হাল আমলের টিভি সিরিজগুলো যারা দেখছেন অথবা নতুন কোনো সিরিজ শুরু করার কথা ভাবছেন, তাদের জন্য আজকের এই টিভি সিরিজ রিভিউ। গত দশকে মুক্তি পাওয়া সাড়া জাগানো টিভি সিরিজ ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ সম্পর্কে জানাবো আজকে।
জম্বি হলো মানুষের কাল্পনিক এক রূপ, যখন মৃত মানুষের দেহ প্রাণ ফিরে পায়, আর গোগ্রাসে খেতে চায় মানুষেরই মাংস- এমন জীবন্মৃত মানুষকে (কিংবা লাশকে) বলা হয় ‘জম্বি’। ধরুন, সারা পৃথিবীতে মহামারী আকারে জম্বি ছড়িয়ে পড়লো, চারিদিকে শত শত জম্বি এগিয়ে আসছে আপনার দিকে। নাগাল পেলেই খুবলে খুবলে খাবে আপনারই মাংস। কী করবেন আপনি? বাঁচার উপায় একটাই, পালাতে হবে। কারণ, একবার যদি জম্বি কামড়ে দেয়, আর রক্ষা নেই! জম্বির কামড়ে যে ভাইরাস প্রবেশ করবে আপনার দেহে, সেটা আপনাকেই জম্বি বানিয়ে ছাড়বে। সাহায্যের জন্যও কেউ থাকবে না। নেই সরকার ব্যবস্থা বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। বাঁচতে চাইলে নিজের অবলম্বন নিজেই। দ্য ওয়াকিং ডেড-এর জগতটা ঠিক এমনই।
কাহিনী সংক্ষেপ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি অঙ্গরাজ্য এই সিরিজের প্রাথমিক পটভূমি। মূল চরিত্র ‘রিক গ্রাইমস’ নামের মধ্য ত্রিশের এক ডেপুটি শেরিফ (পুলিশ অফিসার)। সহকর্মী-বন্ধু শেন ওয়ালশকে নিয়ে রিক গ্রাইমসকে এক জরুরি অপারেশনে যেতে হয়। কিছু অপরাধীকে হাতেনাতে ধরতে হবে। রিক আর শেন তাদের পেট্রোল বাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করে রাস্তার মাঝখানে। দ্রুতগামী গাড়ীর আওয়াজ পাওয়া যায়। বন্দুক তাক করে প্রস্তত হয় শেরিফ বাহিনী। গাড়ীগুলো অপরাধী চক্রের। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে গাড়ি আরো বেপরোয়া গতিতে ছোটায় দুষ্কৃতিকারীরা। যেকোনো মূল্যে পালাতে হবে যে! ধরা পড়লেই নিশ্চিত জেল। কিন্তু কাউন্টি পুলিশ যে এক অভিনব ফাঁদ পেতে রেখেছে, সেটি যদি ওরা জানতো! রাস্তা বরাবর বিছিয়ে রাখা হয়েছে কাঁটাতারের শিকল। গাড়ি সেই কাঁটার উপর দিয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ টায়ার ফেটে যাবে। বিকল গাড়ি নিয়ে পালাতে পারবে না অপরাধীরা।
ঠিকই গাড়িগুলো কাঁটায় ফেঁসে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারায়, রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে উল্টে যায়। রিক আর শেন সন্ত্রস্থ হয়ে এগিয়ে যায় গাড়ি বরাবর। অপরাধীরা বেঁচে আছে কিনা তা ঠাহর করতে কিছুটা সময় নেয় তারা। হঠাৎ এলোপাতাড়ি গুলি। না, বদমাশগুলো মরেনি, আহত অবস্থায় গুলি ছুঁড়ছে ওরা। অপ্রস্তুত শেরিফ বাহিনী মুহূর্তেই সামলে নিয়ে পাল্টা গুলি ছোঁড়ে। সন্ত্রাসীদের পরাস্ত করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না তাদের। সবকিছুই ঠিক চলছিল, একজন অপরাধী যে গাড়ীর ভেতর লুকিয়ে ছিল তা আর কেউ খেয়াল করেনি। এনকাউন্টার থেমে গেলে সে আচমকা বেরিয়ে এসে ট্রিগার টিপে দেয়। গুলিটা গিয়ে রিক গ্রাইমস এর পিঠ বরাবর ঢোকে। তবে কি ডেপুটি শেরিফকে অকালে প্রাণ হারাতে হবে? বন্ধুর আহত শরীর নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যায় শেন ওয়ালশ। রিক গ্রাইমসকে কোমায় নেওয়া হয়, তার শারীরিক পরিস্থিতি খুবই নাজুক। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে তার নিথর দেহ হাসপাতালের বিছানায় দিন গুনে যায়, কবে আবার সুস্থ্ হয়ে ফিরে যাবে সে স্ত্রী লরি আর পুত্র কার্লের কাছে। কিন্তু এরই মাঝে পৃথিবীতে যে এক সর্বনাশ ঘটে গেছে তা যদি রিক জানতো!
