কত খারাপ ছবিই তো তৈরি হয়। হিসেব করতে গেলে আমরা হয়তো দেখতে পাবো ভালো মুভির চেয়ে বস্তাপচা মুভির সংখ্যাই বেশি। এই বস্তাপচার মধ্যেই কিছু ছবি আবার হয় অতিমাত্রায় বস্তাপচা। যখন আপনার সিনেমা অতিমাত্রায় বস্তাপচা হয়ে যাবে, তখন আর সেটা বিরক্তিকর থাকবে না। সেটা হয়ে যাবে হাস্যকর। দর্শক তখন সিনেমার সিরিয়াস দৃশ্যগুলোতেও খেঁক খেঁক করে হেসে উঠবে। একটা পরিচিত উদাহরণ হতে পারে অনন্ত জলিলের ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’। জলিলের হার্ট বের করে আনার দৃশ্যটি ছিল সিনেমার চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স। কিন্তু আপনি হয়তো একজনও দর্শক পাবেন যে ওই দৃশ্য দেখে হাসে নি।
বিনোদনের জন্য আমরা অনেক সময় এসব বাজে বা সস্তা মুভি দেখি। এটাকে বলা হয় ‘গিল্টি প্লেজার’। আমেরিকার সিনেমাপ্রেমীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় গিল্টি প্লেজার মুভিটির নাম হচ্ছে ‘দ্য রুম’। ২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে মুভি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মার্কিনীরা মজা করে বলে ‘The greatest bad film ever made’। সিনেমাটি কতটা নিম্নমানের তা বুঝাতে এটিকে বলা হয় ‘বাজে মুভির সিটিজেন কেইন’।
হাজার হাজার আমেরিকানের মত ফ্রাঙ্কো ভাইদেরও (জেমস ফ্রাঙ্কো, ডেভ ফ্রাঙ্কো) সবচেয়ে পছন্দের গিল্টি প্লেজার ফিল্ম ছিল দ্য রুম। তাই ২০১৪ সালে যখন এই মুভি তৈরির কাহিনী নিয়ে বই লিখেন দ্য রুমের অন্যতম অভিনেতা গ্রেগ সেস্টেরো, তখন জেমস ফ্রাঙ্কো প্রথমবারের মত চিন্তা করেন, এই অদ্ভুত সিনেমা বানানোর পিছনের ঘটনা নিয়েও তো একটা মুভি বানানো যায়। এ বছর গোল্ডেন গ্লোব জয়ী ও অস্কারে মনোনীত হওয়া ‘দ্য ডিজাস্টার আর্টিস্ট’ সেই চিন্তারই ফসল।
প্লট
সান ফ্র্যান্সিসকো, ১৯৯৮; অভিনয় ক্লাসে পাগলাটে টমি ওয়াইজোর সাথে দেখা হয় ১৯ বছর বয়সী গ্রেগ সেস্টেরোর। ‘এ স্ট্রিকার নেমড ডিজায়ার’ এর একটি অংশ সবার সামনে যখন অভিনয় করে দেখাচ্ছিল সেস্টেরো, তার বাজে অভিনয় দেখে পুরো ক্লাস হেসে ওঠে। বিমর্ষ হয়ে দর্শক সারিতে গিয়ে বসে সেস্টেরো। আর তখনই কোথা থেকে যেন এসে একই দৃশ্য অভিনয় করে দেখায় টমি। তার অভিনয়ে দর্শক সারির সবাই আরও দমকা হাসিতে ফেটে পড়ে। কিন্তু তাদের ব্যাঙ্গাত্মক হাসিতে ভ্রুক্ষেপ নেই টমির। টমির এই ‘ভ্রুক্ষেপ না করা’ দৃষ্টিভঙ্গিতে মুগ্ধ হয় গ্রেগ।
