গল্পটি শুরু হয় ব্যাভিচারের অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত নারী হেস্টার প্রিন যখন রোদ ঝলমলে এক দিনে তার ‘অপরাধের ফসল’ শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে কারাগারের বাইরে এসে তৈরী মঞ্চে দাঁড়ায়। তার শহর বোস্টন তখন শাসিত হয় কঠোর পিউরিটান আইন দ্বারা আর তাতে ব্যাভিচারী নারীর ভাগ্য হয় অভিশপ্ত। হেস্টারের গাউনে লাল অক্ষরে লেখা অক্ষর ‘A’ এই অভিশাপের প্রতীকই বহন করে। ‘A’ লেখা হয়েছে সম্ভবত Adultary শব্দটি নির্দেশ করতে, যার অর্থ দাঁড়ায় ব্যাভিচার। যদিও হেস্টারই এখানে দোষী, তবুুও তার চরিত্রই এখানে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হেস্টারের রূপে, বলিষ্ঠতায়, সহ্যশক্তিতে, সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ততায়, সন্তানের প্রতি সেবাপরায়ণতায় আর মানবের প্রতি সেবায় নিবেদিত হেস্টার দোষী হয়েও যেন মোহময়ী নায়িকা হয়ে থাকে এই উপন্যাসে। মানবী চরিত্র হেস্টার প্রিনের বিচিত্র জীবনের সাথে সাথে নাথানিয়েল হর্থোনের রচিত উপন্যাস ‘দ্য স্কারলেট লেটার’ ফুটিয়ে তোলে একই অপরাধে অপরাধী হয়েও হেস্টারের সঙ্গী আর্থার ডিমেসডেল কীভাবে সমাজের প্রদত্ত শাস্তি থেকে বেঁচে যায়, এটি দেখায় শিশু পার্লের প্রকৃতি ও জীবন, বলে নিজের বিবেকের কাছে পরাজিত আর্থারের করুণ কাহিণী। সর্বোপরি ‘দ্য স্কারলেট লেটার’ একটি গল্পের পর্দায় তুলে ধরে অনেকগুলো জীবনের কাহিনী, মানুষের সবলতা আর দুর্বলতায় মেশানো সমাজের নানা খণ্ডচিত্র।
আমেরিকান সাহিত্যের এক মূল্যবান রত্ন হয়ে ‘দ্য স্কারলেট লেটার’ ১৮৫০ সালে প্রকাশিত হয় এবং প্রথম প্রকাশকালের তিনদিনেই বিক্রি হয় প্রায় আড়াই হাজার কপি। পরবর্তী ছয়মাসের মধ্যে পর পর বইটির দু’টি সংস্করণ বের হয় এবং সেই থেকে এখন পর্যন্ত বইটির প্রকাশনা কখনো থেমে থাকেনি। হেনরি জেমসের মতো অনেক সমালোচক বইটির প্রশংসায় এভাবে বলেছেন যে, “অবশেষে অনেকদিন পর একজন আমেরিকান লেখক এমন এই লেখা নিয়ে আসতে সক্ষম হলেন, যা ইংল্যান্ডে প্রকাশিত সর্বোত্তম বইয়ের তালিকায় উঠে আসতে পারে।” রোমান্টিক বই হিসেবে হর্থোনের এই বইকে আখ্যায়িত করা যায়, আখ্যা দেওয়া যায় ঐতিহাসিক দিক থেকেও। বইটির মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও যেমন জায়গা করে নিতে পারে পাঠকের কাছে, তেমনি এর গঠনগত নিপুণতা আর প্রতীকি রূপায়ণ মনোযোগ আকর্ষণ করেছে সাহিত্যবোদ্ধাদের। আজও আমেরিকার ইতিহাস ও সাহিত্যের শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা বইটি হাতে তুলে নেয় সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ডের জীবন, সমাজ ও আইনব্যবস্থার ধারণা নিতে। উপন্যাসটির এই ব্যাপকতা ও গভীরতা অনুধাবন করেই স্বয়ং লেখক হর্থোন বলেছেন, “সম্পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে উপন্যাসটিকে আমি এমনভাবেই গোছাতে চেষ্টা করেছি যেন জীবনের গভীরতম শিক্ষায় ও গঠনগত বৈচিত্র্যে স্বমহিমায় এককভাবেই দাঁড়াতে সক্ষম হয়।”
