১৯৪০ সালে প্রথম প্রকাশিত হবার পর আট দশকের বেশি সময় কেটে গেলেও ‘ব্যাটম্যান’ কমিক্সের জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি, বরং প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। শুধুমাত্র ছাপা কাগজেই সীমাবদ্ধ না থেকে টেলিভিশন ঘুরে ব্যাটম্যান পৌঁছে গিয়েছে সিনেমার বড় পর্দাতেও। মাইকেল কীটন, ভ্যাল কিলমার, ক্রিশ্চিয়ান বেল, বেন অ্যাফ্লেকের মতো অভিনেতারা বড় পর্দায় আবির্ভূত হয়েছেন ব্যাটম্যান হিসেবে। অনেক গুণী পরিচালক ব্যাটম্যানের সিনেমাগুলো পরিচালনা করলেও ভক্তদের কাছে ক্রিস্টোফার নোলান সবসময়ই এক আলাদা জায়গা নিয়ে থাকবেন। তার পরিচালিত ‘দ্য ডার্ক নাইট‘ শুধু সুপারহিরো ঘরানার নয়, সমগ্র সিনেমাজগতেই একটি মাইলফলক হিসেবে গণ্য হয়। তারপর আরো কয়েক হাত ঘুরে ব্যাটম্যানের মশাল আসে ম্যাট রিভসের হাতে। তার পরিচালিত ‘দ্য ব্যাটম্যান‘ সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রবার্ট প্যাটিনসন।
‘রিডলার প্রতিশোধ নিতে চায়, শাস্তি দিতে চায় সেসব দুর্নীতিবাজ দুষ্কৃতিকারীকে, যাদের অপকর্মের জন্য ভুগতে হয় সাধারণ মানুষকে। তবে সেই শাস্তি দেবার ধরন বড়ই অন্যায্য, সেখানে ভুক্তভোগী আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পায় না। রিডলার নিজেই নির্ধারক, বিচারক ও জল্লাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এখানেই রিডলার ও ব্যাটম্যানের পার্থক্য- ব্যাটম্যান কখনো সীমা অতিক্রম করে না। নিজের নৈতিক সীমালঙ্ঘন না করেই ব্যাটম্যান অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়।
রিডলার নৃশংস কায়দায় একের পর এক খুন করতে থাকে, ও খুনের স্থানে ব্যাটম্যানের জন্য বিভিন্ন ধাঁধা রেখে যায়। অনেকটা, ডেভিড ফিঞ্চার পরিচালিত ‘জোডিয়াক’ সিনেমার মতো। ম্যাট রিভস গৎবাধা সুপারহিরো সিনেমা না বানিয়ে অন্য রাস্তায় হেঁটেছেন; এখানে আমরা ব্যাটম্যানের অসুরিক শক্তি, অত্যাধুনিক গ্যাজেটের চেয়ে তার ক্ষুরধার মস্তিষ্কের পরিচয় পাই বেশি। বড় পর্দায় এমন গোয়েন্দা ব্যাটম্যানের উপস্থিতি প্রথম হলেও, কমিকভক্তরা অনেক আগে থেকেই ব্যাটম্যানের এই রূপের সাথে পরিচিত। ‘দ্য ব্যাটম্যান’ সিনেমার গল্প যেভাবে বলা হয়েছে, এবং গোথাম ও সেখানকার অধিবাসীদের যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে ফিঞ্চারের প্রভাব বেশ স্পষ্ট। ব্যাটম্যান কীভাবে ধাঁধাগুলোর সমাধান করে রিডলারের পেছনে ধাওয়া করে বেড়ায় ও নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে, সেটাই দেখিয়েছেন ম্যাট রিভস।
