সারগাসো (একবচনে সারগাসাম) হচ্ছে একধরনের সামুদ্রিক ভাসমান শৈবাল, যা অনেকটা জায়গা নিয়ে থাকে। sargasso sea বা শৈবাল সাগর হলো বিশাল সমুদ্রের মাঝে জলরাশির চক্রাকার আবর্তবিশিষ্ট স্রোতহীন জায়গা, যেখানে সামুদ্রিক শৈবাল ও আগাছা জন্মানোর ফলে জাহাজ ও নৌকা আর এগোতে পারে না। এটি মূলত উত্তর আটলান্টিক সাগরের এমন এক স্থান নির্দেশ করে, যা সামুদ্রিক শৈবাল জন্মানোর জন্য বিখ্যাত। এখানে আটকে যাওয়া জাহাজ না পারে আর সামনে এগোতে, না পারে স্থির ঢেউহীন পানিতে অন্যদিকে ঘুরে যেতে, কেবল বাতাসের ধাক্কায় দুলতে থাকে অসহায়ভাবে। এই শৈবাল সমুদ্রের নামেই জঁ রীস তার কালজয়ী অ্যান্টি-কলোনিয়াল উপন্যাস ‘ওয়াইড সারগাসো সি’ এর নামকরণ করেছেন। বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা, পরিস্থিতি আর পরাধীনতা কীভাবে শৈবালের সাগরে আটকে থাকা জাহাজের মতো জীবনকে স্থবির করে দিতে পারে, তা-ই তার এই উপন্যাসের উপজীব্য।
বলাই বাহুল্য, উপন্যাসটি রাজনীতির ছোঁয়া থেকেও মুক্ত নয়। এটি দেখিয়েছে ১৮৩৩ সালে আমেরিকায় দাসপ্রথা বিলুপ্তকারী ইমানসিপেশন আইন পাশ হওয়ার পর সৃষ্ট সামাজিক অস্থিরতা, দীর্ঘকাল ব্রিটিশ শাসনের পর স্বাধীনতা পাওয়া জ্যামাইকার মতো উপনিবেশগুলোর নিজস্বতার সংকট ও অনিরাপত্তা। কিন্তু বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখিকা মূলত এক নারীর জীবনকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন, যে নারীর মধ্যে অনিরাপত্তা, অস্থিরতা, স্থবিরতা, পরাধীনতা সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে আর তাকে আস্তে আস্তে নিয়ে গেছে জীবনের চরম মর্মান্তিক পরিণতির দিকে। লেখিকা দেখিয়েছেন, দাসপ্রথা উচ্ছেদের বৈপ্লবিক সময়ে দাসব্যবসার সাথে জড়িত পরিবারগুলোর করুণ কাহিনী, এ যেন নির্দিষ্ট পরিবারের গল্পের আড়ালে পরিবর্তনের সময়ের সাক্ষী ও শিকার হওয়া প্রতিটি সাধারণ পরিবারগুলোর কথাই বলে। এ উপন্যাস সাধারণ মানুষের উপন্যাস, একদিকে দাসব্যবসায় জড়িত সাধারণ পরিবারের উপন্যাস, অন্যদিকে শতাব্দী ধরে দাসত্বের শৃঙ্খলায় আবদ্ধ মালিকের প্রতি সাধারণ দাসদের ঘৃণার উপন্যাস, এই উপন্যাস কখনো মুক্তি না পাওয়া দুর্বলের অসহায়ত্বের গাথা।
উপন্যাসটি যখন লেখা হয়, তার কিছুকাল আগে ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা পায় আফ্রিকার অনেকগুলো উপনিবেশ, দাসপ্রথা বিলুপ্ত করতে ১৮৩৩ সালে ইংল্যান্ডের সংসদে পাশ হয় দাসপ্রথা বিলোপকারী আইন ‘দ্যা ইমানসিপেশন অ্যাক্ট’। এর আগে ১৮৩১ সালের বড়দিনের ছুটির সময় সকলে সাক্ষী দাসদের ঘৃণাপ্রসূত বিদ্রোহের, যা ইতিহাসে ‘দ্য ব্যাপটিস্ট ওয়ার’ নামেও পরিচিত। এমন সময় ঘৃণার বিষবাষ্প সাধারণ দাস থেকে সাধারণ ব্যবসায়ী সকলের জীবনকে বিষিয়ে তুলছে আস্তে আস্তে। সেইসাথে দাসব্যবসার সাথে জড়িত প্রত্যেকের তাদের নিজের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশাল ধ্বসের সৃষ্টি হয়। এমনই এক পরিবার উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অ্যান্টোয়নেট কসওয়ের। ব্যবসায় ধ্বসের ফলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তার বাবা তাদের প্রতিবেশী ব্যবসায়ীর