Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্টেম কোষের আদ্যোপান্ত: বাংলা ভাষায় স্টেম কোষের স্বরূপ সন্ধান

কোষ হলো জীবদেহের গঠন, বিপাকীয় ক্রিয়াকলাপ, এবং বংশগতির তথ্য বহনকারী একক। একটি বহুকোষী জীবদেহ অসংখ্য কোষ নিয়ে গঠিত। এই কোষগুলোর মধ্যে কিছু কোষ রয়েছে যারা বিশেষ কোনো কাজে পারদর্শী। আর কিছু কোষ রয়েছে যারা কোনো বিশেষ কাজের জন্য বিশেষায়িত নয়। তাদের কাজ হচ্ছে নিজেদের সংখ্যাবৃদ্ধি করা। মূলত এ অবিশেষায়িত কোষগুলোই স্টেম কোষ। ভ্রূণাবস্থা থেকে পূর্ণাঙ্গ জীবদেহ গঠন, ক্ষতস্থান পূরণ প্রভৃতি কাজে এই স্টেম কোষের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিশেষ করে যেসব রোগ এখনো মানুষ জয় করতে পারেনি, সেসব রোগের চিকিৎসায় স্টেম কোষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। স্টেম কোষের এমন সব কার্যাবলি আর সম্ভাবনার কথা শুনলে যে কেউ অবাক হতে বাধ্য। বাংলা ভাষাভাষী পাঠককে স্টেম কোষের এই মজার জগৎ সম্পর্কে জানাতেই লেখক অপূর্ব পাল লিখেছেন তার প্রথম বই ‘স্টেম কোষের আদ্যোপান্ত’।

স্টেম কোষের প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এরা দীর্ঘসময়ের জন্য নিজেদের পুনরূৎপাদন করতে পারে, এবং এরা অবিশেষায়িত কোষ হলেও এদের রয়েছে বিশেষায়িত কোষ জন্মদানের ক্ষমতা। স্টেম কোষ অবিশেষায়িত, কারণ দেহের কোনো টিস্যু বা অঙ্গের বিশেষ কোনো কাজ এরা করে না। কিন্তু স্টেম কোষ থেকে তৈরি হওয়া একেকটি স্নায়ু কোষ, কিংবা পেশি কোষ দেহে পৃথক পৃথক কাজ সম্পাদন করে। কিন্তু কীভাবে এই স্টেম কোষ দীর্ঘসময় ধরে নিজেদের পুনরূৎপাদন করতে পারে? কীভাবেই বা এরা অবিশেষায়িত হওয়ার পরও বিশেষায়িত কোষের (পেশি কোষ, স্নায়ু কোষ প্রভৃতি) জন্ম দিতে পারে? ‘স্টেম কোষের আদ্যোপান্ত’ বইয়ে লেখক খুব সহজভাবে এসব ঘটনার পেছনের বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করেছেন। জীববিজ্ঞানের কিছু মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেই যে কেউ বইটি পড়ে খুব সহজেই প্রকৃতির এসব রহস্য উন্মোচনের সাক্ষী হতে পারবেন। স্টেম কোষের অনিন্দ্য সব কার্যাবলি দেখে স্টেম কোষের প্রেমে পড়তে বাধ্যও হতে পারেন কেউ কেউ! 

স্টেম কোষের রয়েছে বিভিন্ন বিশেষায়িত কোষ জন্মদানের অনন্য ক্ষমতা; Image Source: Freepik.com

বর্তমানে বিজ্ঞানের চটকদার বিষয়গুলোর একটি হচ্ছে স্টেম কোষ। স্বাভাবিকভাবেই চটকদার এসব বিষয়ে অন্তর্জালে বিভ্রান্তিমূলক সব তথ্যের প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু লেখক অপূর্ব পাল যে যথেষ্ট খাটাখাটনি করে বাস্তবিকতার প্রেক্ষিতে, নির্মোহভাবে এ বিষয়ে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন তা তার লেখায় স্পষ্ট। স্টেম কোষের কোনো বিষয়ের পেছনের বিজ্ঞান সাবলীল, বাস্তবধর্মী উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা প্রদানের ভঙ্গিমাই ‘স্টেম কোষের আদ্যোপান্ত’ বইটির সবচেয়ে নজরকাড়া দিক।

