মানজিকার্টের যুদ্ধ আসন্ন, যে যুদ্ধের আয়োজন বাইজান্টাইন সম্রাট চতুর্থ রোমানোস ডায়োজিনিস করেছেন বেশ সঙ্গোপনে, শান্তিচুক্তিকে সামনে রেখে আড়ালে অশান্তির সকল রকম প্রস্তুতি নিয়ে।
সেলজুক সুলতান মুহাম্মদ বিন দাউদ, ইতিহাসে যিনি পরিচিত আলপ আরসালান (সাহসী সিংহ; আলপ = সাহসী, আরসালান = সিংহ) নামে, যখন আসন্ন এই আক্রমণ সম্পর্কে জানতে পারলেন, তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন আজারবাইজান অবরোধে। এমন সময় তার সামনে এই যুদ্ধ দুটো অপশন টেনে আনলো: ১) হয় বীরের সাথে মোকাবেলা করো, ২) নয় কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাও। বলা বাহুল্য, আলপ আরসালান বিনা দ্বিধায় প্রথম অপশনটিই বেছে নেন।
যুদ্ধে সেলজুক বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল বাইজান্টাইনদের তুলনায় অত্যধিক নগণ্য। বাইজান্টাইন বাহিনীতে ছিল ফ্রেঞ্চ, গ্রীক, রাশানসহ বিভিন্ন জাতির ২ লক্ষাধিক সেনা, ওদিকে সেলজুক বাহিনীতে সৈন্যসংখা মাত্র ১৫ হাজারের কাছাকাছি।
মূল যুদ্ধের আগে সংক্ষিপ্ত আরেক যুদ্ধে মুখোমুখি হয় দুই বাহিনী। এ সময় বাইজান্টাইনদের ১০ হাজার সদস্যের অগ্রবর্তী দলের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয় সেলজুক সেনারা। সংক্ষিপ্ত সেই যুদ্ধে পরাজিতও হয় বাইজান্টাইনরা। এরপর দূতের মাধ্যমে পত্র চালাচালি হতে থাকে সুলতান আলপ আরসালান ও সম্রাট রোমানোসের মাঝে। সেলজুক সুলতান চাচ্ছিলেন যুদ্ধবিরতি, ওদিকে বাইজান্টাইন সুলতান চাচ্ছিলেন মুসলিমদের হাতে রোমানদের পরাজয়ের শোধ তুলতে।
এই বার্তা চালাচালির সর্বশেষ পর্যায়ে রোমানোস দম্ভ সহকারে আলপ আরসালানকে লিখে পাঠান,
আমি এমন এক বাহিনী নিয়ে এসেছি, আপনি যার প্রতিরোধ করতে পারবেন না। তাই স্বেচ্ছায় আমার আনুগত্য মেনে নিন।
সৈন্যসংখ্যার স্বল্পতা থাকলেও আলপ আরসালান তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত ছিলেন না, বরং সবকিছু জেনেই যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছিলেন তিনি, সৈন্যদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এই যুদ্ধের প্রকৃত মর্ম সম্পর্কে। তাই তো এমন অহমিকাপূর্ণ জবাব পেয়ে তিনিও বীরের মতোই দূতকে বললেন,
তোমার মনিবকে বলো, আমার রব আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন যেন আমি তার প্রশংসা করতে পারি। আমার রব তোমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছেন যেন তোমরা মুসলিমদের খাবার রান্না করো।
উত্তপ্ত এই বাক্য বিনিময়ের পর যুদ্ধ ছিল অবধারিত, এবং সেটা হয়েও যায়। যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় বাইজান্টাইন বাহিনী, সেলজুকদের হাতে ধরা পড়ে তাদের সম্রাট। সৈন্যসংখ্যার এই আধিক্যও তাদের পরাজয় ঠেকাতে পারেনি। লেখার মূল বিষয় যুদ্ধের বর্ণনা না বিধায় সেই আলাপটি আপাতত তুলে রাখা হলো!
যুদ্ধের আগে দুই শাসকের বার্তা বিনিময়ের ঘটনাটি যেমন ইতিহাসে প্রসিদ্ধ, তেমনই ইতিহাসে স্থান পেয়েছে বন্দি রোমানোসের সাথে আলপ আরসালানের ব্যবহারও।
বাইজান্টাইন সম্রাটকে সুলতান আলপ আরসালানের সামনে হাজির করা হলে তিনি তাকে তিনবার বেত্রাঘাত করেছিলেন। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব গ্রহণ না করায় রোমানোসের তিরস্কারও করেন তিনি। এরপর দুই শাসকের কথোপকথন ছিল এমন:
আলপ আরসালান: তুমি যদি আমাকে বন্দী করতে তাহলে আমার সাথে কেমন আচরণ করতে?
রোমানোস: অত্যন্ত খারাপ কাজই করতাম।
আলপ আরসালান: তোমার কী ধারণা? আমি এখন তোমার সাথে কী করব?
