অবকাশ যাপনের সবচেয়ে ভালো উপায়গুলোর একটি হচ্ছে সমুদ্রভ্রমণ। সমুদ্রের বিশালত্বে হারিয়ে গিয়ে নিজেকে চাঙা করে তুলতে কে না পছন্দ করে? তাই সমুদ্রভ্রমণকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য বিশ্বজুড়ে পর্যটন ব্যবসার সাথে জড়িত সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টার কোনো কমতি নেই। সেই প্রচেষ্টার একটি অংশ হচ্ছে বিলাসবহুল ‘ক্রুজ শিপ’ বা প্রমোদতরী। উল্লেখ্য, ইয়টও একপ্রকার প্রমোদতরী। তবে ইয়ট হচ্ছে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য। সেখানে ক্রুজ শিপগুলো সাধারণ পর্যটনের উদ্দেশ্যে নির্মিত যাত্রীবাহী দানবাকার সব জাহাজ। পর্যটন খাতে প্রমোদতরীর প্রভাব যে কতদূর গড়িয়েছে তার একটি তথ্য দেয়া যাক। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী ৩১ মিলিয়ন পর্যটক পেয়েছে ক্রুজ শিল্প। আর তা থেকে আয় হয় ৩৯.৬ বিলিয়ন ডলার! তাহলে চলুন জেনে নিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ৫ প্রমোদতরী সম্পর্কে কিছু তথ্য, যেগুলোকে আপনি প্রমোদতরী না বলে ‘ভাসমান শহর’ও বলতে পারেন।
৫. ওভেশন অব দ্য সিস
৩৪৮ মিটার লম্বা এবং ৪৯ মিটার চওড়া সমুদ্রের দানব ‘ওভেশন অব দ্য সিস’ জাহাজটি ‘রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ক্রুজ’ কোম্পানির কোয়ান্টাম সিরিজের তৃতীয় জাহাজ। ১৬টি সান বাথের ডেক, ২০৯০টি শয়নকক্ষ, তিনটি সিনেমা হল, ওয়েলপুল, শিশুদের জন্য বিশেষ পার্ক, ওয়াটার পার্ক, ক্যাসিনো, বার, রেস্টুরেন্ট, একাধিক ডিস্কো এবং শ’খানেক খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান- সব মিলিয়ে জাহাজটি একটি পূর্ণাঙ্গ শহর!
২০১৬ সালের এপ্রিলে ক্যারিবিয়ান ক্রুজ কোম্পানি জাহাজটিকে সমুদ্রে ভাসায়। ১ লক্ষ ৬৮ হাজার জিটি (গ্রস টনেজ) ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই জাহাজের সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ২২ নটিক্যাল মাইল। এই কোয়ান্টাম ক্লাস প্রমোদতরীটি যেকোনো অবস্থায় সর্বোচ্চ ৪৯০০ জন যাত্রী পরিবহনে সক্ষম। ওভেশন অব দ্য সিস জাহাজে ভ্রমণের জন্য, সুযোগ সুবিধা ভেদে প্রতিদিন ব্যয় করতে হবে ২০০-১০০০ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় ১৬ হাজার থেকে ৮৪ হাজার টাকা পর্যন্ত!
