সুদূর নয়, বরং অদূর ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন হবে ভাবতে পারেন? খুব শীঘ্রই মানুষ যে চাঁদে কিংবা মঙ্গলে বসবাস শুরু করতে যাচ্ছে সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ধরুন, এমন একটা সময় চলে এলো যখন মঙ্গলের জনসংখ্যাও বিলিয়নের ঘর পেরিয়ে গেল, সেখানেও শুরু হলো রাজনীতি। এভাবে একে একে অন্য গ্রহ উপগ্রহেও বাড়তে শুরু করলো মানুষের কলোনি বা উপনিবেশ। আর সৌরজগতের রাজনৈতিক দখল নিয়ে শুরু হলো এক গ্রহের সাথে আরেক গ্রহের স্নায়ুযুদ্ধ। কেউ যেন কারো থেকে কম যায় না। সত্যি সত্যি চলে আসতে পারে এমন কোনো সময়। আর সেই সময়কে কল্পনা করেই এক বাস্তবিক উপস্থাপন সাইফাই চ্যানেলের দ্য এক্সপ্যান্স সিরিজ। আজ কথা হবে এ টিভি সিরিজটি নিয়েই!
কাহিনীটা বলবার আগে চোখ ধাঁধানো গ্রাফিক্স আর নিখুঁত উপস্থাপনার কথা বলাটা আসে। গল্পের পাশাপাশি এ দুটো জিনিসের জন্য দ্য এক্সপ্যান্স হয়েছে অত্যন্ত সমাদৃত।
সিরিজের কাহিনী যে সময়ের তখন আজ থেকে দু’শতাব্দী পেরিয়ে গিয়েছে। মানববসতি গড়ে উঠেছে পুরো সৌরজগৎ জুড়েই। এর মাঝে প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো হলো পৃথিবী, মঙ্গল ও আউটার প্ল্যানেট অর্থাৎ মঙ্গলের বাহিরের গ্রহগুলো। জুপিটার বা বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদ যেমন আইও বা গ্যানিমিডেও লক্ষ লক্ষ লোক বাস করে। আর মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝে যে অসংখ্য গ্রহাণু (বেল্ট) রয়েছে, তাদের বাসিন্দাদের বলা হয় বেল্টার। তাদেরকে দরিদ্র হিসেবে ধরা হয়, অন্তত পৃথিবী কিংবা মঙ্গলের তুলনায়। তারা প্রধানত শ্রমিক হিসেবেই কাজ করেন মহাকাশযান নির্মাণসংক্রান্ত কাজে।
মঙ্গলের বাইরের সব জনবসতির রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজ করে OPA (Outer Planet Alliance)। ১০০ মিলিয়ন বেল্টারদের আশা ভরসার প্রতীক OPA-র নেতা ফ্রেড জনসন। আর ৩০ বিলিয়ন পৃথিবীর নাগরিকের নেতৃত্বে আছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মুখোপাত্র অনেকেই আছেন সিরিজে। কিন্তু মূল যে চরিত্র সবার দৃষ্টি কেড়ে নেন তিনি হলেন ক্রিসজেন আভাসারালা নামের এক ভারতীয়। ফ্রেড জনসন এবং ক্রিসজেন আভাসারালার মাঝে আছে শক্তিমান বাহিনীওয়ালা মার্স বা মঙ্গল, যেথায় চার বিলিয়ন মানুষের বাস।
বেল্টাররা মনে করে মঙ্গলের অধিবাসীরা খুব সুবিধাভোগী। আর মঙ্গলবাসী ও বেল্টাররা সবাই ভাবে, পৃথিবীর নাগরিকরা হলো অলস, আরামপ্রিয়। ভুল বলে না, পৃথিবীর বড় একটি অংশ তখন চলে ‘বেসিক’ এ, যা পৃথিবীর সরকারের এক বিশেষ ব্যবস্থা। যারা সিদ্ধান্ত নেয় উচ্চ শিক্ষা নেবে না, কোনো চাকরি করবে না। মাসিক ভাতা, কিছু টাকা পয়সা আর খাবার খেয়েও ঘরে বসে বিনোদন করে জীবন কাটিয়ে দেয় অনেকে। এই ভাতাকে বলে বেসিক।