কয়েকদিনের মধ্যেই খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায় টমি ও গ্রেগ। টমির চিন্তাভাবনা ও দর্শনের এক প্রকার ভক্ত হয়ে যায় মাত্রই টিন-এজ পেরোনো গ্রেগ। যখন সবাই তাকে দেখে হাসাহাসি করছে, তার কথাবার্তা অভিনয়কে ব্যাঙ্গ করছে তখন সবার দৃষ্টিকে এরকম বুড়ো আঙুল দেখিয়েই নিজের উপর বিশ্বাস রাখে টমি। স্বপ্ন দেখে হলিউড স্টার হওয়ার। টমিকে দেখে উৎসাহ পায় গ্রেগও। দুজন মিলে পাড়ি জমায় লস এঞ্জেলসে।
টমির দৃষ্টিভঙ্গি সাহসী ও প্রশংসার দাবি রাখলেও সমস্যা হচ্ছে, সে আসলেই খুব বাজে অভিনেতা। এটা সে জানে না এবং কেউ বললে বিশ্বাসও করে না। তার কথা বলার ধরনও অনেক হাস্যকর। যার ফলে অনেক চেষ্টা করে হলিউডের কিনারাতেও ঘেষতে পারে না সে, বরং বিভিন্ন জায়গায় হয় অপদস্থ। অবশেষে একদিন নিজেই একটি মুভির স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলে টমি ওয়াইজো। সিদ্ধান্ত নেয় নিজেই সিনেমা বানাবে সে। প্রধান নায়কের চরিত্রটি নিজেই নেয়, নায়কের বন্ধুর চরিত্রটি দেয় গ্রেগকে। মাঠে গড়ায় টমি ওয়াইজোর বিখ্যাত সিনেমা ‘দ্য রুম’, যার পরিচালক ও প্রযোজকও সে নিজেই।
রিভিউ
একটির সিনেমার গল্প নিয়ে আরেকটি সিনেমা তৈরির ইতিহাস হলিউডে কখনও তৈরি হয়নি। আর ‘দ্য রুম’ এর মত বস্তাপচা কোনো সিনেমার গল্প নিয়ে আরেকটি সিনেমা তৈরি হবে বা হতে পারে সেট প্রথমে কেউ চিন্তাও করতে পারেনি। আপাত দৃষ্টিতে অদ্ভুত ও হাস্যকর মনে হলেও পুরো ঘটনাটিকে নিখুঁতভাবে চিত্রায়ন করার পুরো ক্রেডিট জেমস ফ্রাঙ্কোকেই দিতে হবে। কেননা পুরো সিনেমাটি উঠে এসেছে ফ্রাঙ্কোর একান্ত ব্যক্তিগত ভিশন থেকে।
সিনেমার মূল কাহিনী নেয়া হয়েছে গ্রেগ সেস্টেরো ও টম বিসেলের লেখা ‘The Disaster Artist: My Life Inside The Room, the Greatest Bad Movie Ever Made’ থেকে। এই বই অবলম্বনে হাস্যরস মিশিয়ে খুবই বস্তুনিষ্ঠভাবে চিত্রনাট্য লিখেছেন স্কট নইস্টেটার ও মাইকেল উইবার, যার জন্য অস্কার নমিনেশনও পেয়েছেন তারা (অভিযোজিত চিত্রনাট্য ক্যাটাগরিতে)।
টমি ওয়াইজোর চরিত্রে জেমস ফ্রাঙ্কোর অভিনয় ছিল এককথায় দুর্দান্ত। তর্কসাপেক্ষে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে শক্তিশালী পারফরম্যান্সটি তিনি উপহার দিয়েছেন এই ছবিতে। টমি ওয়াইজোর কথা বলার ধরণ, অভিব্যক্তি, হাঁটাচলা সবকিছুই এতটাই নিখুঁতভাবে রপ্ত করেছেন যে বাস্তব টমির সাথে তা হুবহু মিলে যায়। স্বয়ং টমি ওয়াইজো স্বীকার করেছেন এই কথা। এরকম অসাধারণ পারফরম্যান্সের পরও ফ্রাঙ্কোর অস্কার নমিনেশন না পাওয়াটা এ বছরের অস্কারের একটি বড় স্নাব (Snub) হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গ্রেগের চরিত্রে ডেভ ফ্রাঙ্কোর অভিনয়ও প্রশংসার দাবি রাখে। সিনেমার কাহিনী যেহেতু গ্রেগের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়েছে তাই তার চরিত্রের সুস্পষ্ট দৃশ্যায়নটা ছবির গ্রহণযোগ্যতার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা খুব সফলভাবেই করতে সক্ষম হয়েছে ডেভ ফ্রাঙ্কো। কিন্তু এই দুটি চরিত্র বাদে সিনেমার বাকি সব চরিত্রই একপ্রকার অস্পষ্ট। তাদের দিকে তেমন আলোকপাত করার কোনো চেষ্টাই করা হয়নি, যা এই ছবির একটি বড় ত্রুটি।