স্টেম কোষকে এর পোটেন্সি বা অন্য বিশেষায়িত কোষ জন্মদানের সামর্থ্যের ভিত্তিতে টটিপোটেন্ট, প্লুরিপোটেন্ট, মাল্টিপোটেন্ট, ইউনিপোটেন্ট ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। টটিপোটেন্ট কোষ একটি পূর্ণাঙ্গ জীবের সম্পূর্ণ বিকাশে সক্ষম। অর্থাৎ একটি জীবের অমরা সহ সকল কোষ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে এই টটিপোটেন্ট সেল। তেমনি প্লুরিপোটেন্ট কিংবা মাল্টিপোটেন্ট কোষগুলোরও রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। লেখক একজন ব্যক্তির জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের সাথে তুলনা দিয়ে যেভাবে তা পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এভাবে পুরো বইয়েই লেখক জীবনের সাধারণ কিছু বিষয়ের সাথে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে মেলানোর চেষ্টা করে গেছেন। আর তাতে বিজ্ঞানের কাঠখোট্টা বিষয়গুলো পাঠকের কাছে সহজেই বোধগম্য হয়ে উঠেছে। 

স্টেম কোষের আদ্যোপান্ত © Md. Abdullah Abu Sayed

আমাদের দেহ যে ট্রিলিয়ন পরিমাণ কোষ নিয়ে গঠিত, তার সূচনা হয় মূলত জাইগোট নামক একটি মাত্র ভ্রূণকোষ থেকে। পিতা-মাতা থেকে প্রাপ্ত শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর মিলনে তৈরি হয় এ জাইগোট। ধীরে ধীরে এই জাইগোট কোষ বিভাজনের মাধ্যমে ব্লাস্টোসিস্টে পরিণত হয়। এই ব্লাস্টোসিস্টের অভ্যন্তরে থাকে একধরনের স্টেম কোষ। মূলত এই স্টেম কোষকে বলা হয় ভ্রূণীয় স্টেম কোষ। এই ভ্রূণীয় স্টেম কোষ থেকেই পরবর্তীতে দেহের যেকোনো কোষ তৈরি হতে পারে। একসময় ব্লাস্টোসিস্ট এক্টোডার্ম, মেসোডার্ম, এন্ডোডার্ম নামে তিন স্তরে ভাগ হয়ে ত্বক, পেশি টিস্যু, কঙ্কালতন্ত্র, পৌষ্টিকতন্ত্র সহ পূর্ণাঙ্গ মানবদেহের নানা অংশ তৈরি করে।

একটা নির্দিষ্ট বয়সের পূর্ণাঙ্গ মানবদেহের মধ্যে আবার আরেক ধরনের স্টেম কোষ থাকে- পরিপক্ব স্টেম কোষ। অবস্থানের উপর ভিত্তি করে এদের নানা ধরনের নাম রয়েছে। মস্তিষ্কে অবস্থিত পরিপক্ব স্টেম কোষ হলো নিউরাল স্টেম কোষ। তেমনি অস্থিমজ্জায় অবস্থিত স্টেম কোষ হলো হেমাটোপয়েটিক স্টেম কোষ। এদের আবার প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা আলাদা কাজ। যেমন: হেমাটোপয়েটিক স্টেম কোষগুলো দেহের যাবতীয় রক্তকণিকা তৈরিতে ভূমিকা রাখে, নিউরাল স্টেম কোষ দেহে উদ্দীপনা পরিবহনের যাবতীয় ব্যবস্থায় সহায়তাকারী নিউরন তৈরিতে ভূমিকা রাখে। 

স্টেম কোষের অনন্য এসব সক্ষমতা একসময় নজড় কাড়ে বিজ্ঞানীদের। কীভাবে স্টেম কোষ তৈরি করে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায় এ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন তারা। তবে এ ভাবনায় আমূল পরিবর্তন আনেন একজন বিজ্ঞানী- শিনইয়া ইয়ামানাকা। হেপাটাইটিস সি রোগে আক্রান্ত হয়ে একসময় মারা যান ইয়ামানাকার বাবা। বাবার মৃত্যু ইয়ামানাকার জীবনের গতিপথে আনে পরিবর্তনের ছোঁয়া। ডাক্তারি ছেড়ে পুরোদস্তুর গবেষক বনে যান তিনি। দেহের বিশেষায়িত কোষ (ত্বক কোষ) থেকে স্টেম কোষ তৈরির এক অনন্য পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তিনি। কৃত্রিম এ স্টেম কোষের নাম তিনি দেন প্রবর্তিত প্লুরিপোটেন্ট স্টেম কোষ (Induced Pluripotent Stem Cell)। নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি এই অবদানের জন্য। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে উন্মোচিত হয় অবারিত সম্ভাবনার দ্বার। কিন্তু ইয়ামানাকা কীভাবে এই অসাধ্য সাধন করলেন? ‘স্টেম কোষের আদ্যোপান্ত’ বইয়ে উঠে এসেছে এর পেছনের বিজ্ঞানও। 

