Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দখল: যে উপন্যাসের উপজীব্য ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড

শবে বরাতের রাত। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা সবাই মসজিদে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল। একটা দোকানের শাটার তুলে ভেতরে ঢুকল কয়েকজন যুবক। শাটার নামিয়ে দিল। একটু পর দোকানের ভেতর থেকে ভেসে এলো গুলির আওয়াজ। স্বপন নামের এক তরুণকে হত্যা করে বেরিয়ে এলো যুবকেরা। স্বপন কিন্তু তাদের শত্রু নয়, বরং বন্ধু ছিল। কিন্তু আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্ধকার জগত এতটাই নিষ্ঠুর যে, এখানে স্বার্থের কারণে বন্ধুকেও খুন করতে হয়। এটা ছিল ঢাকার আশকোনায় ২০০০ সালের দিকে ঘটে যাওয়ায় একটি বাস্তব ঘটনা।

উপন্যাসটির প্রচ্ছদ; Source: নালন্দা

“দখল” নামের উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে বারবার উপরোক্ত ঘটনাটি মনে পড়ছিল। কারণ “দখল” এমন একটি ফিকশন যেটা ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন ফ্যাক্টের উপর নির্ভর করে লেখা। খুব সম্ভবত বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে এরকম ফ্যাক্ট নির্ভর গ্যাংস্টার উপন্যাস এটাই প্রথম।

কাহিনী

জেনিফার পেশায় শিক্ষিকা এবং কবি অনিন্দ্য আকাশের কবিতার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত। কবির কবিতাগুলো তার প্রচণ্ড ভাল লাগে। অনিন্দ্য আকাশও জেনিফারকে পছন্দ করে, ভালবাসে মনে মনে, ওকে নিজের করে পাওয়ার বাসনা পোষে। কিন্তু জেনি শুধু কবিতাকেই ভালবাসে, কবিতার রচয়িতাকে নয়। কবি অনিন্দ্য আকাশকে সে স্রেফ কবি, বন্ধু হিসেবে দেখে। একদিন জেনিকে নিয়ে গাজীপুরে নিভৃতে সময় কাটাতে যায় কবি অনিন্দ্য আকাশ। কিন্তু কৌতূহলী জেনির কারণে সব ওলট-পালট হয়ে যায়।

লিডার জাহাঙ্গীরকে খুন করে তার জায়গা দখল করতে চাচ্ছে ডেভিড। গাজীপুরের ভাওয়াল জঙ্গলের গভীরে কবর খোঁড়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরকে জ্যান্ত মাটি দেয়া হবে। প্রস্তুতি চলছে।

পৃষ্ঠা ৫০-এর অংশবিশেষ; ছবি: Sayeem Shams

জঙ্গলের ভেতরে মানুষের উত্তেজিত কথা শুনতে পেয়ে এগিয়ে যায় জেনি। দেখতে পায় একজন মানুষকে জীবন্ত পুঁতে ফেলার আয়োজন করছে কয়েকজন লোক। নিজের চোখের সামনে এরকম গর্হিত অপরাধ সংগঠিত হবে, এটা জেনি মানতে পারে না। কবি অনিন্দ্য আকাশের বারণ সত্ত্বেও সে ডেভিড ও তার লোকজনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এরকম অন্যায়ভাবে খুন করতে নিষেধ করে। ডেভিডকে বোঝানোর চেষ্টা করে হানাহানিতে নয়, প্রকৃত বীরত্ব প্রকাশ পায় ক্ষমায়।

ডেভিডকে উদ্দেশ্য করে জেনি বলে, “মানুষ আর অমানুষের মধ্যে পার্থক্য, মানুষ ক্ষমা করতে পারে, অমানুষ সেটা পারে না…”

ডেভিড পাল্টা প্রশ্ন ছোঁড়ে, “এই অমানুষের পৃথিবীতে আমার মানুষ হয়ে কী লাভ?”

জেনি জানায়, “মানুষ হলে মানুষের ভালবাসা পাওয়া যায়, আর অমানুষের জন্য শুধুই ঘৃণা।”

চ্যালেঞ্জ জানায় ডেভিড, “আপনি কি আমার মতো মানুষকে ভালবাসবেন?”

