কার্থিক সুব্বারাজের ‘মহান’ (২০২২)-কে বলা যায় দুই গ্রেট গ্যাংস্টার সিনেমা ‘স্কারফেইস’ (১৯৮৩) এবং ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন আমেরিকা’ (১৯৮৪)-র প্রাউডলি অনুপ্রেরণা নেওয়া, কিংবা ওই শিরায় বেড়ে উঠতে চাওয়া একটি ভারতীয় গ্যাংস্টার সিনেমা। আরো ক্লাসিক গ্যাংস্টার সিনেমার ছায়া তো আছে। সাথে লোকাল গ্যাংস্টার সিনেমাগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিও দিয়েছে। তবে ওই দুটোর ছায়াই মাড়িয়েছে জোরালোভাবে। গান্ধী মহানের কাছের সবাই একে একে যেভাবে ফাইনাল অংকে মারা পড়তে থাকে, এবং একাকী মহান আরো যেভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকে, সেখানেই রীতিমতো ট্র্যাজেডির দিকে রূপান্তরিত হতে থাকে সিনেমা। অবশ্য এরপরই আবার তামিলের প্রত্যাশিত মাসালায় ফেরে। তবে ধারাটা ‘স্কারফেইস’-এর কথাই মনে করায়।
সেই সিনেমা তো ছিল এক শেক্সপিয়রীয় ট্র্যাজেডি। আর ক্লাইম্যাক্সে গান্ধী মহান যেভাবে মেশিন গান হাতে নিয়ে তার ছাদে, মদের বার ওড়ায়, সেই সিন ‘স্কারফেইস’ সিনেমার বিখ্যাত সেই ক্লাইম্যাক্সেরই স্পষ্ট উদাহারণ। এম সিক্সটিন মেশিন গান হাতে আল পাচিনোর মুখনিঃসৃত সেই বিখ্যাত সংলাপ, “সেয় হ্যালো টু মাই লিটল ফ্রেন্ড,” ওটারই প্রতিলিপিস্বরূপ এক নিজস্ব ভার্সন সুব্বারাজ তৈরি করেছেন ভিক্রমকে নিয়ে। আর বাল্যকালের বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, লোভ, লালসা; এসবের গ্যামাট ধরে ‘মহান’ যেভাবে এগিয়েছে তা ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন আমেরিকা’র দীর্ঘদেহী ছায়াতে বেড়ে ওঠা। সাথে বাবা-ছেলের সম্পর্ক, তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব আর অমোঘ প্রতিশোধের চিত্রতে নিজস্ব এক ভিশনে নির্মাণ করেছেন ‘মহান’কে। গ্যাংস্টার ড্রামা হলেও, একজন মধ্যবয়সী পুরুষের নিজেকে আবিষ্কারের একটা সূক্ষ্ম জার্নিও হয়ে উঠেছে এই সিনেমা।
এই সিনেমায় মূল ক্ল্যাশ শুধু বাবা-ছেলের নয়। দুটো ভিন্ন মতাদর্শের। জনরার প্রত্যাশিত আর গড়পড়তা সকল অলংকারের সরব উপস্থিতিতেও যা এই সিনেমাকে আলাদা করে তুলেছে। গান্ধী মহানের ‘গান্ধী’ নামটা যেমন করে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া, তেমনি কোনো মতবাদও কারো উপর চাপিয়ে দেওয়ার সুদুরপ্রসারী নেতিবাচকতাকে বিবরণীয় করে তোলে এই সিনেমা। উগ্রতার কোনো নির্দিষ্ট শাখা-প্রশাখা নেই। বিশ্বাস নিয়ে, অবিশ্বাস নিয়ে, শ্রেণী নিয়ে, মতাদর্শ নিয়ে; যেকোনো কিছু নিয়েই উগ্র হতে পারে মানুষ। এমনকি গান্ধীর আদর্শবাদীও হতে পারে সমপরিমাণ উগ্র। সেই চিত্রই এই সিনেমার বিশ্লেষ্য। মদের বিরুদ্ধে গান্ধীর সক্রিয় অবস্থান ছিল। সেই ইতিহাস, ‘৬০ দশকের সেই সময়কালকে ধরে ৫ দশকের সময়রেখায় দাঁড়িয়েছে সিনেমার ন্যারেটিভ। এসব ভালোই নুয়্যান্স যোগ করেছে চিত্রনাট্যে। ক্লিশের মাঝেও কিছুটা সাবভার্সন এনেছে।
