টিভি সিরিজের ভক্তরা যখন স্ট্রেঞ্জার থিংস এর দ্বিতীয় সিজন নিয়ে চরম উত্তেজনায় মুখর, ঠিক তখন নেটফ্লিক্স আরেকটি দুর্দান্ত সিরিজ নিয়ে হাজির হয়ে তাক লাগিয়ে দেয় ভক্তদের। নাম তার ডার্ক। সাইনপসিস দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে এটি এত চমৎকার হতে যাচ্ছে। একদমই হতাশ করেনি নেটফ্লিক্স। মানীর মান রাখতে পেরেছে। দর্শকদের উদ্দেশ্যে একটি কথাই বলা যায়- না দেখলে বেশ বড় কিছু মিস করতে যাচ্ছেন।
আইএমডিবি সাইনপসিস ছোট্ট একটি ধারণা দিয়েছিল, সেখানে লেখা, জার্মানের ছোট এক শহরে দুই শিশুর উধাও হয়ে যাবার মাধ্যমে চারটি পরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্বের কাহিনী, আর সেই সাথে থাকছে অতিপ্রাকৃত চমক! শুরুতে তাই মনে হয় এ বুঝি কোনো জাদু বাস্তবতা নিয়ে সিরিজ। কিন্তু না, এটি যে সায়েন্স ফিকশন তা শীঘ্রই বুঝে নেয়া যায়।
এর কাহিনী এমন যে বেশি কিছু বললে স্পয়লার হয়ে যেতে পারে, তাই কাহিনীর গভীরে না গিয়ে বাইরে বাইরে থেকে কিছু তত্ত্বীয় আলোচনা করে নেব। পোস্টারে নেটফ্লিক্স জানিয়ে দিয়েছিল, সিরিজের কাহিনী আসলে সময়ের মারপ্যাঁচের সাথে জড়িত। পোস্টারেই লেখা- “The question is not Where, but When“। ছেলেগুলো যে হারিয়ে গেছে তার প্রশ্ন হতে পারে ‘কোথায়’ হারিয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্নটি এভাবে হবে না, প্রশ্নটিকে করতে হবে ‘কোন সময়ে’ হারিয়ে গেছে বলে।
গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্সের নাম হয়তো শুনে থাকবেন। সময় পরিভ্রমণ নিয়ে বিখ্যাত এক প্যারাডক্স এটি। ধরুন, আপনি অতীতে চলে যাবার একটি উপায় পেলেন কোনো একভাবে। অতীতে গিয়ে আপনার দাদাকে খুঁজে বের করলেন। এরপর তাকে খুনই করে ফেললেন। অথচ তখনো আপনার বাবার সাথে আপনার মায়ের পরিচয়ই হয়নি। সুতরাং, আপনার জন্মও হবার কথা নয়! অথচ এই আপনিই হলেন আপনার দাদার খুনী, কিন্তু দাদাকে আপনি কীভাবে খুন করলেন যেখানে আপনারই অস্তিত্ব থাকবার কথা নয়? অতীত পরিবর্তন করে দিয়ে আসলে ভবিষ্যতের কি পরিবর্তন হবে? সেটা পরীক্ষা করে দেখবার মতো প্রযুক্তি এখনো মানুষের হাতে আসেনি। আসার পর নাহয় আমরা বলতে পারবো কী হবে সত্যি সত্যি। ভবিষ্যৎ পরিবর্তীত হবে? নাকি, সম্পূর্ণ আলাদা একটি জগৎ তৈরি হবে?
আমাদের প্রত্যেকটি কাজ থেকে কি এভাবে আলাদা জগৎ তৈরি হচ্ছে? ধরুন, আপনি একটি কয়েন টস করলেন, সেখানে হেড উঠল, কিন্তু টেইল কি উঠতে পারত না? হতে কি পারে যে, হয়ত সে মুহূর্তে আরেকটি সমান্তরাল বাস্তবতা সৃষ্টি হলো যেখানে আপনারই সেই বিম্ব হেড পায়নি, বরং টেইল পেয়েছে? এভাবে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের কোটি কোটি কাজ থেকে কতগুলো জগৎ তৈরি হতে পারে?
আর যদি সমান্তরাল বাস্তবতা না তৈরি হয়, তবে নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎটাই বদলে যাবে। আমরা জানি না দেখেই গল্পকারেরা এ নিয়ে লিখে গেছেন নানা গল্প। তবে, সেই ১৯৩১ সালেই এ তত্ত্ব দেয়া হয়ে গিয়েছিল, আর Nathaniel Schachner রচিত ছোট গল্প Ancestral Voices-এ এ তত্ত্ব ব্যবহারও করেছিলেন। তাছাড়া René Barjavel এর লিখা ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত Future Times Three বইতেও এ থিয়োরি ব্যবহার করা হয়।
১৯১৫ সালের নভেম্বর মাসে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইন্সটাইন Prussian Academy of Science-এ একটি প্রেজেন্টেশন দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি কিছু সমীকরণ দেখান (মোটমাট ১০টি সমীকরণের সেট) যা আজ আইন্সটাইন ফিল্ড ইকুয়েশন নামে পরিচিত। এসব সমীকরণের মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেন আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বকে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিখ্যাত সমীকরণটি হলো-
এই আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব বা জেনারেল থিয়োরি অফ রিলেটিভিটিকে বলা হয় সবচেয়ে সুন্দর পদার্থবিজ্ঞানীয় তত্ত্ব। কিন্তু এই তত্ত্বের কথা কেন আনছি?