কাহিনী শুরু হয় কাস্টম হাউজে চাকরিরত এক বেনামী কর্মীর জবানীতে। চমৎকার নকশা করা ‘A’ অক্ষর লেখা এক পাণ্ডুলিপি তিনি খুঁজে পান তার কর্মক্ষেত্রে এবং সিদ্ধান্ত নেন সেটিকে উপন্যাসের রূপান্তরিত করার। গল্পটি ১৬৪২ থেকে ১৬৪৯ সালের সময়কার ইংল্যান্ডের বোস্টন শহরের। ব্যাভিচারে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত হেস্টার প্রাইন শিশু পার্লকে কোলে নিয়ে এসে দাঁড়ায় জনবেষ্টিত এক মঞ্চে, যেখানে যে নিজের পাপের স্বীকারোক্তি ও সঙ্গীর পরিচয় দেবে শহরের সবাইকে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে হেস্টার চিনতে পারে তার পূর্বের স্বামী চিলিংওর্থকে, যার সাথে বিয়ে হলেও তার সময় ও মনোযোগ পায়নি সে কখনোই। স্থানীয় ধর্মমন্ত্রী আর্থার ডিমসডেল কর্তৃক প্রেমিকের নাম বলতে নির্দেশিত হলেও তা অস্বীকার করায় হেস্টারকে ফিরে যেতে হয় কারাগারে।
তিন বছর পর জেল থেকে বেরিয়ে হেস্টার বোস্টনে ফিরে এসে জঙ্গলের কাছে দর্জি হিসাবে বাস করতে শুরু করে। যদিও লোকে সর্বদাই আঙুল তুলতো তার ওপর এবং পার্লের প্রশ্ন কখনো থামতো না, কিন্তু হেস্টার কখনোই সন্তান পার্লকে তার কাপড়ে খচিত ‘A’ অক্ষরের মর্মার্থ জানাতো না। অন্যদিকে, পূর্বের স্বামী, তার স্ত্রীর প্রেমিকের নাম জানতে থেকে যায় বোস্টনে। একদিন সে সন্দেহ করে, ধর্মরক্ষক আর্থারই তার স্ত্রীর প্রেমিক ও পার্লের পিতা। পাঠকের কাছে তার সেই সন্দেহ সত্য বলে প্রমাণিত হয়, যখন পাঠক জঙ্গলে বিবেকের দায়ে পীড়িত আর্থারকে হেস্টারের কাছে ভেঙে পড়তে দেখে। এই উপন্যাস মানুষের ব্যাক্তিসত্ত্বাকে তার নিজস্ব রূপে ফুটে ওঠার সুযোগ করে দেয়। অপরাধী হেস্টারের বর্ণনায় লেখক প্রথমেই বলেছেন, তিনমাসের শিশু কোলে হেস্টারকে মনে হচ্ছিল স্বাভাবিক সম্মানবোধ ও নিজের প্রকৃতিগত শক্তিতে বলীয়ান। দীর্ঘ ও মেদহীন দেহের সাথে কালো উজ্জ্বল মাথাভর্তি এলোমেলো চুলের মাঝে সাধারণ গঠনের ফর্সা মুখ ও কালো গভীর চোখ হেস্টারের চরিত্রকে প্রথমেই এক মোহনীয় ছ্বটা এনে দেয়। পরবর্তীতে এর সাথে একদিকে যেমন যোগ হয় হয় ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের প্রতি অবজ্ঞা, অন্যদিকে যোগ হয় তার স্নেহময়ী প্রকৃতি ও সেবাপরায়ণ প্রবৃত্তি। সহনশীলতা আর বিশ্বস্ততা তার চরিত্রকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায় সহজেই।