গান্ধী মহান তখন ছিল কিশোর। তার বাবা মদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। এবং ছেলের উপরও সেই মতাদর্শ চাপিয়েছিল। তারপর কাটল সময়। মহানের বয়স এখন ৪০। মধ্যবয়স। একঘেয়ে জীবন। স্কুলের সাধারণ, গোবেচারা শিক্ষক। ছাত্রদের চুটকিতেও কোনো উত্তর করে না সে। বউও তার গান্ধী-ভক্ত। বউয়ের জন্য টান টান উত্তেজনাময় মারপিটের ছবিও তার দেখা হয় না, হলের টিকিট লুকিয়ে রাখতে হয়। গান্ধীজী যে অহিংসতায় বিশ্বাসী। তাই তার গান্ধীভক্ত স্ত্রীও তেমন। তবে ৪০ তম জন্মদিনের পরদিন কিছুটা ‘আজাদি’ বা স্বাধীনতার স্বাদ চেখে নেবার সুযোগটা মহানের জীবনে আসে। এবং সেটাই কাল হয়। মদ খেয়ে মাতাল হতে গিয়ে সমাজের সংজ্ঞায়, এক ‘নষ্ট’ ছাত্রের সাথে দেখা। ছাত্রের বাবা আবার মহানের ছেলেবেলার বন্ধু।
তাই মদ, জুয়া, নাচগানে মজলিশ জমলো সারারাত। পরদিনই সেই ঘটনার ফলাফলস্বরূপ, ছেলেকে নিয়ে চলে গেল গান্ধী মহানের স্ত্রী। এরপর সেই দুঃখ ভুলতে মদে চুর হতে গিয়ে মদেরই এক অদ্বিতীয় ব্র্যান্ড বাজারে আনল গান্ধী মহান! নামটার আয়রনিকেই মহান করে তুললো আর কী। আর তারপরই গ্যাংস্টারের উত্থান। এগুলো অতীব চেনা অলংকার। অতীব চেনা গ্যামাট মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার আগে। তাতে নুয়্যান্সের ব্যাপার, ক্লিশের মাঝেও এক আধটু সাবভার্সনের কথা তো ওপরেই বললাম। দ্বিতীয় অংকে দাদাভাই নওরোজি আসার পর থেকেই দুই মতাদর্শের দ্বন্দ্ব নিয়ে বক্তব্যকে সামনে আনা হয়েছে। বিষয়টা এমনিতেই সংবেদনশীল। তার উপর কোনোভাবে গ্লোরিফাই হয়ে গেলে, তা খোদ সিনেমাকেই নীতির দ্বন্দ্বে ফেলে দেবে। সেই জায়গা থেকে এদিকে ভারসাম্য রক্ষার কাজটা ছিল চিকন দড়ির উপর হাঁটার মতো। এবং সেটা বুদ্ধিদীপ্তভাবেই করতে পেরেছেন কার্থিক সুব্বারাজ।
কারো কারো মতে, গান্ধী মহানের ছেলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে হিংস্র হয়েছে তার ভিত শক্ত না— ব্যাপারটা তেমন না। কারো মধ্যে কোনো মতাদর্শের বীজ ঢুকিয়ে দিলে তাকে চরমপন্থী করে তোলা কঠিন কিছু নয়। তাছাড়া সেই বীজ তার মাঝে দেওয়া হয়েছে ছোটবেলাতেই। তাই তার হিংস্রতাকে, তার উদ্দেশ্যকে যথাযথভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যায়। অবশ্য এক্ষেত্রে, নারী চরিত্রকেই আরো ভালোভাবে গড়ে তোলার দরকার ছিল। এই চরিত্রের লেখনী রোগপটকা। মাংসের অভাবে ভুগেছে। এই চরিত্রে, তার মতাদর্শকে আরো প্রসারিত করা হলে, মাংস দেওয়া হলে দ্বৈরথ আরো অভিঘাতসম্পন্ন হতো।