রোমানোস: হতে পারে আপনি আমাকে হত্যা করবেন, অথবা ক্ষমা করে দেবেন। অথবা আরেকটি কাজও করতে পারেন, অবশ্য তা বলে লাভ নেই।
আলপ আরসালান: কী সেই কাজ?
রোমানোস: আপনি আমার কাছ থেকে কর নিয়ে আমাকে মুক্ত করে দিতে পারেন।
রোমানোসের এই বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে আলপ আরসালান তাকে ৫ লক্ষ দিনারের বিনিময়ে মুক্ত করে দেন। পাশাপাশি অ্যান্টিওক, এডেসা, হেরাপোলিস ও মানজিকার্টও সেলজুকদের হস্তগত হয়।
…
মানজিকার্টের যুদ্ধ, ইতিহাসে যে যুদ্ধটি পরিচিত ‘২য় ইয়ারমুক যুদ্ধ’ নামে, সেই যুদ্ধের আগে ও পরের সংক্ষিপ্ত কাহিনী দুটো তুলে ধরা হলো ইমরান রাইহান রচিত ‘সুলতান আলপ আরসালান’ বইটি থেকে।
মাত্র ৮০ পৃষ্ঠার এই বইয়ে লেখক অত্যন্ত যত্নসহকারে সেই সময়ের কথা তুলে ধরেছেন, যখন মুসলিম বিশ্ব বেশ বড় রকমের এক ক্রান্তিকাল পার করছে। তখন মুসলিমদের মাঝে ছিল না কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, ‘খলিফা’ পরিণত হয়েছে এক নামসর্বস্ব পদে, চারদিকে গড়ে উঠেছিল আন্তঃসম্পর্কহীন ও পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন ছোট-বড় অসংখ্য সালতানাত যাদের সকলেই সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার চেষ্টায় লিপ্ত, সেই সাথে শিয়াদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব তো ছিলই। এমন সময়ই ক্ষমতায় আসেন সুলতান আলপ আরসালান। এরপর কৌশলী ও সময়োপযোগী নেতৃত্বের মাধ্যমে ক্ষমতা সুসংহতকরণ, বিদ্রোহীদের দমন, শিয়াদের প্রভাব হ্রাস করা, সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি প্রভূত কর্মকাণ্ড বেশ কৃতিত্বের সাথেই এগিয়ে নিতে থাকেন তিনি। পাশাপাশি ক্ষমাশীলতা, দানশীলতা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার সম্প্রসারণেও অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন সুলতান।
লেখক এবং একইসাথে সম্পাদক হিসেবে ইমরান রাইহান কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে আসছেন বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই, যার অন্যতম প্রমাণ এই বইটি। তার ইতিহাস বিষয়ক লেখার অন্যতম বড় গুণ হলো, ইতিহাস সেখানে কেবলমাত্র কিছু সাল, ব্যক্তির নাম আর জানা-অজানা ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে আসে না, বরং সেগুলো আসে গল্পের ঢঙে, জীবন্ত হয়ে, যেন চোখের সামনেই ঘটে চলেছে সবকিছু। এই বইটিতেও সেই দক্ষতার ছাপ সুস্পষ্ট। সেই সাথে ইতিহাস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলোর দিকে বর্তমান প্রজন্মের প্রতি উদাত্ত আহ্বান তো রয়েছেই।
বইয়ের ভূমিকাতেই সুলতান আলপ আরসালানকে নিজের ‘শৈশবের নায়ক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন লেখক। তারুণ্যে এসে যখন সেই নায়ককেই বর্তমান প্রজন্মের বাংলা ভাষাভাষী তরুণদের সামনে নতুন করে তুলে আনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিলেন, তখন যে বেশ পরিশ্রমসাধ্য কাজই করতে হয়েছে তাকে, সেই কথা যেমন বইয়ের ভূমিকায় উল্লেখ রয়েছে, তেমনই পুরো বই জুড়ে বিস্তৃত তথ্যসূত্রের বিপুলতাও এর পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়।
নিঃসন্দেহে ইতিহাসপ্রিয় যেকোনো পাঠকের জন্য বেশ চমৎকার, সুখপাঠ্য এক বই এবারের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত বই ‘সুলতান আলপ আরসালান’। ইতিহাসের সাহসী এই সিংহ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিন্তু তথ্যবহুল উপায়ে জানতে আগ্রহী হলে বইটি অপেক্ষায় আছে আপনার বইয়ের তাকের শোভা বর্ধনের জন্যই!
…
বই: সুলতান আলপ আরসালান
লেখক: ইমরান রাইহান
মুদ্রিত মূল্য: ৮০/-
প্রকাশকাল: অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারি ২০২০
প্রকাশক: দারুল ওয়াফা
সুলতান আলপ আরসালান বইটি কিনতে ভিজিট করুন লিংকে।