‘টোয়াইলাইট’ সিরিজের সিনেমাগুলোয় ফ্যাকাশে, পাশের বাড়ির চকলেট বয় ভ্যাম্পায়ারের চরিত্রে অভিনয় করা রবার্ট প্যাটিনসন জাত চিনিয়েছেন দ্য লাইটহাউজ, টেনেট, দ্য ডেভিল অল দ্য টাইম এর মতো সিনেমায় নিজের অভিনয়ের কারিশমা দেখিয়ে। পাঁড় ব্যাটম্যান ভক্তরা অবশ্য আপত্তি জানিয়েছিল যে, ব্যাটম্যানের যে ‘ইমেজ’, তার সাথে প্যাটিনসনের ‘ইমেজ’ কোনোভাবেই যায় না। তবে প্যাটিনসন সব সমালোচনার জবাব তার অভিনয় দিয়েই দিয়েছেন।
নবীন ব্যাটম্যান, যার কিনা স্যুট পাবার মাত্র দুই বছর হয়েছে; এখনো সে তার ব্যাটম্যান অস্তিত্বের সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, সাথে ব্রুস ওয়েইন হিসেবে তার কর্তব্যগুলো বুঝতে শিখছে। এমন চরিত্রে রবার্ট প্যাটিনসনকে একদম মানিয়ে গিয়েছে। আমরা দেখি নবীশ এক ব্যাটম্যানকে, যে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে, অস্তিত্বের সংকটে ভোগে, চারটা মার দিলে দুটো খায়। কমিক্স জগতের আর সব সুপারহিরোর থেকে ব্যাটম্যান যে জায়গায় আলাদা, সেটা হচ্ছে তার শক্তিমত্তা। ব্যাটম্যানের কোনো অতিমানবীয় শক্তি নেই, তার আছে ক্ষুরধার মস্তিষ্ক ও কখনোই হাল না ছাড়ার মানসিকতা। সেই হিসেবে বলাই যায়- ব্যাটম্যান হচ্ছে সবচেয়ে ‘মানবীয় অতিমানব’। ম্যাট রিভস সেই মানবিক ব্যাটম্যানকেই বড় পর্দায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আমরা দেখি, ব্যাটম্যান ভিনগ্রহ থেকে আসা কোনো পরাশক্তিধর এলিয়েন নয়, সে আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ। তারও শরীর আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাকেও নাকানি-চুবানি খেতে হয় রিডলারের থেকে। তবে সে কখনো আশা ছাড়ে না, আবার প্রতিশোধের নেশায় মত্ত হয়ে নিজের নৈতিকতার সীমাও অতিক্রম করে না। আমরা এই সিনেমায় রবার্ট প্যাটিনসনের মাধ্যমে ব্যাটম্যানের সেই যাত্রা দেখি, যেখানে সে বুঝতে পারে- তার উদ্দেশ্য প্রতিশোধ নেওয়া নয়, তার উদ্দেশ্য গোথামবাসীকে শত অন্ধকার, অরাজকতার মাঝেও আশার আলো দেখানো, তাদের ভরসাস্থল তৈরি করে দেওয়া।
‘ব্যাটম্যান’ চরিত্রের এত তুমুল জনপ্রিয়তার পেছনে ব্যাটম্যানের অ্যান্টাগনিস্টদের বেশ বড় ভূমিকা আছে। ব্যাটম্যানই সম্ভবত একমাত্র সুপারহিরো যার ‘আর্চ-এনিমি’ ক্ষেত্রবিশেষে তার থেকেও বেশি জনপ্রিয়। হ্যাঁ, বলা হচ্ছিল কালজয়ী চরিত্র জোকারের কথা। বড় পর্দায় জোকারের ভূমিকায় অভিনয় করে অস্কার জিতে নিয়েছেন হিথ লেজার ও ওয়াকিন ফিনিক্স। তবে ব্যাটম্যানের অন্য অ্যান্টাগনিস্টরাও পিছিয়ে নেই- রিডলার, বেইন, রা’স আল ঘৌল, পয়সন আইভি, পেঙ্গুইন সকলেই প্রায় সমান জনপ্রিয়। ‘দ্য ব্যাটম্যান‘ সিনেমায় জোকার চরিত্রে ব্যারি কিওঘানের ক্যামিও থাকলেও সেটা সিনেমার গল্পে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলেনি।