দৈর্ঘ্যের ব্যাপারে প্রথমেই বলে দিতে হয়, এটা একটা সেল্ফ ইন্ডালজেন্ট কাজ। এমন কাজে দৈর্ঘ্য সচরাচরই এমন হয়। তবে সেটাকে আরো বেশি সুবিচার করা হতো যদি তামিলীয় গড়পড়তা, জবড়জং মাসালা উপকরণগুলো ছাড়িয়ে কিংবা আরো চিকন করে, বরং সিমরানের চরিত্রকে সময় দেওয়া হতো। তারপরও বিরক্তি জাগে না, সুব্বারাজের বুদ্ধিদীপ্ত লেখা ও সংলাপ এবং দক্ষ ফিল্মমেকিংয়ের কারণে। যথেষ্ট সতর্কতা, আত্মবিশ্বাস এবং দরদ দিয়ে সিনগুলো কম্পোজ করেছেন; স্পষ্টত। তাই কাটতেও একটু কষ্ট হয়ে থাকবে হয়তো। তা-ও সম্পাদনা মসৃণ হয়েছে। এবং অনেক কাট আর ট্রাঞ্জিশনেই ভিবেক হার্শানের সুচারু সম্পাদনাকর্মের পরিচয় পাওয়া গেছে। সান্তোষ নারায়ণের আবহসঙ্গীত তামিল বাণিজ্যিক সিনেমার পরিচিত রীতিতে সিনগুলোকে উত্তোলিত করার মতোই হয়েছে।
উত্তোলিত করার সেই ক্রেডিট নামচরিত্রের ভিক্রমকেও দিতে হবে সন্দেহাতীতভাবেই। ‘পিথামাগান’, ‘আন্নিয়ান’, ‘দেইভা থিরুমাগাল’, ‘আই’, ‘রাভানান’ সিনেমাগুলো দিয়ে তার খাঁটি অভিনয়ের জন্য অনেক আগে থেকেই সুপরিচিত তিনি। এই সিনেমায় তার অভিনয়, তার ক্যারিয়ারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি পারফর্ম্যান্স হয়ে থাকবে। চরিত্রকে ছাড়িয়ে যাওয়া অভিনয়ের জন্য ইংরেজিতে একটা কথা আছে— ‘অ্যাক্টিং ওভার ক্যারেক্টার’। এক্ষেত্রে অনেকটা তাই-ই হয়েছে। চরিত্রটাকে খাটো করা হচ্ছে না। চেনা গতিবিধির হলেও পুষ্ট চরিত্রই। কিন্তু তার অভিনয় চরিত্রকে আরো সিরিয়াস করেছে। দাদা নওরোজির আসল পরিচয় জানার পর এতদিনকার জমানো গ্লানি একসাথে ধাক্কা দিয়ে উঠে আসা, দায়িত্বহীনতার প্রতি অনুশোচনা বোধ করা, পরিচয়টা কাউকে বলতে না পারায় নিজের ভেতরে নিজেই বিভক্ত হয়ে যাবার যেই মুহূর্তগুলো অনেক বেশি জীবন্ত করে তুলেছেন তার অভিনয়ে।
চরিত্রকে করেছেন একদম নিজস্বতায় ভারী। তার দ্বান্দ্বিকতা, গ্লানিটা যেন ব্যক্তিজীবন থেকে ধার নিয়ে চরিত্রে প্রবাহিত করছেন! ড্রামাটিক্যালি এতটাই অনুনাদি তার অভিনয়। আবার এখনকার অতি ব্যবহারে জীর্ণ হওয়া ওসব ‘সোয়্যাগ’ টার্মকেও নিজের কুলনেস দিয়ে ভিন্ন করে তুলেছেন। কুলনেসটা যেন শেকড়জাত। তার বন্ধু সত্যবান চরিত্রে ববি সিমহাও ভালো করছেন। এসব চরিত্ররেখা সিমহা’র চেনা। এর আগে সুব্বারাজেরই ‘জিগারথান্ডা’ (২০১৪) সিনেমায় এমন বৃত্তের চরিত্রই যে পেয়েছেন। তবে এই চরিত্রটা একটু আলাদা হয়ে ওঠে গান্ধী মহানের উসিলায় খোয়াতে বসা প্রাণ ফিরে পাবার পর। ঢুলুঢুলু চোখে চার্চ, ক্রুশ আর মহানকে সমান্তরালে এনে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। ছাড়তে চান মদের সাম্রাজ্য। কিন্তু মহানের অসীম চাওয়া, আকাঙ্ক্ষায় তা আর হলো কই! তার এই বিশ্বাসীতে রূপান্তর হবার বিপরীতে মহানের ক্রমবর্ধমান চাওয়া; সূক্ষ্মভাবেই একটা আলাদা দ্বন্দ্ব আর বক্তব্যকে তুলে ধরে। বিশ্বাস আর লোভ দুটোরই প্রকৃতিকে সামনে এনে। তবে ওদিকটায় খুব বেশি গভীরতায় যাবার সুযোগটা পরিচালক হাতছাড়া করেছেন, পেয়েও।