মতো আত্মহত্যা করেন আর পরিবারকে রেখে যান সীমাহীন দুর্ভোগ পার করতে। দুই সন্তান নিয়ে অ্যান্টোয়নেটের মা চরম অনিরাপত্তায় ভুগতে থাকেন, এই অনিরাপত্তা তাকে সন্তানদের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে ঠেলে দেয়। একদিকে পারিবারিক অনিরাপত্তা, অন্যদিকে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা শিশু অ্যান্টোয়নেট থেকে তার শৈশব কেড়ে নেয় শুরুতেই। নিজের ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে মা অ্যানেটের দ্বিতীয় বিয়েও কোনো কাজে আসে না। পূর্ববর্তী দাসদের দেওয়া ঘৃণার আগুনে পুড়ে মারা যায় ছোট শিশুপুত্র, পালিয়ে বেঁচে যায় অ্যান্টোয়নেট। কিন্তু প্রিয় সন্তানের মৃত্যুর শোক অ্যানেটের জীবনের শেষ আশার প্রদীপটিও নিভিয়ে দেয়, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মারা যান তিনিও। এরপরে পাঠকের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে অ্যান্টোয়নেটের জীবনের উত্থান-পতন। পরিবারের পর তার জীবন কাটে মেয়েদের জন্য পরিচালিত কনভেন্ট স্কুলে, স্বামীর সাথে অন্য শহরে এবং সবশেষে লন্ডনে। কিন্তু শান্তি আর স্বস্তি কোথাও পায় না সে। আপন মানুষ ছাড়া, বন্ধুহীন জীবন কেবল জন্মগত অভিশাপের মতো টেনে বেড়াতে হয় তাকে। সর্বত্র অবিশ্বাস আর বিশ্বাসঘাতকতা সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরে তাকে, যেন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ছাড়বে না। মা ও মেয়ের এই দুই চরিত্রের মাধ্যমেই লেখিকা দেখিয়েছেন জীবনের বৈষম্য, অবিশ্বাস, বিশ্বাসঘাতকতা, পরাধীনতা, বিচ্ছিন্নতার মতো ব্যাপারগুলো কীভাবে মানুষকে অজগরের মতো প্রথমে পেঁচিয়ে ধরে, তারপর গিলে ফেলে অস্তিত্বের সবটুকু।
অ্যান্টোয়নেটের জীবনে বিশ্বাসঘাতকতা আর বিচ্ছিন্নতার শুরু হয় তার শৈশব থেকে, ছোটকালের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর কাছ থেকে। সে ও তার পরিবার ছিলো জ্যামাইকার দাসব্যবসার সাথে জড়িত মিশ্র বর্ণের অধিকারী। যখন সকল ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে দাসপ্রথা রহিত হয়ে গেলো, তখন তাদের অধীনস্ত দাসেরা মুক্তি পেলো। কিন্তু দাসদের শত বছরের ঘৃণার কোপ এসে পড়লো তাদের পরিবারের ওপর। ছোট্ট অ্যান্টোয়নেটের বন্ধু টিয়ার মনও এই বিষবাষ্পে ভরে উঠলো, পুকুরে সাঁতার কাটা অ্যান্টোয়নেটকে একা ফেলে রেখে তার কাপড় ও টাকা চুরি করে তাকে ছেড়ে চলে যায় টিয়া। অ্যান্টোয়নেট দেখেছে বর্ণবৈষম্য ও সামাজিক অবস্থানের কারণে তার পরিবারকে একঘরে হয়ে থাকতে, দেখেছে রাতের অন্ধকারে ঘৃণার আগুনে ঘর, ভাই আর পোষা পাখিটাকে পুড়ে শেষ হয়ে যেতে। সেই থেকে মানুষের ঘৃণা দেখার শুরু তার। স্কুলের ছকবাঁধা জীবনে আনন্দ পায়নি সে, পায়নি গৎবাঁধা প্রার্থনার মাঝে কোনো ভক্তিও। কিন্তু, তবুও নিয়মাধীন স্কুলের জীবনে কিছুদিন ভালোই থাকে সে। বরাবরের মতো ভালো থাকা স্থায়ী হয় না তার জীবনে, একদিন সৎ বাবা হঠাৎ এক অপরিচিত লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন তার। কিছুকাল দাম্পত্যজীবনের আবেদনে মত্ত থাকলেও শান্তি বা সুখ কোনোটাই প্রকৃত অর্থে পায় না সে। বিয়ের