একটু আগে যে সমীকরণগুলোর কথা আনলাম সেগুলো সমাধান করলে আমরা যেটা পাই সেটাকে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় লরেঞ্জ ম্যানিফল্ড। এই সমাধানের একটি ধারণা হলো ওয়ার্মহোল (Wormhole)। স্থানকালের সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো বিন্দুকে যার মাধ্যমে সংযুক্ত। এর অর্থ হলো, ওয়ার্মহোল দিয়ে আপনি ইচ্ছে করলে হয়ত মহাবিশ্বের অন্য কোনো সময়ে অন্য কোনো স্থানে হাজির হয়ে যেতে পারেন, সেটা হতে পারে অন্য গ্যালাক্সিতে, হতে পারে অনেক অতীতে, কিংবা অনেক ভবিষ্যতে। যে ওয়ার্মহোল দিয়ে উভয় দিকেই যাওয়া যায় (অর্থাৎ যেদিক আপনি গেলেন, আবার সেদিক থেকে আগের জায়গা বা সময়ে ফিরে আসতে পারবেন) তাকে Schwarzschild wormhole বলে। এর আরেকটি নাম হলো Einstein–Rosen bridge; বিজ্ঞানী আইন্সটাইন ও নাথান রোজেনের নামে এর নামকরণ।
এই Einstein–Rosen bridge এর কথাই এসেছে ডার্ক সিরিজটিতে, কিন্তু এর তেমন কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। আগে থেকে তাই এতটুকু জানা থাকলে বুঝতে সহজ হয়ে পরবে।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নেটফ্লিক্স এ সিরিজের ব্যাপারে সবুজ পতাকা নাড়ে, নির্মাণ করা শুরু হয় ১০ পর্বের প্রথম সিজন। বলা হয়েছিল, প্রতি পর্ব হবে এক ঘণ্টা দীর্ঘ। ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর শুটিং শুরু হয় বার্লিন ও এর আশপাশের এলাকায়। শেষ হয় ২০১৭ সালের মার্চ মাসে। 4K রেজুলেশনে শুটিং করা হয়েছিল সিরিজটির। এটা মূলত নেটফ্লিক্সের প্রথম জার্মান ভাষায় করা সিরিজ, তবে চিন্তার কিছু নেই, সাথে ইংলিশ অডিও দেয়াই থাকে। আর সাবটাইটেল তো আছেই, তবে যে ডাবিং করা হয়েছে তার সাথে আসলে সাবটাইটেল মেলে না বিধায় কিছুটা বিরক্ত লাগতে পারে। অফিশিয়াল সাবটাইটেল অন্তত মেলা উচিৎ ছিল বৈকি।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরের এক তারিখ নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায় পুরো সিরিজটি। প্রথম সিজনটি চমৎকারভাবে গ্রহণ করে সমালোচক ও দর্শকবৃন্দ। অনেকে বলেছেন, এর সাথে নব্বই এর দশকের Twin Peaks টিভি সিরিজের বেশ মিল রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি করা হয়েছে স্ট্রেঞ্জার থিংস সিরিজের সাথে তুলনা। তবে স্ট্রেঞ্জার থিংস এর আশায় বসে থাকা দর্শকদের জন্য এ সিরিজটি ছিল অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতোই। তবে অনেক সমালোচকের মতে, এ সিরিজটি স্ট্রেঞ্জার থিংস এর চাইতেও গভীর এবং টুইন পিক্স এর চাইতেও শক্তিশালী।
৩১ জানুয়ারি, ২০১৭ তারিখ পর্যন্ত সিরিজটি IMDb-তে ৮.৭/১০ রেটিং নিয়ে আছে। আর রটেন টমেটোজের টমেটোমিটারে ৮৪% পেয়েছে, অবশ্য দর্শক স্কোর ৯৩%! এত সাড়া দেখে নেটফ্লিক্স ইতোমধ্যে বসে পরেছে সিজন ২ নিয়ে, যার শুটিং শুরু হচ্ছে এ বছরেই! আপনি যদি নেটফ্লিক্স সিরিজের ভক্ত হয়ে থাকেন আর স্ট্রেঞ্জার থিংস আপনার পছন্দের তালিকায় থাকে, তবে ডার্ক সিরিজটি যেন আপনার জন্যই বানানো! আর ইতোমধ্যে দেখে থাকলে আপনার মতামত আমাদের জানাতে ভুলবেন না যেন।
ফিচার ইমেজ: litreactor.com