নিম্ন অভিকর্ষজ ত্বরণে অভ্যস্ত বেল্টাররা ভাবতেও পারে না পৃথিবীতে নামবার। তাই পৃথিবীর কারো সাথে দেখা করতে হলে পৃথিবীর চাঁদে অবতরণ করতে হয়। সেখানে বিলাসবহুল কলোনিও আছে। শোনা যায়, পৃথিবীর মুক্ত আকাশ দেখার পর মঙ্গলবাসী অনেকেই মূর্ছা যায়, বেল্টার তো পরের কথা।
আমাদের গল্পের শুরু নায়ক জেমস হোল্ডেনকে দিয়ে। হোল্ডেন যে মহাকাশযানের অফিসার সেটি একটি আইস মাইনারের কাজ করে। শনি গ্রহের বলয় থেকে বরফ সংগ্রহ করে বেল্টের বসতিগুলোতে নিয়ে যাওয়া, এরপর সেগুলো গলিয়ে পানি পাওয়া যাবে। এরকম অনেক আইস মাইনার রয়েছে বরফ সংগ্রহের কাজে। হোল্ডেনের জাহাজের নাম ক্যান্টারবারি।
মহাকাশের অমোঘ নিয়ম, কোনো বিপদ সংকেত দেখলেই উদ্ধার করতে হবে। ক্যান্টারবারি যাত্রাপথে এক বিপদ সংকেত পেলো স্কোপুলাই নামের এক ছোট যান থেকে। হোল্ডেন আর তার কয়েকজন কাছের ক্রু মিলে স্কাউটশিপে করে রওনা দিল স্কোপুলাই দেখতে। কিন্তু গিয়েই তারা যার সন্ধান পেলো তা পরিবর্তন করে দেবে পুরো সৌরজগতের ভবিষ্যৎ। কোটি কোটি বছর আগের কোনো অতি বুদ্ধিমান ভিনগ্রহী প্রজাতির নিক্ষেপ করা এক জীবাস্ত্র, যার নাম প্রোটোমলিকিউল। যার স্পর্শেই পরিবর্তিত হতে থাকে যেকোনো জীব।
অবাক বিস্ময়ে হোল্ডেন ও তার ক্রু লক্ষ করে একদিকে প্রোটোমলিকিউলের তাণ্ডব, আর অন্যদিকে মঙ্গলবাহিনীর পতাকাধারী এক মহাকাশযানের ছোঁড়া নিউক্লিয়ার বোমার আঘাতে তাদের নিজের যান ক্যান্টারবারির ধ্বংস হয়ে যাওয়া, যেখানে একটু আগেও ছিল হোল্ডেনের ভালোবাসার মেয়েটি। কিন্তু আসলেই কি মঙ্গলের কাজ এটি? নাকি পৃথিবীর? কেউ স্বীকার করে না। হোল্ডেনরা তখন সৌরজগতের সবচেয়ে বড় মামলার সাক্ষী।
ওদিকে এক বেল্টার গোয়েন্দা মিলার খুঁজে বেড়াচ্ছে জুলি মাও নামের এক মেয়েকে। খুব শীঘ্রই সে জানতে পারে সে প্রোটোমলিকিউলের শিকার। একে একে সবার কাহিনী এক সুতোয় গাঁথা হতে থাকে। কিন্তু প্রোটোমলিকিউলের দখল হাতে থাকায় তারা খুব বিপদে পড়ে যায়। কোথায় যাবে তারা? কোনো একভাবে রসিনান্তে নামের এক মঙ্গলযান হাতে পেয়ে সেটি নিয়েই তারা অভিযানে বেরিয়ে পড়ে এ রহস্য সমাধানের। তাদের কর্মকাণ্ডের উপর নির্ভর করছে সৌরজগতের অনেক কিছুই। কী হবে শেষে? একের পর এক সিজন শেষ হওয়ার সাথে সাথে শেষ পর্যন্ত আপনি যে বিস্মিত হয়ে যাবেন সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
সিরিজটি বানায় অ্যালকন এন্টারটেইনমেন্ট। তারা ৩টি সিজন বিক্রি করে সাইফাই চ্যানেলের কাছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তৃতীয় সিজন চলাকালীন সাইফাই চ্যানেল সেটি ক্যান্সেল করে দেয়। যথাযথ বিজ্ঞাপনের অভাবে দ্য এক্সপ্যান্স সিরিজের দর্শক এমনিতেই ছিল সীমিত, কিন্তু খুব পাঁড় ভক্ত তারা, ইংরেজিতে যাকে বলে কাল্ট (Cult)। সিরিজটি বাঁচাবার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায় তারা। কার কাছে যাবে, নেটফ্লিক্স, নাকি অ্যামাজন?
