আচ্ছা, আপনাদের মনে কখনো প্রশ্ন জাগেনি যে, ফেসবুক তো তাদের কোনো সেবা ব্যবহারের জন্য আমাদের কাছ থেকে কোনোরকম টাকা-পয়সা নেয় না, তাহলে তারা কীভাবে পৃথিবীর ধনী কোম্পানিগুলোর মাঝে একটি হয়ে গেল? কীভাবেই বা ফেসবুক বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করে? অথবা, ভাবুন তো, ইউটিউব, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম এরা আসলে কী বিক্রি করে? কীভাবে এত বেশি পরিমাণ অর্থ আয় করে? গুগল ঠিক কোন কারণে আপনার পুরো ফোনের এক্সেস নেয়?
ঠিক এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এবং সাথে আরো গভীর ও রোমাঞ্চকর কিছু সত্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি অসাধারণ ডকুমেন্টারি- ‘দ্য সোশ্যাল ডিলেমা’।
নেটফ্লিক্সের দেড় ঘন্টার এই ডকুমেন্টারি ফিল্মটি দেখার পর আপনার মস্তিষ্কে মোটামুটি একটা শিহরণ বয়ে যাবে, খানিকটা অবশ অবশ ভাব নিয়েই আপনি উপলব্ধি করবেন যে আমরা আসলে কীসের মধ্যে আছি কিংবা কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি! এটি এমন একটি ডকুমেন্টারী ফিল্ম, যা সকলেরই দেখা উচিৎ। বোঝা উচিৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আমরা কীভাবে পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর অন্ধকার দিক নিয়েই এটি তৈরি করা হয়েছে। অ্যামি অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত পরিচালক জেফ ওরোলস্কি এর পরিচালনা করেছেন।
প্রথমেই ব্যাখ্যা করা যাক যে প্রকৃত অর্থে ‘ডিলেমা’ বলতে কী বোঝায়। ‘ডিলেমা’ শব্দটির বাংলা অর্থ দ্বিধা, দোটানা বা উভয়সঙ্কট। মূলত, দুই ধরনের নীতি, যেখানে দুটো একইসাথে সমানভাবে জরুরি কিংবা প্রয়োজনীয়, আবার একইসাথে ক্ষতিকরও, এমন কিছুর মধ্যে থেকে একটাকে বেছে নেয়া বা ছেড়ে দেয়াকে ডিলেমা বলে। এটি এমন একটা অবস্থা যখন কোনো একটা কিছুকে ছেড়েও দেয়া যায় না আবার ধরেও রাখা যায় না!
এখন মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন না এমন মানুষ খুব কমই আছেন। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার ছাড়া আমাদের চলেই না। স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোক- সবাই ব্যস্ত ইন্টারনেট জগতে নিয়ে; হোক তা যোগাযোগের মাধ্যম কিংবা বিনোদনের।
আমরা অনেকেই বুঝতে পারি যে এসবের ফলে অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে। অনেকেই অনেক চেষ্টাও করেছি দূরে থাকার, কিন্তু তবুও এই জাল থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছি না। আধঘন্টার জন্য সময় কাটাবো বলে কাটিয়ে দিচ্ছি চার-পাঁচ ঘন্টা, এমনকি সারা দিনও! কিন্তু একবারও কি আমরা নিজেদেরকে প্রশ্ন করেছি- কেন এমন হয়? কেন আমরা মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যম একটু দূরে রেখে নিজেকে সময় দিতে পারছি না? কেন আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা নিউজফিড স্ক্রল করে যাচ্ছি? কিংবা একের পর এক ইউটিউবে রিকমেন্ডেড ভিডিও দেখেই চলছি?
এই কারণগুলোই ডকুমেন্টারিটিতে খুব সুন্দর এবং সাবলীলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটি একদিকে যেমন আপনার চোখ খুলে দেবে, তেমনই এটাও উপলব্ধি করাবে যে আসলে আমরা আমাদের মূল্যবান জীবনটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি।
এই ডকুমেন্টারিতে বলা অনেক কথা নিঃসন্দেহেই আপনার মনে গেঁথে যাবে। সেগুলোর মধ্যে দুটো উল্লেখ করা যায়।
প্রথমটি হলো,
If you’re not paying for the product, you’re the product!
আমাদের বহুল ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে আমাদের মূল্যবান সময় এবং মনোযোগকে কেন্দ্র করেই বিশাল বাণিজ্য চলছে। আদতে বিনামূল্যে হলেও আমরা আসলে এখানে বছরের পর বছর ধরে বিক্রি হয়ে চলেছি।
অন্য উক্তিটি হলো,
Never before in history have 50 designers made decisions that would have an impact on two billion people!
