মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘নিঃসঙ্গ গ্রহচারী’ পড়েছিলেন ছোটবেলায়? একাকী এক ভিনগ্রহে ঘুরে বেড়ানো? অথবা সত্যজিৎ রায়ের বঙ্কুবাবুর বন্ধু পড়েছেন? কিংবা দেখেছেন স্টিভেন স্পিলবার্গের বিখ্যাত ‘ই.টি.‘ (১৯৮২) মুভিটি? সেরকম স্বাদ আরেকটিবার পেতে আপনার জন্য আদর্শ রেসিপিটি হবে নেটফ্লিক্সের চমৎকার রিমেক ‘Lost in Space‘; আজকের আমরা কথা বলব এ সিরিজটি নিয়েই।
সিরিজে দেখা যায়, ২০৪৬ সালে এমন একটি ঘটনা ঘটে যায় যার কারণে মানবজাতি সম্মুখীন হয় বিলুপ্তির আশংকার। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নতুন এক গ্রহে যাত্রার, আর সেটি হলো পৃথিবীর নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরাই বা আলফা সেন্টরাই এর পৃথিবী সদৃশ এক গ্রহের উদ্দেশ্যে। সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে এক নতুন মানব কলোনি। এক নতুন পৃথিবী। ক্রিসমাস স্টার নামে পরিচিত এক জ্যোতিষ্ক আঘাত হানে পৃথিবীতে। তখন রেজোলিউট নামের এক আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাকাশযানে করে বাছাই করা সেরা পরিবারদের পাঠানো হয় নতুন পৃথিবীতে কলোনি গড়ে তুলতে। গল্পের কাহিনী আবর্তিত হয় রবিনসন পরিবারকে নিয়ে। রেজোলিউটের ২৪তম মিশনে রবিনসন পরিবারকে বাছাই করা হয় যাত্রার জন্য। কিন্তু আলফা সেন্টরাইতে পৌঁছাবার আগেই এক ভিনগ্রহী রোবট রেজোলিউট মহাকাশযানের প্রাচীরে ক্ষতিসাধন করে ফেলে। শুধু তা-ই নয়, মহাকাশচারীদের হত্যাও করতে শুরু করে।
ফলে, কিছু পরিবারকে জোর করে হলেও মাদারশিপ ত্যাগ করতে হয় তাদের শর্ট রেঞ্জ জুপিটার মহাকাশযানে করে। কিন্তু রবিনসন ও অন্যান্য কলোনিস্টরা ক্রাশ ল্যান্ড করে কাছের এক বাসযোগ্য গ্রহে। এখানে তাদের লড়াই করে বেঁচে থাকতে হবে নতুন পরিবেশের সাথে, যতদিন না রেজোলিউটে ফিরে যাবার উপায় পাওয়া যায়।
মরিন রবিনসন একজন অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার। তিন বাচ্চাকে নিয়ে যাত্রা করেছেন নতুন লক্ষ্যে। তিনি এ মিশনের কমান্ডার। তার স্বামী জন রবিনসনের সাথে চলছে না বনিবনা। জন একজন পাইলট, সাবেক মার্কিন মেরিন। মরিনের দুই ছোট বাচ্চার আসল বাবা আর বড় মেয়ের সৎ বাবা জন।
১৮ বছর বয়সী জুডি রবিনসন মরিন রবিনসনের আগের সংসারের মেয়ে। মিশনের একজন ডক্টর সে। উইল রবিনসনের বয়স মাত্র ১১, এ মিশনে বাছাইয়ের জন্য তাকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। পেনি রবিনসন, তার বড় বোন, একজন বইখোর। মিশনের আরেক পরিবারের এক ছেলেকে তার বড্ড পছন্দ।
কাহিনী শুরু হয় যখন উইল রবিনসন জঙ্গলে খুঁজে পায় এক এলিয়েন রোবটকে, কিন্তু সে তখনো জানত না যে স্মৃতি হারানো এই রোবটই রেজোলিউটে ধ্বংসযজ্ঞ করেছিল। রোবটটিকে সে খুঁজে পায় এক এলিয়েন মহাকাশযানের ধ্বংসাবশেষের কাছে। রোবটটিকে ‘সুস্থ’ করে তোলায় উইলকেই প্রভু হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। বিপদ দেখলেই ‘ডেঞ্জার, উইল রবিনসন’ বলে ওঠে রোবট। কিন্তু ঝামেলা শুরু হয় তখনই যখন অন্য পরিবারেরা চিনে ফেলে এই বিপজ্জনক রোবটটিকে, কারণ এর হাতে কারো প্রিয়জন হয়ত মারা গিয়েছে। পরিবারগুলো বিপদে পড়বার পর রোবটটি একটি প্রাণ বাঁচাবার পর তাকে থাকতে দেয়া হয় তাদের সাথে, সীমিত পরিসরে। কিন্তু যদি তার স্মৃতি ফিরে আসে?