৪. কোয়ান্টাম অব দ্য সিস
এ জাহাজটি রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ক্রুজ কোম্পানির কোয়ান্টাম সিরিজের প্রথম জাহাজ। ২০১৪ সাল থেকে সমুদ্র দাপিয়ে বেড়ানো এ জাহাজ যৌথভাবে নির্মাণ করে রয়্যাল ক্যারিবিয়ান কোম্পানি এবং মেয়ার রেফট কোম্পানি। এটি বর্তমানে চীনের সাংহাই থেকে জাপান ও কোরিয়ায় যাত্রী পরিবহন করছে। ৩৪৮ মিটার লম্বা এ জাহাজটি ওভেশন থেকে এগিয়ে গিয়েছে প্রস্থে। কোয়ান্টাম জাহাজটি ৪৯.৫ মিটার প্রশস্ত। এর ধারণক্ষমতাও ওভেশনেরই সমান, ১ লক্ষ ৬৮ হাজার জিটি। ৯৩৫ মিলিয়ন ডলার খরচে নির্মাণ করা এ জাহাজটি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল জাহাজ ছিল এর নির্মাণের বছরে।
সর্বমোট ২০০০ শয়নকক্ষে ৪ হাজার যাত্রী নিয়েই সাধারণত ভেসে বেড়ায় কোয়ান্টাম। তবে এর সর্বোচ্চ যাত্রী ধারণক্ষমতা ৫ হাজার। ওভেশনের ১৬টি ডেক বিশিষ্ট এই জাহাজের একটি বিশেষত্ব হলো এর ভিআইপি শ্রেণীর শয়নকক্ষগুলোতে ঝুল-বারান্দা রয়েছে। তাছাড়া এতে রয়েছে দুটি আকর্ষণীয় শপিং মল। অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ওভেশনের মতোই।
৩. ওয়েসিস অব দ্য সিস
‘ওয়েসিস’ শব্দটির মানে ‘মরুদ্যান’। ধু-ধু মরুভূমির এক টুকরো জলাশয় কিছু গাছে ঘেরা, এই তো মরুদ্যান। তেমনি, সমুদ্রের বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির মাঝে ওয়েসিস সিরিজের এই জাহাজটিও এক টুকরো মরুদ্যানের মতো। না, পুরো জাহাজটিতে মরুদ্যান সদৃশ কিছুই খুঁজে পাবেন না, কেবল এর উপরের ডেক বাদে। ডেকগুলো এমনভাবেই সাজানো হয়েছে যে দূর থেকে দেখলে আপনি সেটিকে মরুদ্যান ভেবে ভুল করতেও পারেন! ডেকের পৃষ্ঠটাও যে মরুভূমির ধূসর বালুর মতো দেখতে। ২ লক্ষ ২৫ হাজার জিটি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এ জাহাজটি লম্বায় ৩৬১ মিটার এবং চওড়ায় ৬০ মিটার। জাহাজটি তৈরি করতে রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির খরচ হয়েছে ১.৪ বিলিয়ন ডলার, যা একে করেছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে দামী প্রমোদতরী। ২০০৯ সাল থেকেই এ জাহাজটি পর্যটন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত।
সাধারণ শয়নকক্ষের পাশাপাশি ওয়েসিসে রয়েছে ঝুল-বারান্দাসহ বিলাসবহুল কক্ষ এবং ডুপ্লেক্স স্যুট। আগের দুটি প্রমোদতরীর চেয়ে এ জাহাজটিতে রয়েছে আরো বাড়তি কিছু সুযোগ সুবিধা। অ্যাকুয়া থিয়েটার, বিশাল উন্মুক্ত করিডর, সার্ফিং স্পেস, একটি কেন্দ্রীয় পার্ক, জিপলাইনের ব্যবস্থা, সুউচ্চ ওয়াটার কোস্টার রাইড, ভলিবল এবং বাস্কেটবল কোর্টসহ অসংখ্য বিনোদনের ব্যবস্থায় সমৃদ্ধ এ জাহাজটি। তাছাড়া রেস্টুরেন্ট, বার কিংবা সুইমিং পুল তো আছেই। সর্বোচ্চ ৬,২০০ জন যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এ জাহাজটি ঘন্টায় ৪২ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে।
২. অ্যালিউর অব দ্য সিস