ক’দিনের মাঝেই প্রায় দেড় লাখ পিটিসন সাইন যোগাড় করে ফেলে ভক্তরা। দর্শকের টাকাতেই অ্যামাজন স্টুডিওর পাশ দিয়ে বিমানে করে উড়িয়ে নেওয়া হয় ‘Save the Expanse‘ এর ব্যানার। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও সমর্থন দেন এ দাবিতে, যার মাঝে আছেন Wil Wheaton, George R. R. Martin, Patton Oswalt আর Andreas Mogensen। সুখবর হলো খালি ফিরে যেতে হয়নি ভক্তদের।
২৬ মে ২০১৮ তারিখে আন্তর্জাতিক মহাকাশ উন্নয়ন কনফারেন্সে অ্যামাজনের সিইও জেফ বেজোস ঘোষণা করেন তারা কিনে নিয়েছেন দ্য এক্সপ্যান্সের পরের সিজনগুলো। তিনি নিজেই এর ভক্ত। আশা করাই যায় আমরা দেখতে পাবো আরো কিছু সিজন। হয়তো পুরো বইটি সিরিজে রূপান্তরিত হবে চমৎকারভাবে। যেসব দেশে নেটফ্লিক্স চলে, সেখানে সিজন ১ ও ২ দেখা যাচ্ছে স্ট্রিম করেই।
দ্য এক্সপ্যান্স টিভি সিরিজটি যে বইগুলোর উপর নির্মিত, তার লেখক হলেন James S. A. Corey। কিন্তু এটি তার ছদ্মনাম, তাও একজনের না, দু’জনের। তারা হলেন, ড্যানিয়েল আব্রাহাম ও টাই ফ্রাংক। সপ্তাহান্তে তারা একসাথে বসে আলোচনা করেন কে কতদূর লিখলেন, এরপর সেগুলো একত্র করা হয়। কথা বলেন, এরপর কী কী হবে সেটা নিয়ে। একে এখন ডাকা হচ্ছে পরবর্তী ‘গেম অফ থ্রোন্স’। গেম অফ থ্রোন্স এর লেখক জর্জ আর আর মার্টিন স্বয়ং একে ‘kickass space opera‘ বলেছেন।
সিরিজটি দেখবার আগে আর বেশি কিছু বলা উচিত হবে না, কিন্তু শেষে এসে এর মিউজিক নিয়ে না বললেই নয়। কেবল থিম ইন্ট্রোর সুরটাই পাগল করা, বাকিগুলোর কথা না হয় উহ্যই থাকলো দর্শকদের জন্য চমক হিসেবে। ইন্ট্রোটা বোনাস হিসেবে এখানেই দিয়ে দেয়া হলো।
আইএমডিবিতে দ্য এক্সপ্ন্যান্স এর রেটিং ৮.৩/১০, রটেন টম্যাটোজে ৯০%। ঘরে তুলে নেয় ২০১৭ সালের হিউগো অ্যাওয়ার্ডসও! তবে আর দেরি কেন? বসে পড়ুন দ্য এক্সপ্যান্স দেখতে আর হয়ে যান এক নিখুঁত মহাকাশ যুগের গল্পের দর্শক। হতাশ যে হবেন না, সে বিষয়ে নিশ্চিত।
ফিচার ইমেজ: Wallpaper Abyss