‘কীরে, আজ রোজা রেখেছিস?’ মেয়েটিকে তীর্যকভাবে প্রশ্নটা করল তারই এক ছেলেবন্ধু। রমযান মাসে মেয়েদেরকে এমন প্রশ্ন করে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়ে অনেকেই বিকৃত আনন্দ পায়। এটা তাদের অজ্ঞতা, অপরিপক্বতা ও অসুস্থ মানসিকতার পরিচয় দেয়। সমগ্র নারীকূল যে বিষয়টি প্রতি মাসে মোকাবিলা করে সেটা তাদের কাছে ঠাট্টা-মশকরার উপাদান।
এর কারণ কী? পিরিয়ড তথা রজঃস্রাব নিয়ে সমাজে বিদ্যমান রাখঢাক ও কুসংস্কারই এসবের জন্য দায়ী। সকল নারীকেই এই প্রাকৃতিক নিয়মের সম্মুখীন হতে হয়। অজ্ঞতা ও অপরিচ্ছন্নতার কারণে জরায়ুর ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে ভুগতে হয় নারীকে। সমাজে বিদ্যমান এই ট্যাবুকে কেন্দ্র করে ভারতের মতো রক্ষণশীল দেশে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, নাম ‘প্যাড ম্যান‘।
তামিলনাড়ুর অরুণাচল মুরুগানান্থম একজন সমাজকর্মী। তিনি সাশ্রয়ী মূল্যে স্যানিটারি প্যাড প্রস্তুত করছেন অনেক দিন ধরে। এই বাস্তব কাহিনী অবলম্বন করে টুইঙ্কেল খান্না তার ‘দ্য লেজেন্ড অব লক্ষ্মী প্রসাদ’ বইয়ে একটি ছোট গল্প লিখেছিলেন। গল্পটির নাম দ্য স্যানিটারি ম্যান অব স্যাকরেড ল্যান্ড। সেই গল্প থেকে চিত্রনাট্য তৈরির পাশাপাশি সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন আর. বালকি।
কাহিনী
সিনেমার শুরুতেই দেখা যায় লক্ষ্মীকান্ত চৌহানের সাথে গায়েত্রীর বিয়ে হচ্ছে। স্ত্রীকে লক্ষ্মীকান্ত অত্যন্ত ভালোবাসে। তার ভাল-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধার দিকে সতর্ক নজর রাখতেও ভুল করে না। সুখেই দিন কাটছিল তাদের।
একদিন নাস্তা করার সময় গায়েত্রী হঠাৎ খাওয়া ছেড়ে উঠে যায়। লক্ষ্মীকান্ত বোঝার চেষ্টা করে কী সমস্যা। পরে আবিষ্কার করে রুমের বাইরে বারান্দা সংলগ্ন একটা জায়গায় গায়েত্রী পাঁচ দিন অস্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করছে। লক্ষ্মী আপত্তি জানায়। গায়েত্রীকে স্বাভাবিকভাবে রুমে চলাচল করতে বলে। কিন্তু তিনি নিয়ম ছেড়ে বেরিয়ে আসতে নারাজ। নিজের মা, বোনদেরকে বুঝিয়ে ব্যর্থ লক্ষ্মীকান্ত স্ত্রীর কাছেও ব্যর্থ হয়। কোনোভাবেই তাদেরকে কুসংস্কারের বেড়ি থেকে মুক্ত করতে পারে না।
পরদিন সকালে লক্ষ্মীকান্ত স্ত্রীর জন্য চা বানিয়ে এনে লক্ষ্য করে তার স্ত্রী খুব নোংরা এক টুকরো কাপড় ধুয়ে এনে শাড়ির নিচে আড়াল করে শুকোতে দিচ্ছে। এই পাঁচদিন ব্যাপী গায়েত্রী এরকম নোংরা কাপড় ব্যবহার করে জানতে পেরে অবাক হয় লক্ষ্মীকান্ত। সে জানায়, নিজের সাইকেলও তো এত নোংরা কাপড় দিয়ে কখনও পরিষ্কার করবে না! গায়েত্রী অসন্তুষ্ট হয়। তাকে এসব মেয়েলী ব্যাপারে নাক না গলানোর জন্য অনুরোধ করে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ঘটনাগুলো ঘটছে ভারতের মধ্য প্রদেশের মহেশ্বর নামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানকার বাসিন্দারা এসব মেয়েলী ব্যাপারে খুব কঠোর রাখঢাক করে থাকে।