কোনো দ্বিধা ছাড়া জেনি জবাব দেয়, “যদি আপনি ক্ষমাশীল হন!”

নিজের দলের লোকদের আপত্তি সত্ত্বেও ডেভিড জাহাঙ্গীরকে ক্ষমা করে দেয়। প্রাণ নিয়ে পালাতে দেয় ওকে। ডেভিডের এই ক্ষমাশীল আচরণে মুগ্ধ হয় জেনি।

জাহাঙ্গীর বেঁচে গেলেও বিষয়টা গোপন রাখা হয় আন্ডারওয়ার্ল্ডের কাছে। ডেভিড লিডার হিসেবে দায়িত্ব নেয়। ৬ মাস পর ডেভিড জেনির সাথে যোগাযোগ করে। মনে করিয়ে দেয় সেদিন জেনি তাকে বলেছিল ক্ষমাশীল হলে ভালবাসবে।

জেনিকে নিজের করে পেতে মরিয়া কবি অনিন্দ্য আকাশ। কিন্তু জেনি তাকে প্রেমিকের দৃষ্টিতে দেখে না। উল্টো ডেভিডের প্রতি জেনি দুর্বল হয়ে পড়ছে। কবি অনিন্দ্য আকাশ কোনোভাবেই এটা মেনে নিতে পারে না। সে গোপনে গোপনে ডেভিডকে শেষ করে দেয়ার পরিকল্পনা আঁটতে শুরু করে। আন্ডারওয়ার্ল্ড লিডার ডেভিডের শত্রুর অভাব নেই। জেনিকে পাওয়ার জন্য তাদের সাথে হাত মেলায় কবি অনিন্দ্য আকাশ।

শেষ পর্যন্ত কী ঘটে? জেনিকে কে পায়? কবি অনিন্দ্য আকাশ নাকি আন্ডারওয়ার্ল্ড লিডার ডেভিড? জানতে হলে পড়তে হবে ১৪২ পৃষ্ঠার টানটান উপন্যাস “দখল”।

রিভিউ

“দখল” একটি বিনোদনধর্মী থ্রিলার উপন্যাস। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাংগঠনিক কাঠামো, বিভিন্ন অলি-গলি ও দেশের রাজনীতির সাথে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সংযোগগুলো পাঠকদেরকে বিস্মিত করবে। ভালবাসা মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে, তা বেশ মোটাদাগে ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। হিরো থেকে ধীরে ধীরে এন্টি-হিরো হয়ে ওঠা কবি অনিন্দ্য আকাশ আর আন্ডারওয়ার্ল্ডের লিডার থেকে আস্তে আস্তে ক্ষমাশীল মানুষ হয়ে ওঠা ডেভিড; এই চরিত্র দুটি তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।

২০১৮ সালের বইমেলায় অন্যতম বেস্টসেলার উপন্যাস ছিল দখল; Source: নালন্দা

অনিন্দ্য আকাশ রচিত কবিতাগুলো চোখে পড়ার মতো।

আমার বাম পকেটে গোলাপ আছে
ডান পকেটে গন্ধরাজ
যতই দেখাও সাঁজোয়া বহর
চোখ রাঙানো কুঁচকাওয়াজ।
থামাও তুমি রাষ্ট্র দখল
হৃদয় অবরুদ্ধ
তোমার সাথে এবার হবে
শুদ্ধ হবার যুদ্ধ…

মেদহীন, দ্রুতগতি সম্পন্ন “দখল” লেখক লতিফুল ইসলাম শিবলীর দ্বিতীয় উপন্যাস। থ্রিলার সুলভ টুইস্ট না থাকলেও পরিপাটি, সাবলীল লেখনশৈলী, চমকপ্রদ ফ্যাক্টস ও বেশ কিছু নান্দনিক সংলাপের সমন্বয়ে “দখল” হয়ে উঠেছে উপভোগ্য। তবে উপন্যাসটির প্লট অনুযায়ী ব্যপ্তিটা কম বলে মনে হয়েছে। বেশ কিছু পার্শ্ব-চরিত্রের উপর বিস্তারিত আলোকপাত করলে পাঠকদের কাছে বইটি আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারতো।

