময়ের জন্য রেপ্লিক্যান্ট তৈরি নিষিদ্ধও ছিল সরকার কর্তৃক। বহুদিন পর এই রেপ্লিক্যান্ট উৎপাদন আবার চালু করে নিয়ান্দার ওয়ালাস (জারেড লেটো)। তার ওয়ালাস কর্পোরেশন শুধু পৃথিবীতেই না, রেপ্লিক্যান্ট সাপ্লাই দিতে থাকে পৃথিবীর বাইরেও। রেপ্লিক্যান্টের পাশাপাশি হলোগ্রাফিক রোবটও তৈরি করে, যাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রয়েছে।
২০৪৯ সাল, এখনও নেক্সাস-৮ এর কিছু রেপ্লিক্যান্ট গোপনে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছে। তাদেরকে রিটায়ার করার জন্য এখনো নিয়োজিত আছে ব্লেড রানাররা। তবে এখন ব্লেড রানার হিসেবেও ব্যবহার হয় উন্নত প্রযুক্তির রেপ্লিক্যান্ট (নেক্সাস-৯)। এরকমই একজন ব্লেড রানার হচ্ছে অফিসার ‘কে’ (রায়ান গসলিং), যার একমাত্র সঙ্গী তার হলোগ্রাফিক গার্লফ্রেন্ড জয়ি (এনা ডি আর্মাস)। একজন বিপথগামী রেপ্লিক্যান্টকে রিটায়ার করতে গিয়ে কে একটি গোপন বক্সের সন্ধান পায়। বক্সের ভিতরে পাওয়া যায় কিছু পুরনো কংকাল। ফরেনসিক বিশ্লেষণের পর জানা যায়, এই কংকাল আসলে একজন রেপ্লিক্যান্টের যে কিনা মাতৃকালীন জটিলতার কারণে মারা গিয়েছে। এই রিপোর্ট সবাইকে হতবাক করে দেয়। কেননা এতদিন সবাই জেনে এসেছে রেপ্লিক্যান্টরা গর্ভধারণ করতে পারে না। এই খবর রেপ্লিক্যান্টদের মাঝে পৌঁছালে তা বড়সড় অস্থিতিশীলতার জন্ম দিবে ভেবে এই কেসের সব ফাইল ধ্বংস করে দেয়া হয়। জন্ম নেয়া রেপ্লিক্যান্ট শিশুটিকেও খুঁজে বের করে মেরে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয় অফিসার ‘কে’কে।
ওয়ালাস কর্পোরেশনের ডাটাবেজ ঘেঁটে কে জানতে পারে গর্ভধারিণী মহিলাটি ছিল র্যাচেল। সুতরাং শিশুটির সম্ভাব্য পিতা আর কেউ না, রিক ডেকার্ড। শিশুটির সন্ধানের জন্য ডেকার্ডকে খুঁজতে থাকে ‘কে’। রেপ্লিক্যান্টদের গর্ভধারণ করার ফর্মুলা জানতে পারলে ওয়ালাস কর্পোরেশনের রেপ্লিক্যান্ট প্রোডাকশনও নতুন মাত্রা পাবে। সুতরাং তারাও হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে ডেকার্ডকে। বাকি ঘটনা জানতে হলে আপনাকে দেখতে হবে সিনেমাটি।
প্রথম ব্লেড রানার- এর মতো এর সিক্যুয়ালটিও দর্শক-সমালোচক দুই মহলেই নন্দিত। অনেক সমালোচকরাই এই ছবিকে ‘নেক্সট সাই-ফাই ক্লাসিক’ বলে আখ্যা দিচ্ছে। ডেনি ভিলনুভ বরাবরের মতোই দর্শকদের আরেকটি মাস্টারপিস উপহার দিয়েছেন। রায়ান গসলিংও তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অভিনয় করেছেন এই সিনেমায়। হ্যান্স জিমারের মিউজিক এবং মরুময় লস এঞ্জেলস সেট আপনাকে শুধু মুগ্ধই করবে না, সময়ে সময়ে নস্টালজিকও করে তুলবে।
সবশেষে আমরা যদি ব্লেড রানারকে একটি মাপকাঠির নিচে আনার চেষ্টা করি, অন্য যেকোনো সাই-ফাই থেকে একদিক দিয়ে এই মুভিকে আলাদা করে রাখতে হবে। সেটি হচ্ছে এর অতীন্দ্রিয়তা, স্থান-কাল ছাপিয়ে ফেলে যাওয়া দর্শন। এই দুটি সিনেমা আপনাকে জীবন নিয়ে ভাবাবে, অস্তিত্ব নিয়ে করবে গভীরতম জিজ্ঞাসা। জগতের অসাড়তা, জীবনের শূন্যতাকে হয়তো আপনার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিবে। ঠিক রয় যেভাবে ডেকার্ডকে দেখিয়ে দেয়, বলে যায়-
All those moments will be lost, in time, like tears in rain.