স্ত্রীর স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে ফার্মেসি থেকে স্যানেটারি প্যাড কিনে আনে লক্ষ্মীকান্ত। জীবনে প্রথমবারের মতো প্যাড হাতে পেয়ে গায়েত্রী খুব খুশিও হয়। কিন্তু প্যাডের প্যাকেটে ৫৫ রুপি মূল্য দেখে রীতিমতো চমকে ওঠে। লক্ষ্মীকান্ত সামান্য মেকানিক। আর এমন অঁজপাড়া গাঁয়ে ৫৫ রুপি খরচ করে স্যানেটারি প্যাড ব্যবহার করাকে গায়েত্রীর কাছে অহেতুক বিলাসীতা বলে মনে হয়। স্বামীকে প্যাডের প্যাকেটটা দোকানে ফিরিয়ে দিতে বলে। কিন্তু ফার্মেসির মালিক বিক্রিত পণ্য ফেরত না নেয়ায় প্যাডের প্যাকেট নিজের কাছে রাখতে বাধ্য হয় লক্ষ্মীকান্ত।
হতাশ লক্ষ্মী যখন ওয়ার্কশপে কাজে ব্যস্ত তখন হঠাৎ তার এক সহকর্মী দূর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়। হাত থেকে রক্ত ঝড়তে থাকে। পরিষ্কার কাপড় বা তুলো না পেয়ে লক্ষ্মীকান্ত প্যাডের প্যাকেট ছিঁড়ে একটা স্যানেটারি প্যাড দিয়ে জরুরী অবস্থায় রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করে। এরপর তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। সহকর্মীর চিকিৎসা শেষে ডাক্তারের সাথে কথা বলে নারীদের রজঃস্রাবের সময় ব্যবহৃত নোংরা, অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহারের ফলে নারীরা বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, এব্যাপারে প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে।
বাড়ি ফেরার পথে প্যাকেটে থাকা আরেকটা প্যাড ছিঁড়ে ভেতরে কী উপাদান আছে সেটা দেখার চেষ্টা করে লক্ষ্মীকান্ত। বোঝার চেষ্টা করে এত হালকা-পাতলা একটা জিনিসের দাম কেন ৫৫ রুপি রাখা হচ্ছে। দেখতে পায় কিছু তূলা আর প্যাকেট ছাড়া প্যাডে আর কিছুই নেই। লক্ষ্মীকান্ত ভাবে, এই সামান্য জিনিসের জন্য এত দাম রাখছে প্যাড কোম্পানীগুলো? আর এমন উচ্চমূল্যের কারণেই গরীব, নিম্নবিত্ত নারীরা প্যাড ব্যবহারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই তিনি নিজেই সাশ্রয়ী মূল্যে প্যাড বানানোর পদক্ষেপ নেন।
কিন্তু চাইলেই কি আর মানসম্মত প্যাড বানানো যায়? কারিগরি স্বল্পতা, জ্ঞানের অভাব, সামাজিক বাধা ইত্যাদি পেরিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে যাওয়া কি খুব সহজ কিছু? লক্ষ্মীকান্তের এই দুঃসাহসী পদক্ষেপ কীভাবে সামনে এগিয়ে যায় তা জানতে হলে দেখতে হবে প্যাড ম্যান।
রিভিউ