পর থেকে সে সব সময় থাকে স্বামীর অসন্তুষ্টি আর ভালোবাসা হারানোর ভয়ে তটস্থ। তারপর তার সব ভয়কে সত্যি করে দিয়ে একদিন সে হারালো তার স্বামীকে এবং সেইসাথে নিজেকে। বিশ্বাসঘাতকতা তার ক্ষুদ্র জীবনের সবটাই কেড়ে নিয়েছিলো। সৎ ভাই থেকে শুরু করে কাজের লোক, স্বামী, বন্ধু সকলেই ভেঙেছে বিশ্বাস। এমনকি তার মায়ের সাথে বাবার বিশ্বাসঘাতকতা মা ও মেয়ের উভয়ের জীবনকেই অন্ধকারের আঁচড় দিয়ে যায় চিরকালের জন্য।
উপন্যাসটিতে বিশ্বাসঘাতকতার সাথে সাথে আরো কিছু বিষয় পাঠকদের সামনে গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে। বৈষম্যের রকমফের হিসাবে লেখিকা দেখিয়েছেন, কীভাবে মিশ্র বর্ণ ও আর্থিক কারণে সামাজিকভাবে নিগৃহীত ও বিচ্ছিন্ন হয় অ্যান্টোইনেটের পরিবার। দেখিয়েছেন, দাসপ্রথা যেমন পাল্টে দিয়েছে হাজার হাজার কালো মানুষের জীবন, তেমনি এর বিলুপ্তিও চড়া মূল্য নিয়েছে সাধারণ দাস ও মালিক উভয়ের কাছ থেকে। কিন্তু এতসবের মধ্যেও একজন স্বজাতীয় নারী হিসাবে লেখিকা দেখিয়েছেন কীভাবে নানা সামাজিক নিয়ম-কানুন, সামাজিক ভণ্ড অনুশাসন মেয়েদের জীবনকে দলিত করছে চিরকাল ধরে। যেভাবে আজন্ম সমাজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে করতে নিঃসঙ্গ করুণাহীন মৃত্যু পেয়েছে মা অ্যানেট, সেরকমই স্নেহহীনভাবে শেষ হয়ে যায় অ্যান্টোয়নেটের জীবনের গল্প। পুরুষেরা বারবার নিজেদের স্বার্থে নামে-বেনামে এখানে ব্যবহার করেছে মেয়েদের, এই উপন্যাস জানিয়েছে কিভাবে মেকি স্বপ্ন আর পরাধীনতা করুণ ইতি টানে দুর্বল প্রাণের।
অথচ সেবিকা ক্রিস্টোফিন সমাজকে তাচ্ছিল্য করেই পেয়েছে নিজের স্থান, শক্তি আর নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার স্বাধীনতা। সমাজে প্রতিষ্ঠিত কোনো পরিবারের সদস্য না হলেও তুলনামূলক মুক্ত সে, জানে দুর্বল নারীকে কীভাবে টিকে থাকতে হয় পৃথিবীতে। তাই সে নিজের অর্থ ও সন্তান উভয়ই নিজের কাছে রেখেছে এবং সমাজের বদনামের ভয়ে অ্যান্টোয়নেটদের মতো নিজের সর্বস্ব দিয়ে সমাজ থেকে ‘স্বামী’ কিনতে ব্যাকুল হয় না। তার টিকে থাকার এই কৌশল দ্বারা নিজেকে সার্থক প্রমাণ করে অ্যান্টোয়নেটকে বলে,
“এই পৃথিবীতে মেয়েদের বেঁচে থাকতে হলে অবশ্যই প্রবল স্পৃহা লাগে, দুর্বলতা নয়।”
মূলত বইটি যেন আমাদের একটামাত্র গল্পের মধ্য দিয়ে একটা সময়ের, একটা সমাজের, এক আলাদা পৃথিবীর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।
লেখিকা জঁ রীস (মূল নাম এলা গুয়েন্ডোলেন রীস উইলিয়ামস) নিজে একজন আফ্রিকান-ইউরোপিয়ান মিশ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন বলেই হয়তো, নিজের দেশ ছেড়ে তাকে ইউরোপে চলে আসতে হয়েছিলো বলেই হয়তো, অথবা বৈষম্যময় জীবনের কঠিন সংগ্রামের সামনে তাকে দাঁড়াতে হয়েছিলো বলেই হয়তো তিনি নায়িকার অসহায়ত্বটাকে, তার একাকী নিঃসঙ্গ জীবনের যুদ্ধটাকে এত দরদ ভরে তুলে ধরতে পেরেছেন। আবার ধাপে ধাপে ব্যক্তি হিসাবে বক্তার দৃষ্টিকোণের পরিবর্তন তার এই সৃষ্টিকে এনে দেয় সার্বজনীনতা। বিশ্বসাহিত্য ‘ওয়াইড সারগাসো সী’এর মতো সাহিত্যসৃষ্টির জন্য জঁ রীস এর মতো লেখিকাদের নাম নিজ বক্ষে বহুকাল খোদাই করে রাখবে।