২০১৭ সালে প্রকাশিত লেখকের প্রথম উপন্যাস “দারবিশ”-এর মতো ২০১৮ সালের “দখল”ও বেস্টসেলার তকমা পেয়ে গেছে। তবে যারা আগে “দারবিশ” পড়েছেন তাদের অনেকের কাছ থেকে “দখল” খুব একটা আশাব্যাঞ্জক প্রতিক্রিয়া পায়নি। তাই যারা বই দুটি পড়ার পরিকল্পনা করছেন, তাদের জন্য প্রথমে “দখল” ও তারপর “দারবিশ” পড়ার পরামর্শ রইল।

লেখক পরিচিতি

লতিফুল ইসলাম শিবলী; একসময় এ দেশে যাঁরা ব্যান্ডসংগীতকে এগিয়ে নেন, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। গীতিকবি হিসেবেই খ্যাতি তাঁর। ৯০ দশক জুড়ে তিনশ’রও অধিক লিখেছেন। তুমি আমার প্রথম সকাল, জেল থেকে বলছি, পলাশীর প্রান্তর, হাসতে দেখো গাইতে দেখো, হাজার বর্ষার রাত, প্রিয় আকাশী, কষ্ট কাকে বলের মতো জনপ্রিয় গানের গীতিকার তিনি।

স্বভাবজাত বোহেমিয়ান লতিফুল ইসলাম শিবলী ঘুরেছেন এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার পথে-প্রান্তরে; Source: শিবলীর ফেসবুক প্রোফাইল

শুধু লেখার মাঝেই নিজেকে বন্দী করে রাখেননি বহুমুখী প্রতিভাধর শিবলী। নিজের লেখা, সুর, কম্পোজিশনে ও নিজের গলায় গাওয়া তাঁর প্রথম অ্যালবামের নাম ছিল “নিয়ম ভাঙার নিয়ম”।

শিবলী একজন সফল নাট্যকারও। বিটিভির স্বর্ণযুগে তাঁর লেখা প্রথম সাড়া জাগানো নাটক “তোমার চোখে দেখি”, এরপর “রাজকুমারী”। নিজের লেখা নাটক রাজকুমারীতে মির্জা গালিবের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ও করতে দেখা গেছে তাঁকে।

“দারবিশ” ও “দখল” নামের দুটি উপন্যাসের পাশাপাশি এ পর্যন্ত তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে- “ইচ্ছে হলে ছুঁতে পারি তোমার অভিমান”, “তুমি আমার কষ্টগুলো সবুজ করে দাও না”, “মাথার উপরে যে শূন্যতা তার নাম আকাশ, বুকের ভেতর যে শূন্যতা তার নাম দীর্ঘশ্বাস” । তাঁর রচিত “বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীত আন্দোলন” নামের একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। এদেশের ব্যান্ড সংগীতের ওপর লিখিত প্রথম ও একমাত্র নন-ফিকশন এটি।

“পদ্ম পাতার জল” সিনেমার একটি পোস্টার; Source: Tripod Studio

পদ্ম পাতার জল” নামের একটি বাংলা সিনেমার কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন লতিফুল ইসলাম শিবলী। ইমন, বিদ্যা সিনহা মীম অভিনীত এই চলচ্চিত্রটি ২০১৫ সালে মুক্তি পায়।

সাহিত্যে মাস্টার্স সম্পন্ন করা লতিফুল ইসলাম শিবলীর শৈশব-কৈশোর কেটেছে নাটোরে। ঢাকা ও লন্ডনে কাটিয়েছেন জীবনের পরবর্তী অংশটুকু। ওমর ও ওসমান নামের দুই ছেলের জনক তিনি।

বই প্রোফাইল

“দখল”-এর ব্যাককভার; ছবি: Sayeem Shams

বই: দখল

লেখক: লতিফুল ইসলাম শিবলী

জনরা: রোমান্টিক থ্রিলার

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৪২

বাধাই: হার্ডকভার

প্রকাশক: নালন্দা

প্রকাশকাল: বইমেলা ২০১৮

মূল্য: ৩০০ টাকা

ফিচার ইমেজ: নালন্দা

Related Articles