অন্যান্য চরিত্রগুলো তুলে ধরতেও লেখকের কোনো কার্পণ্য দেখা যায় না। ধর্মরক্ষক আর্থার ডিমেসডেলের চরিত্রটি একদিকে যেমন তার দু’মুখো প্রকৃতি প্রকাশ করে, অন্যদিকে বিবেকের দংশনে মৃতপ্রায় আর্থারকে একসময় দেখা যায় প্রেমিকার সাথে নিজের পাপের স্বীকারোক্তির জন্য ব্যাকুল হতে। সন্তান পার্লের প্রতি তার স্নেহও পাঠকের নজরে আসে। হেস্টারের পূর্বের স্বামীর চরিত্র ফুটে উঠেছে স্বাভাবিক ঈর্ষাপরায়ণতায় ও আশঙ্কায়। যা আমি পাইনি, তা তুমিও পেতে পারো না- নিজের এককালের স্ত্রী ও তার প্রেমিকের প্রতি এরূপ প্রতিহিংসায় ঘটে তার উত্থান-পতন। চারিত্রিক বলিষ্ঠতা যেন হেস্টারকে শান্তি এনে দেয়, কিন্তু সেই শান্তি জোটে না এই দুই পুরুষের ভাগ্যে।
তৎকালীন ক্ষমতাশালী খ্রিস্টানদের পাপবোধের এক স্বরূপ তুলে ধরে এই উপন্যাস। ব্যাভিচার মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার মতো পাপ হলেও হেস্টার বেঁচে যায় কারণ ধর্মের কর্তাব্যক্তিরা তাকে ‘পাপের জীবন শাস্তি ‘ হিসাবে সমাজে রাখতে চেয়েছিলো। বক্তার জবানীতে লেখক দেখিয়েছেন ধর্মীয় শাসনের অধীনে থাকা সমাজের ভণ্ডামি, অসহিষ্ণুতা ও রুক্ষতাকে। তখনকার ইউরোপীয় সমাজের ধর্মরক্ষকরা কীভাবে ধর্মের মহত্ত্বকেই নিয়ত ছোট করেছে, সেটাই পদে পদে ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সেইসাথে প্রকৃতিকে দেখা গেছে মানুষের সকল ভণ্ডামি ও সংকীর্ণতার ওপর প্রবল হতে। দেখা গেছে কীভাবে হেস্টারের ওপর আরোপিত পাপই তাকে শক্তি যুগিয়েছে, শাস্তির সাথে সাথে হেস্টারই পেয়েছে শান্তির সন্ধান, তার গাউনে খচিত শাস্তির চিহ্নমূলক অক্ষর একসময় তার গর্ব আর আত্মগরিমার প্রতীক হয়ে ওঠে। একসময় হেস্টার আরামদায়ক জীবন ফেলে চলে আসে তার জঙ্গলের কুটিরে। সেখানেই নিজস্ব মহিমায় মহিমান্বিত জীবনের বাকি অংশ কাটে তার। সমাজের সম্মানের স্থান পায় সে, আর তার শাস্তির প্রতীক অন্যদের মনোযোগ পায় না। তার কাছে আগত মানুষকে সে বলে- একটা সময় আসবে যখন নারী ও পুরুষ উভয়ই তাদের পারস্পরিক সম্পর্কে সুখের সন্ধান পাবে, কেবল বাধ্য-বাধকতা থাকবে না।
উপন্যাসটির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক এটিই যে, অপরাধী হেস্টারের চরিত্রের প্রভাব পাঠককে একসময় এতটাই মোহাবিষ্ট করে ফেলে যে সে হেস্টারের চোখ দিয়ে দেখে, তার হৃদয় দিয়েই চারপাশটা অনুভব করতে শুরু করে। কেবল লেখনীর মাধ্যমে যে উপন্যাস পাঠকের ওপর এরূপ প্রভাব রাখতে সক্ষম, সে উপন্যাস যে বিশ্বসাহিত্যে চিরকাল শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জীবন, সমাজ, প্রকৃতি, ধর্ম, শাসন, হৃদয়, সম্মান- এসকলই এক নতুন অর্থে, নতুন মাত্রায় পাঠকের কাছে প্রকাশ পায় ‘দ্য স্কারলেট লেটার’ এর প্রতিটি পাতায়।