২ ঘণ্টা ২০ মিনিট ব্যপ্তির প্যাড ম্যান শুরু থেকেই বিভিন্ন মজার ও অর্থবহ দৃশ্যের গাঁথুনিতে দর্শকদেরকে মসৃণ গতিতে গল্পের ভেতরে টেনে নিয়ে যায়। যদিও সিনেমাটির শেষ অংশে এই গতির ছন্দপতন চোখে পড়ার মতো।
নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অক্ষয় কুমার। লক্ষ্মীকান্ত চরিত্রটাকে যেন একদম নিজের করে নিয়েছেন তিনি। অক্ষয় কুমারের অভিনয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী দিক ছিল তার সাবলীলতা ও বাস্তবসম্মত উপস্থাপনা। দর্শককে বিশ্বাস করাতে পেরেছেন, তিনিই লক্ষ্মী। গ্রামের সহজ, সরল মেকানিক লক্ষ্মীকান্ত। অক্ষয় কুমার যতবার দৃশ্যে উদয় হয়েছেন অভিনয় দিয়ে দর্শকের দৃষ্টি কেড়ে নিজের উপর রেখেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অন্যদিকে লক্ষ্মীকান্তের স্ত্রী গায়েত্রী চরিত্রে রাধিকা আপ্তে ছিলেন দুর্দান্ত। সমাজের রীতিনীতির বাইরে পা দিতে ভয় পাওয়া গ্রাম্য বধূর চরিত্রটি যেন তার জন্যই যথার্থ। অভিনয়ে কোনো বাড়াবাড়ি নেই। তার প্রতিটি অভিনয় ছিল বাস্তবসম্মত।
সিনেমায় সোনম কাপুর একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। নিজের চরিত্রের প্রতি তিনিও অবিচার করেননি।
চলচ্চিত্রে একইসাথে বিনোদন ও সামাজিক বার্তা প্রদান করা সহজ কাজ নয়। পরিচালক আর. বালকি এই সিনেমার মাধ্যমে সেই চেষ্টা করেছেন এবং তিনি সফলও হয়েছেন।
সিনেমায় ব্যবহৃত সঙ্গীতগুলো কাহিনীর সাথে মানানসই ও চমৎকার ছিল। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন অমিত ত্রিবেদী। ক্যামেরায় ছিলেন পি. সি. শ্রীরাম। সম্পাদনার কাজটা মন্দ করেননি চন্দন অরোরা। সিনেমাটির ধারা বর্ণণায় ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন। ভারতসহ পুরো বিশ্বজুড়ে সিনেমাটির পরিবেশনার দায়িত্ব পালন করেছে আন্তর্জাতিক পরিবেশক সনি পিকচার্স রিলিজিং।
স্যানেটারি প্যাড নিয়ে সিনেমা পৃথিবীর অন্য কোথাও নির্মিত হয়েছে কিনা জানা যায়নি। সেখানে ভারতের মতো রক্ষণশীল দেশে এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে সিনেমা নির্মাণ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার।
বক্স অফিস
‘পদ্মাবত’ চলচ্চিত্রকে ব্যবসার সুযোগ করে দিয়ে নির্ধারিত তারিখ থেকে পিছিয়ে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে মুক্তি পায় প্যাড ম্যান। ২০ কোটি রুপি বাজেটে নির্মিত সিনেমাটি ভারতের বক্স অফিসে প্রথম দুই সপ্তাহেই আয় করে নেয় ৭৬.৬৫ কোটি রুপি। এছাড়া আন্তর্জাতিক বক্স অফিস মিলিয়ে মোট ১২০ কোটি রুপিরও বেশি ব্যবসা করে নেয়।
রেটিং
আইএমডিবি: ৮.২/১০ (৭,৫৮২ ভোট)
রটেন টমেটোস: ১০০% ফ্রেশ (১০ টি রিভিউ)
Featured Image: HDMovie8