চলচ্চিত্রটি আবর্তিত হয়েছে রিডলারকে ঘিরে। অনাথ ‘এডওয়ার্ড নিগমা’ যে এতিমদের দুরবস্থার জন্য প্রতিশোধ নিতে চায় তাদের উপর, যারা এতিমদের তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছে। সে আবার ব্যাটম্যানকে দেখে তার প্রেরণা হিসেবে। তবে ব্যাটম্যানের মতো তার কোনো নৈতিকতার বালাই নেই। সে সেটাই করে যেটা তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে। রিডলার চরিত্রে অভিনয় করেছেন পল ড্যানো। সৌম্যদর্শন এই অভিনেতা তার সেরাটা দিয়েছেন। বিশেষ করে আর্কহাম অ্যাসাইলামে বন্দীদশায় ব্যাটম্যানের সাথে কথোপকথনের সময় তার অভিব্যক্তি, শীতল দৃষ্টি সবই দর্শকদের মনে ভীতি জাগিয়ে তোলে। এছাড়াও, সেলিনা কাইল তথা ক্যাট-ওম্যান চরিত্রে জোয়ি ক্র্যাভিটজ, পেঙ্গুইন চরিত্রে কলিন ফ্যারেল, কমিশনার গর্ডন চরিত্রে জেফরি রাইট সবাই খুবই ভালো কাজ করেছেন। বিশেষ করে কলিন ফ্যারেলকে চেনাই যাচ্ছিল না। নিজেকে তিনি এতটাই পরিবর্তন করেছেন চরিত্রের প্রয়োজনে। তবে এই সিনেমায় পেঙ্গুইনের পর্দায় উপস্থিতি খুবই কম সময়ের জন্য ছিল। আশা করা যায় পরবর্তী সিনেমায় পেঙ্গুইনরূপী কলিন ফ্যারেলকে আমরা পূর্ণরূপে দেখব।
‘দ্য ব্যাটম্যান’ সিনেমা নিয়ে বলতে গেলে যা নিয়ে বলতেই হবে সেটি হচ্ছে এর সিনেমাটোগ্রাফি। এর সিনেমাটোগ্রাফি এককথায় অসাধারণ, সিনেমার প্রতিটি শট ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখার মতো সুন্দর! তবুও দুই-একটি দৃশ্যের কথা আলাদাভাবে না বললেই নয়। সিনেমার একদম শেষাংশে আমরা দেখি পানির মধ্যে গোথাম যখন তলিয়ে যাচ্ছে; ব্যাটম্যান হাতে মশাল নিয়ে গোথামবাসীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিরাপদ জায়গায়। এই দৃশ্য দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনই এর রূপক বার্তাও দর্শকের মাথায় বসে যাবার মতো যে, ব্যাটম্যান অবশেষে তার লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছে। সে গোথামবাসীর জন্য সেই আলোকবর্তিকা যে তাদের পথ দেখাবে। এছাড়া নাইটক্লাবে সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্যে শুধু মাজল ফ্ল্যাশ ব্যবহার করে দৃশ্যায়িত অ্যাকশন সিকোয়েন্স, পেঙ্গুইনের ওল্টানো গাড়ি থেকে ব্যাটম্যানের এগিয়ে আসা দেখতে থাকা, সাথে ব্যাকগ্রাউন্ডে নির্ভানার গান ‘সামথিং ইন দ্য ওয়ে’ দর্শকদের মনে দীর্ঘস্থায়ী এক আবেশ সৃষ্টি করে। প্রায় তিন ঘন্টা দৈর্ঘ্যের সিনেমাটি গোছানো চিত্রনাট্য ও দুর্দান্ত আবহসঙ্গীতের কারণে এক মূহুর্তের জন্যও বিরক্তি উৎপাদন করে না।
‘দ্য ব্যাটম্যান’ সিনেমাটি আমাদের নতুন এক ব্যাটম্যানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় যা আগের ব্যাটম্যানদের ‘জীবনের চেয়েও বড়’ প্রতিপাদ্যের চেয়ে অনেকাংশেই আলাদা। আশা করা যায় ম্যাট রিভসের হাতেই আমরা প্যাটিনসনের নবীশ ব্যাটম্যানকে পরিণত হয়ে উঠতে দেখতে পাবো।