সত্যি বলতে কী, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগসহ যে সমস্ত অ্যাপ্লিকেশন অনলাইন কমিউনিকেশনে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার সবগুলোই বিশেষভাবে ডিজাইন করা। আর এই ডিজাইন করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে হিউম্যান সায়েন্স, মাথায় রাখা হচ্ছে হিউম্যান সাইকোলজি। ওয়েবসাইটের কালার থেকে শুরু করে কনটেন্ট ডিসপ্লে লে-আউট পর্যন্ত সবকিছুই এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে ব্যবহারকারীকে আরো বেশি সময় ধরে সংযুক্ত রাখা যায়।
এখন আসা যাক সোশ্যাল ডিলেমার আলোচ্য বিষয় এবং উপরে করা প্রশ্নগুলোর কিছু সরল উত্তর নিয়ে। পূর্বে উল্লেখিত একটি প্রশ্ন আবার করা যাক। আপনি বা আমি কেউই তো ফেসবুককে একটি টাকাও দিই না, তাহলে ফেসবুক আসলে টাকা পায় কোথায় থেকে? আপনি হয়তো চট করে বলবেন, ফেসবুকে যাদের বিজ্ঞাপন দেখানো হয় তারা দেয়।
বেশ, একদম ঠিক। তারাই দেয় টাকা। ফেসবুকের মূল আয়ের উৎস ঐ বিজ্ঞাপনগুলোই। এবার তাহলে ভাবুন তো, এই বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্য তারা আসলে কী বিক্রি করছে? একটু ভেবে দেখলেই বুঝবেন যে, তারা আসলে আপনাকে-আমাকে বিক্রি করছে! আপনার যে মনোযোগ বা আপনার যে সময় আপনি ফেসবুক কিংবা অন্যান্য সাইটে খরচ করেন এবং আপনার প্রচুর সংখ্যক তথ্য ঐ সাইটগুলোতে প্রতিমুহূর্তে দিতে থাকেন, তারা সেগুলোই বিভিন্ন অ্যাড এজেন্সি কিংবা অন্যান্য কোম্পানির কাছে সরবরাহ করে বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্য!
মূলত এটিই হলো ফেসবুক কিংবা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার প্রধান বিজনেস মডেল। তারা সবসময়ই চেষ্টা করে যেন একজন মানুষ তার সর্বোচ্চ সময় এবং মনোযোগ তাদের ঐ বিশেষ অ্যাপ কিংবা সেবায় ব্যায় করে। এজন্য তারা নিত্যনতুন আপডেটসহ নতুন নতুন ফিচার ও ট্রেন্ড একটার পর একটা আনতেই থাকে!
আপনি স্বাভাবিক দৃষ্টিতে মনে করেন, এটা এমন একটা মাধ্যম যা আমাদের জীবনকে সহজ করে, দূরের মানুষদেরও কাছে নিয়ে আসে। কিন্তু ঠিক একই সময়ে, তাদের বিজনেস মডেল যেহেতু এমন যে, আপনার সর্বোচ্চ মনোযোগ তারা নেয়ার চেষ্টা করবে, তাই বাস্তবিক দৃষ্টিতে এখানে সময় দিতে গিয়ে আপনি আপনার কাছের মানুষদের সাথে দূরত্ব বাড়াচ্ছেন কিংবা আপনার পাশেরই সত্যিকার মানুষগুলোকে আপনার যতটুকু সময় দেবার কথা ছিল, আপনি সেটি দিতে পারছেন না বা দিচ্ছেন না। ঠিক এই জায়গাতেই হলো ডিলেমা বা দ্বন্দ্ব!
আপনার-আমার ব্যক্তিগত তথ্যগুলো ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজ ফিড ম্যনিপুলেট করা হচ্ছে। আপনি-আমি মনে করছি যে, আমরা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে সুবিধা নিচ্ছি, আদতে কিন্ত বিষয়টি উল্টো! প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদেরই ব্যবহার করছে তাদের মুনাফার জন্য। বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পরিকল্পিতভাবে মানুষকে অভ্যস্ত করা হচ্ছে, যার ফলে পরিবর্তিত হচ্ছে মানুষের আচরণ এবং অভ্যাস। তৈরি হচ্ছে সোশ্যাল ডিলেমা বা সামাজিক সংকট।
ব্যবহারকারীকে অ্যাপে কয়েক ঘণ্টা ধরে রাখতে পারলে, অনেক বিজ্ঞাপন দেখানো যায়। আর এই বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্য প্রত্যেকের নিউজফিড সাজানো হয় আলাদাভাবে। দুজন ব্যক্তির মাঝে খুব মিল থাকলেও তাদের ফেসবুকের নিউজফিড হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ প্রত্যেক ব্যবহারকারীর জন্য আলাদা বিজ্ঞাপন, পোস্ট ও নিউজ দিয়ে নিউজফিড সাজায় ফেসবুকের অ্যালগরিদম।