পরিচালক হিসেবেও জেমস ফ্রাঙ্কো ষোল আনা প্রশংসার দাবি রাখেন। বাস্তব ঘটনাকে চিত্রায়ন করা এমনিতেই কঠিন। কিন্তু এই ছবিতে ফ্রাঙ্কো শুধু বাস্তব ঘটনার নিখুঁত চিত্রায়নই করে নি, বরং যেই ঘটনাকে নিয়ে মানুষ আজীবন অট্টহাসিই হেসে গিয়েছে সেটিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়েছেন। এর মাধ্যমে দিয়েছেন ইতিবাচক বার্তা। চলচ্চিত্র সমালোচকরা তো এই ছবির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেই, এমনকি টমি ওয়াইজোও করেছেন ভূয়সী প্রশংসা। তার মতে, সিনেমার ৯৯.৯%ই তার নিজের ঘটনার বাস্তব চিত্রায়ন।
‘দ্য ডিজাস্টার আর্টিস্ট’ একটি আদর্শ কমেডি মুভি। সিনেমার সংলাপ ও ফ্রাঙ্কোর অভিনয় আপনাকে সময়ে সময়ে হাসাবে এবং মুগ্ধ করবে। ছবির একদম শেষভাগে ‘দ্য রুম’ এর কিছু দৃশ্য এবং ডিজাস্টার আর্টিস্টের সেটে তার পুনর্নির্মিত রূপের একসাথে দৃশ্যায়নটি তর্কসাপেক্ষে সিনেমার সবচেয়ে উপভোগ্য অংশ। ছবিটি নিখুঁত করতে সেটের সবাই যে অনুকরণীয় প্রয়াস দিয়েছে তার স্মারক বহন করে এই অংশটি।
দ্য ডিজাস্টার আর্টিস্ট সম্পর্কে সান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকল তাদের রিভিউয়ে বলেছে, “সিনেমাটি বিস্ময়করভাবে হাস্যরসাত্মক। এটি আপনাকে ভীষণভাবে হাসাবে, তবে তা আপনার ইচ্ছে অনুযায়ী হবে না। যখন হাসাবে তখন আপনি চাইলেও মুখ বন্ধ রাখতে পারবেন না।”
ট্রিভিয়া
- ছবির কথা যখন টমি ওয়াইজোকে জানানো হয় এবং জিজ্ঞেস করা হয়, পর্দায় টমি ওয়াইজো হিসেবে তিনি কাকে দেখতে চান, তার সোজাসাপ্টা জবাব ছিল ‘জনি ডেপ’। সৌভাগ্যক্রমে, তার দ্বিতীয় পছন্দ ছিল জেমস ফ্রাঙ্কো।
- ‘দ্য রুম’ এর প্রচারণার জন্য লস এঞ্জেলসের যে বিলবোর্ডটি ব্যবহার করা হয়েছিল, দ্য ডিজাস্টার আর্টিস্টের বেলাতেও একই বিলবোর্ড ব্যবহার করেছে প্রচারণা সংস্থা।
- টমি ওয়াইজো সিনেমার ৯৯.৯%-ই বাস্তব চিত্রায়ন বলে মেনে নিয়েছেন। সিনেমার কোন জায়গায় বাকি .১% ত্রুটি রয়েছে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, প্রথম দৃশ্যে আলো কম ছিল। মজার বিষয় হচ্ছে, সিনেমা দেখার সময়ও টমি চোখে সানগ্লাস ছিল এবং ফ্রাঙ্কোর বিশ্বাস, এই কারণেই তিনি কম আলো দেখেছেন।
IMDB: ৭.৭/১০
রটেন টমেটোস: ৯১% ফ্রেশ
মেটাক্রিটিক: ৭৬/১০০
ফিচার ইমেজ: Screen Rant