নোবেলজয়ী স্টেম কোষ গবেষক শিনইয়া ইয়ামানাকা; Image Source: Wikimedia Commons

দুরারোগ্য সব ব্যাধি নির্মূলে এই স্টেম কোষকে কাজে লাগানোর সমূহ সম্ভাবনা দেখেন বিজ্ঞানীরা। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীকে স্টেম সেল থেরাপি প্রয়োগে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া ডায়াবেটিস, ব্লাড ক্যানসার, হৃদরোগ সহ  নানা রোগের চিকিৎসায় স্টেম কোষ ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশও এদিক দিয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই। ২০১৪  সাল থেকে বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা স্টেম কোষ নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত স্টেম কোষ থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসার সফলতার হার ৯০ শতাংশ। এছাড়া লিভারের রোগের নতুন ও সাশ্রয়ী একটি পদ্ধতিও বের করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল। 

স্টেম কোষের এত এত সম্ভাবনার মাঝে বিতর্কও রয়েছে খানিকটা। মূলত ভ্রূণীয় স্টেম কোষকে গবেষণাগারে ব্যবহার করাকে ঘিরেই এ বিতর্ক।  যে ভ্রূণীয় স্টেম কোষগুলো নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে, সেগুলো থেকে মানবশিশুর জন্ম হতে পারত, কিন্তু গবেষকরা তা হতে দিচ্ছেন না। একে একধরনের হত্যা বলেও মনে করেন অনেকে। তবে ভিন্ন মত রয়েছে গবেষকদের কাছে। এসব বিতর্ক ঘিরে অনেক দেশেই স্টেম কোষ গবেষণায়  রয়েছে নানা বিধিনিষেধ।

বিজ্ঞানের অনিন্দ্যসুন্দর এই স্টেম কোষের আদ্যোপান্ত সাবলীলভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন লেখক অপূর্ব পাল। তিনি বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যয়নরত। জীববিজ্ঞানের প্রতি নিগূঢ় ভালোবাসার টান তাকে এমন একটি বই লিখতে বাধ্য করেছে। জীববিজ্ঞান সম্পর্কে, স্টেম কোষ সম্পর্কে তার ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ‘স্টেম কোষের আদ্যোপান্ত’ বইটিতে। বইটি পড়ে কেউ স্টেম কোষ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে যাবেন ব্যাপারটা তেমন না। তবে বইটি পড়লে স্টেম কোষ সম্পর্কে পাঠকের মনে পরিষ্কার একটি ধারণা জন্ম নেবে, স্টেম কোষ নিয়ে ভাবিয়ে তুলবে পরবর্তী প্রজন্মকে। বিজ্ঞানের কোনো বিষয়ের সম্যক ধারণা, ঘটনার পেছনের কারণা জানা, এর মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মকে বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলা- বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম প্রতিপাদ্য বলা চলে এগুলোকে। সেদিক বিবেচনায় বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অনন্য একটি সংযোজন ‘স্টেম কোষের আদ্যোপান্ত’ বইটি।

সংক্ষিপ্ত বই পরিচিতি

বই: স্টেম কোষের আদ্যোপান্ত
লেখক: অপূর্ব পাল
প্রকাশক: আদর্শ
প্রচ্ছদ শিল্পী: উওয়ং শৈ মারমা
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১০২
মুদ্রিত মূল্য: ২২০ টাকা

Language: Bangla

Topic: This article is a book review on 'Stem Kosher Adyopanto' which is authored by Apurbo Paul.

Featured image: Md. Abdullah Abu Sayed

Related Articles