যখন ফেসবুকের লাইক বাটন চালু করা হয়, তখন কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল এটি মানুষের মধ্যে ইতিবাচকতা ছড়াবে। কিন্তু তারা চিন্তাও করেনি যে, মানুষ এই লাইক নিয়ে কোনো অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে যেতে পারে- কার লাইক কত বেশি! পরবর্তীতে এটাকে ধরে তারা তাদের পরিকল্পনা সাজিয়েছে। আপনি মনে করেন, ফেসবুকে শুধু লাইক বাটনের পরিবর্তে আরও ছয়টি প্রতিক্রিয়া যোগ করা হয়েছে আমাদের ভাবকে আরো বেশি করে প্রকাশ করার জন্য। এটি হতে পারে আপনার দৃষ্টিতে সত্যি। কিন্তু এর অপরদিকের সত্যটা হলো, আগে আপনি শুধু দেখতেন আপনার ছবিতে কতটি লাইক পড়েছে। কিন্তু এখন দেখেন কতটি লাইক, কতটি লাভ, কতটি ওয়াও কিংবা কতটি হা-হা এসেছে।
এই ছোট্ট পরিবর্তনই অনেক বড় রকমের ব্যবধান তৈরি করে দেয়! এর দ্বারা ঠিক কার কাছ থেকে আপনি কতটুকু এবং কীরকম মনোযোগ অথবা প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন তা মনে গেঁথে রাখছেন এবং এটি করার জন্য আপনাকে আগের থেকে অনেক বেশি করে ফেসবুকের সাথে যুক্ত থাকতে হচ্ছে। আরও বেশি সময় ও মনোযোগ দিতে হচ্ছে। আরো বড় বিষয় হচ্ছে- একে আবার আপনি বাস্তব জীবনের গুরুত্বের মাপকাঠিতেও ফেলছেন! অথচ এই পুরো বিষয়গুলো হলো ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্ক কোম্পানিগুলোর বিজনেস মডেল তাদের সেবার মধ্যে আপনাকে আটকে ধরে রাখার জন্য, যেন আপনি আপনার সর্বোচ্চ সময় এবং মনোযোগ সেখানেই দিতে থাকেন!
বর্তমান সময়ের খুবই আলোচিত একটি বিষয় হলো ডিপ্রেশন অর্থাৎ বিষণ্নতা। আপনি একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন, সোশ্যাল মিডিয়াগুলো যেমন আপনাকে একটা জায়গা করে দিয়েছে নিজের বিষণ্নতা বা মানসিক অবস্থা নিয়ে কথা বলার জন্য, ঠিক তেমনই বিভিন্ন জায়গা থেকে, বিভিন্নভাবে এরাই আপনার বিষণ্নতার একটা বড়সড় কারণ হিসেবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করছে। আপনার-আমার মানসিকতা, চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি, মতামত কিংবা রুচির অনেক কিছুই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে এই সোশ্যাল মিডিয়াগুলো।
এই লেখায় শুধুমাত্র ফেসবুকের কথাই বেশি করে বলা হচ্ছে, কেননা ফেসবুক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এবং একইসাথে আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। তবে সোশ্যাল ডিলেমা ডকুমেন্টারিতে পুরো দেড় ঘন্টা জুড়ে ফেসবুক, গুগল থেকে শুরু করে প্রতিটি অনলাইন সার্ভিস কীভাবে আমাদের জীবনকে গ্রাস করে এবং এর থেকে আমরা কীভাবে নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি সেই সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
আমরা বিভিন্ন সিনেমা-কল্পকাহিনী দেখে বা পড়ে যে কল্পনা করি- একদিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদেরকে দখল করে নেবে, সেটা হবার আগেই এই সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর সুনিপুণ বিজনেস মডেল ও প্ল্যানিং, অতি দক্ষ অ্যালগরিদম আর আমাদের খামখেয়ালি মনোভাব বা অসচেতনতা ইতোমধ্যেই আমাদের অনেক কিছুর দখল নিয়ে নিয়েছে!
আমাদের ব্যক্তিগত সকল তথ্য তাদের কাছে আছে, তারা আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, প্রকাশ্য-গোপনীয়, এমনকি ব্যক্তিসত্তা সম্পর্কেও এত বেশি জানে যা হয়তো আমাদের খুব কাছের কেউ বা আমরা নিজেরাও জানি না! শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও এটিই সত্যি এবং অনেক বড় রকমের সত্যি! অথচ আমাদের সাথে এত কিছু করার অধিকার আমরা নিজেরাই তাদের দিয়েছি, আমরা নিজেরাই তাদের সকল ‘টার্মস এন্ড কন্ডিশন্স’ মেনে নিয়েই তাদের সার্ভিস নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে যাচ্ছি! কিন্তু মজার অথবা দুঃখের বিষয় হলো, এই এত কিছুর কিছুই কিন্তু আমরা জানছি না, উপলব্ধি করছি না!
‘দ্য সোশ্যাল ডিলেমা’ আমাদের সামনে এই বিষয়গুলোই তুলে ধরে, সোশ্যাল মিডিয়ার উল্টোদিকের সত্যিগুলো আমাদেরকে উপলব্ধি করতে বাধ্য করে!