চোখ মেলে তাকালো রিক। ক্লান্ত আর ভঙ্গুর দেহে কোনোমতে উঠে উবু হয়ে বসলো হাসপাতালের বিছানায়। আইসিইউ কক্ষের সবকিছু যে অগোছালো, সেটি বুঝতে কিছুটা সময় নেয় রিক। নার্স বা ডাক্তার নেই, কবরখানার স্তব্ধতা সারা হাসপাতাল জুড়ে। চমকে যায় রিক, কষ্টেসৃষ্টে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে সে। দ্বিতীয় কোনো মানুষ দেখবে, এই আশায় সে চষে বেড়ায় হাসপাতালের এ মাথা থেকে ও’ মাথা। একটি বড়সড় দরজা দেখা যায়। কে যেন স্প্রে পেইন্ট দিয়ে দরজা বরাবর লিখে রেখেছে, “Don’t open, dead inside”। লেখাটির অর্থ বোঝার আগেই কৌতূহলী রিক দরজা খুলে দেয়। তারপর যা ঘটে, সেটির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে।
দরজার ফাঁক দিয়ে কয়েক জোড়া হাত বেরিয়ে আসে। হাতগুলো নিস্প্রাণ আর ফ্যাকাশে। কোনো মরা লাশ নড়াচড়া করলে ঠিক এমন দেখাবে। ভারী নিঃশ্বাস আর গড়গড় আওয়াজের শব্দে সতর্ক হয় রিক। ভারী দরজা পুরোপুরি খুলে যায়, এমন রহস্যময় আর ভৌতিক শব্দের কারণ জেনে যায় রিক। কোনো মানুষ নয়, হাতগুলো ভয়ংকর সব জম্বির। মরে গিয়েও ফিরে এসেছে তারা, মানুষখেকো পিশাচের রূপে! বহুক্ষণ পর জীবিত কোন মানুষকে কাছে পেয়েছে জম্বিগুলো। রিককে দেখে লালায়িত দৃষ্টিতে এগিয়ে আসে তারা। ধাতস্ত হয়ে রিক বুঝতে পারে, আর এক মুহূর্ত এখানে থাকলে এসব জন্তুর পেটে চালান হয়ে যেতে হবে। ব্যান্ডেজ জড়ানো শরীর নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে হাসপাতাল থেকে জান নিয়ে বেরিয়ে আসে সে। এখানে জম্বির আনাগোনা টের পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু আশেপাশের পরিস্থিতি দেখে রিক স্তব্ধ হয়ে যায়। যেন কোনো নারকীয় যুদ্ধজজ্ঞ চলেছে হাসপাতালের বাইরে। শত-সহস্র মানুষের লাশ সাদা কাপড়ে ঢাকা। সেনাবাহিনীর ট্যাংক, হেলিকপ্টার আর সাঁজোয়া জিপ গাড়ি বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে আছে এখানে-সেখানে। বোঝাই যাচ্ছে, জম্বির সাথে এই বাঁচা-মরার লড়াইয়ে রণে ভঙ্গ দিতে হয়েছে জীবিত মানুষদের।
এরপরের গল্প আরো চিত্তাকর্ষক, জানতে হলে দেখে ফেলুন ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ এর প্রথম সিজন। একবার শুরু করলে থামতে পারবেন না! এই সিরিজ শুধু মাংসলোভী জম্বি নিয়ে নয়। ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ এক বিপদসংকুল পৃথিবীতে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্প বলে। এখানে জম্বির ভয় ছাপিয়ে মানবিকতার বহুমাত্রিক রূপ প্রাধান্য পায়। পরম শত্রুও এখানে বন্ধু হতে পারে, আবার বন্ধুর কাছ থেকেও বিশ্বাসঘাতকতা আশা করা যায়।
টুকরো গল্প
‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ মূলত একটি কমিক বুক সিরিজ। রবার্ট কারকম্যান এর কাহিনীকার, শিল্পী টনি মুর আঁকেন কমিকস। ২০১০ সালে এই কমিকস অবলম্বনে মুক্তি পায় দ্য ওয়াকিং ডেড এর প্রথম সিজন। এই সিরিজের ক্রিয়েটর এবং প্রযোজক ‘ফ্রাংক ড্যারাবন্ট’। ‘দ্য শশ্যাংক রিডেম্পশন’ সিনেমার পরিচালক ড্যারাবন্টের হাত ধরেই আলোর মুখ দেখে ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ টিভি সিরিজটি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জম্বি অ্যাপোক্যালিপ্স নিয়ে এই সিরিজে কখনই ‘জম্বি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। জম্বিকে এখানে বলা হয় ‘ওয়াকার’।
এই সিরিজে যেসব জম্বি দেখবেন, তাদের সবাইকে প্রশিক্ষণ নেবার জন্য এক বিশেষ স্কুলে যেতে হয়। জম্বির অভিনয় যেন নিখুঁত আর বিশ্বাসযোগ্য হয়, সেজন্যই এমন ব্যবস্থা। জম্বির মতো হাঁটা-চলা আর মুখভঙ্গি শেখানো হয় এই অভিনব স্কুলে!
দ্য ওয়াকিং ডেড এর অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে জম্বি। আর জম্বিগুলো যেন দেখতে অবিকল কোনো মৃত লাশের মতো হয়, সেজন্য নির্মাতারা সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন। জম্বির জন্য যে বিশেষ রূপসজ্জা আর স্পেশাল ইফেক্ট প্রয়োজন হয়, সেটির জন্য কাজ করেছেন বিখ্যাত শিল্পী ‘গ্রেগ নিকোটেরো’। তার সুনিপুণ হাতের বদৌলতে অভিনয় শিল্পীদের শরীর নিমেষেই জম্বির রুপ নেয়।
এ বছরের ২২ অক্টোবর মুক্তি পেয়েছে ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ এর অষ্টম সিজন। সময় করে দেখে ফেলুন এই চমৎকার সিরিজ।
ফিচার ইমেজ: ওয়ালপেপার অ্যাবিস