শুধু নামে নয়, বাস্তবিকই এ জাহাজটি আপনাকে সমুদ্রযাত্রার জন্য ‘অ্যালিউর’ তথা প্রলুব্ধ করতে সক্ষম হবে। ৩৬২ মিটার লম্বা এ জাহাজটির উচ্চতা ৭২ মিটার। অর্থাৎ, একটি সাত তলা ভবনের সমান! এর সামগ্রিক নকশা প্রণয়ন এবং নির্মাণের কাজ করে ফিনল্যান্ডের ‘এসটিএক্স ইউরোপ’ কোম্পানি। জাহাজটি নির্মাণে ১.২ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। ২৪২,০০০ জিটি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এ জাহাজের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৪২ কিলোমিটার/ঘন্টা। প্রাথমিকভাবে জাহাজটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘প্রিন্সেস ফিয়োনা’। ২০০৯ সালে সমুদ্রে ভাসার এক বছরের মাথায় এর নাম পরিবর্তন করে ‘অ্যালিউর অব দ্য সিস’ রাখা হয়।
অ্যালিউরের যাত্রী ধারণক্ষমতা ৫,৪০০ জন। বিলাসবহুল এ জাহাজে রয়েছে একটি দ্বিতল ড্যান্স হল, ১৩৮০ আসন বিশিষ্ট একটি থিয়েটার, জিমনেসিয়াম, বরফে স্কেটিং করার ব্যবস্থা, আকর্ষণীয় সি ফুড রেস্টুরেন্ট, ২৫টি মাঝারি আকারের রেস্টুরেন্ট, ওয়েলপুল, ইয়োগা এবং সূর্যস্নানের জন্য ১০টি যাত্রী ডেক। আর রাত্রিবেলা আকাশে নক্ষত্রমণ্ডলীর দেশে ঘুরে আসবার জন্য রয়েছে টেলিস্কোপের ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে আপনার সমুদ্রযাত্রাকে আনন্দদায়ক করতে তাবৎ ব্যবস্থা করে রেখেছে অ্যালিউর অব দ্য সিস। এ জাহাজে ৭ দিনের একটি ভ্রমণ (খাওয়া এবং বিনোদনমূলক কাজ বাদে) করতে বাংলাদেশি টাকায় খরচ হবে ৬০ হাজার টাকা।
১. হারমোনি অব দ্য সিস
রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ক্রুজ লিমিটেডের ওয়েসিস সিরিজের এ জাহাজটি বিশ্বের বৃহত্তম প্রমোদতরী। ‘এসটিএক্স ফ্রান্স’ কোম্পানির সেইন্ট নাজাইর শিপইয়ার্ডে এ জাহাজটি নির্মিত হয়। এর নির্মাণকাজে ব্যয় হয় ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার। প্রমোদতরীর জগতে এ জাহাজটি সবচেয়ে নতুন। ২০১৬ সালের জুনে হারমোনি এর প্রথম সমুদ্রযাত্রা করে। ২ লক্ষ ২৬ হাজার জিটি ভারবাহী এ জাহাজটি দৈর্ঘ্যে ৩৬২ মিটার এবং প্রস্থে ৬৬ মিটার। এ তালিকার অন্য জাহাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৬ কিলোমিটার/ঘন্টা গতিতে চলতে সক্ষম এ জাহাজ। সর্বোচ্চ ৬,৭০০ জন যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন হারমোনি বর্তমানে বার্সেলোনা থেকে রোম রুটে চলাচল করছে।
হারমোনির প্রধান আকর্ষণ সম্ভবত পুরো জাহাজকে ঘিরে এর চক্রাকার রাস্তা, যেখানে সাইকেল চালানোর ব্যবস্থা রয়েছে। এর ২৭৫০টি কক্ষের সুযোগ সুবিধা এবং ভাড়া ভেদে ৪৩টি শ্রেণী আছে! এ জাহাজে আছে ভাইটালিটি স্পা, বাচ্চাদের জন্য স্প্ল্যাশওয়ে পুল, অত্যাধুনিক ওয়াটার স্লাইড এবং ড্রাই স্লাইড, ২৩টি সুইমিং পুল যার মধ্যে ১০টি উন্মুক্ত ডেকে, ২টি সার্ফিং স্পেস, পাজেল ব্রেক, বাস্তবসম্মত গেমিং স্পেস, ২০টি ডাইনিং স্পেস, অ্যাকুয়া থিয়েটার, ১৪০০ আসন বিশিষ্ট রয়্যাল থিয়েটার, পিং পং কোর্স, মিনি গলফ কোর্স, বাস্কেটবল কোর্ট, জিপলাইন, বায়োনিক বার যেখানে দুটি রোবট সকল প্রকার পানীয় পরিবেশন করে। তাছাড়া পুরো জাহাজটি উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধাসম্পন্ন, এর করিডোরগুলো ১১ হাজারের অধিক চিত্রকর্মে সজ্জিত। অবকাশ যাপনের জন্য এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?
ফিচার ছবি: Fungyung.com