নওরোজি চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভিক্রমের নিজেরই ছেলে ধ্রুব ভিক্রম। তার চরিত্রে এক্সেন্ট্রিক বৈশিষ্ট্য রেখেই চরিত্রটা বিন্যাস করা হয়েছে। চরিত্রের চাপা ক্রোধ, অন্তর্দহন যে চরিত্রটাকে একটা ভঙ্গুর অবস্থানে নিয়ে গেছে, সেটা ধ্রুব ভিক্রম তার অভিনয়ের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ করতে পেরেছেন। আবার এক্সেন্ট্রিক স্বভাবটা তাকে করেছে একটু ‘ওভার দ্য টপ’। এই দুয়ে মিলিয়ে সমতাটা রাখতে গিয়ে মাঝেমাঝে দুলে উঠেছেন আবার মাঝে মাঝে হাল ধরেছেন। দুলে উঠলেও হেলে পড়ে যাননি কারণ অপর দিকে থাকা, বাবা ভিক্রম সূক্ষ্মভাবে ঠিকই ছেলেকে সেই স্পেসটা ছেড়ে দিয়েছেন অনেক সিনে। বাবার মুখোমুখি, তার প্রথম সিনেও তা লক্ষ্য করা যায়। ভিক্রম স্বেচ্ছায় একটু মিইয়ে, লাইটের ফোকাস ছেলের উপর পড়তে দিয়েছেন।
‘মহান’ অবশ্যই সুব্বারাজের সবচেয়ে সেল্ফ ইন্ডালজেন্ট সিনেমা। সেই সাথে রজনীকান্ত, ধানুশ— এসকল সুপারস্টারদের সাথে কাজ করতে গিয়ে পর পর ভয়ানক বাজে সিনেমা দিয়ে নিজের স্বকীয়তা যেভাবে হারাতে বসেছিলেন সুব্বারাজ, সেটাও কাটিয়ে উঠতে পারলেন। তামিলের তথাকথিত গড়পড়তা বাণিজ্যিক ‘স্থূল’ মাসালা ফিল্মমেকিংয়ের মাঝে বরাবরই তুলনামূলক বুদ্ধিদীপ্ত ফিল্মমেকিং উপহার দেন কার্থিক সুব্বারাজ। মাসালার রীতিতেও সংবেদনশীল বিষয়াদি নিয়ে ডিল করতে পারেন। এটায় যেমন দুটো সংবেদনশীল আর জটিল মতাদর্শ নিয়ে করলেন।
তার সবকয়টা স্টাইলেরও যথাযথভাবে দেখা মিলেছে এই সিনেমায়। আয়রনি বা পরিহাস, আরেকটু বাঙাল করে বললে; নিয়তির পরিহাসটা বরাবরই তার সিনেমায় সমাপ্তিতে এসে শো কেড়ে নেয়। প্রধান হয়ে ওঠে। যেমন- ‘জিগারথান্ডা’ সিনেমায় ত্রাস সৃষ্টি করা সেই গ্যাংস্টার সমাপ্তিতে এসে পূর্ণতা খুঁজে পায় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কমেডিয়ান বনে গিয়ে! আবার ‘ইরাইভি’ সিনেমায় দর্শক ৩ নারীচরিত্রের ভূমিকাটা দেখতে পায় ৩ পুরুষের দৃষ্টিকোণ ধরে। যেই ব্যাপারটা একদম মেদহীন উপায়ে ও চতুরভাবে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন, নারী সম্পূর্ণভাবে কতটা ভোগ করতে পারে; তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। আর এই সিনেমায় প্রথমত নামের আয়রনি তো আছেই। আর সমাপ্তিতে, গান্ধী মহান যেভাবে ‘মহান’ হয়ে উঠে সেই প্রক্রিয়াটাই দেখুন না। সাক্ষাত আয়রনিই।