এ সিরিজে খলনায়িকা হিসেবে আছে ডক্টর স্মিথ নামের একজন ভণ্ড। রেজোলিউট থেকে অন্য একজনের পরিচয় চুরি করে পার পেয়ে যায়, সাথে খুনও করে আসে একজনকে। মনোবিজ্ঞানের ডক্টর সেজে এ অপরিচিত গ্রহেও বাস করতে থাকে পরিবারগুলোর সাথে, সখ্যতা গড়ে তোলে রবিনসন পরিবারের সাথে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য রবিনসনরা বুঝতে পারে না। যখন টের পায় তখন দেরি হয়ে গেছে খুব। ওদিকে মরিন রবিনসন আবিষ্কার করেন যে তারা আসলে পরিচিত গ্যালাক্সিতে নেই আর, কীভাবে সম্ভব হলো এটি? তাছাড়া যে গ্রহে তারা আছেন, সেটিও ধ্বংসের মুখে শীঘ্রই, বাঁচতে হলে খুব দ্রুত ত্যাগ করতে হবে এ জায়গা।
ডন ওয়েস্ট নামের একটি চরিত্র বেশ কৌতুক জাগায়। পেশায় মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার ডন আসলে যেদিকে টাকা সেদিকেই ছোটে, কিন্তু টাকার চেয়েও যে মানুষের মন বড়, সেটা বুঝতে থাকে ধীরে ধীরে।
অ্যাডভেঞ্চার, ড্রামা আর সায়েন্স ফিকশন ঘরানার এ মার্কিন সিরিজটি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায় ২০১৮ সালের ১৩ এপ্রিল। লিজেন্ডারি টেলিভিশনের প্রযোজনা করা এ সিরিজের শো-রানার হিসেবে আছেন জ্যাক এস্ট্রিন। ১০ পর্বের সিরিজটির শুটিং হয়েছিল ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ভ্যাঙ্কুভারে। প্রতিটি পর্ব ৪৭-৬৫ মিনিটের মাঝে। মূল চরিত্রগুলোতে অভিনয়কারী হিসেবে আছেন টবি স্টিফেন্স, মলি পার্কার, ইগ্নাসিও সেরিকিও, টেইলর রাসেল, ম্যাক্সওয়েল জেনকিন্স প্রমুখ। শুটিং ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত চলে।
নেটফ্লিক্সের বিখ্যাত অন্যান্য টিভি সিরিজগুলোর সাথে তুলনা করলে বলা যায়, এ সিরিজটি এত গভীর নয়। বরং, হালকা ধাঁচের সাই-ফাই দেখতে চাইলে বিঞ্জ-ওয়াচ করার জন্য আদর্শ এটি। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর মনে রাখবার মতো কিছু নয়, সিরিজের গ্রাফিক্স কাহিনীর সাথে মানানসই, রোবটটিকে এবং স্পেস এনভায়রনমেন্ট ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ভালোভাবেই। মূল চরিত্রগুলোর অভিনয় ছিল চমৎকার। অন্যদিকে, রোবটের সাথে উইলের সখ্যতা যেন স্পিলবার্গের ইটি-র কথা মনে করিয়ে দেয়, প্রচ্ছদটাতেও মিল আছে। এমন না যে, অজানা অচেনা গ্রহে বেঁচে থাকার কাহিনী নতুন কিছু। বরং, লস্ট ইন স্পেস সিরিজটি নিজেই একটি রিমেক (রি-ইমাজিনিং)। যেমন, ১৯৯৮ সালে Lost in Space মুক্তি পেয়েছিল এবং সেখানে অভিনয় করেন উইলিয়াম হার্ট, গ্যারি ওল্ডম্যান, ফ্রেন্ডস-খ্যাত ম্যাট লেব্লাংকের মতো অভিনেতারা! ডন ওয়েস্টের চরিত্রে ম্যাট লেব্লাংক থাকলেও তার ফ্রেন্ডস কোস্টার ম্যাথিউ পেরির সেখানে অভিনয় করবার কথা ছিল। ২০৫৮ সালের পটভূমিতে কাছাকাছি কাহিনীর চলচ্চিত্রটি অবশ্য ফ্লপ হয়েছিল। আইএমডিবি রেটিং এ দেখা যাচ্ছে মাত্র ৫.১/১০।
আবার ২০০৪ সালেও মুক্তি পায় The Robinsons: Lost in Space; তবে ৫.৭/১০ রেটিং এর সে মুভিটির কাহিনী ছিল কিছুটা ভিন্ন।
মূল লস্ট ইন স্পেস সিরিজ কিন্তু ষাটের দশকের। আরউইন অ্যালেনের সৃষ্টি সে সিরিজটি ৩ সিজন ও ৮৩ পর্ব জুড়ে চলেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে! ১৯৬৫-১৯৬৬ সালে প্রথমে সাদাকালোতে শুরু হলেও পরে ১৯৬৮ সালে পর্যন্ত রঙিন সিরিজ হিসেবেই চলে। সেবার সিরিজটির পটভূমি ছিল ১৯৯৭ সাল নিয়ে। বিখ্যাত সুরকার জন উইলিয়ামস এ সিরিজের সুর করেছিলেন! আইএমডিবিতে এর রেটিং বর্তমানে ৭.৩/১০।
আগের কথা তো অনেক হলো, ফিরে আসা যাক নেটফ্লিক্সের সিরিজখানায়। এ সিরিজের আসল ডক্টর স্মিথের চরিত্রে যিনি ছিলেন, সেই বিল মামি কিন্তু ১৯৬৫ সালের মূল সিরিজে বালক উইল রবিনসনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন! আগের নকল ডক্টর স্মিথেরা পুরুষ হলেও, এবার কিন্তু মহিলা, পার্কার পজি বেশ ভালো অভিনয় করেছেন বলতেই হয়। সিরিজটির ট্যাগলাইন: “Danger will find them.“। সিরিজটির ট্রেলার এখানে দেখানো হচ্ছে-
২০১৮-র Lost in Space সিরিজটি আইএমডিবিতে ৭.৩/১০ রেটিং পেয়েছে। এখনো দেখে না থাকলে শুরু করে দিন, কথা দেয়া যায় যে, খারাপ লাগবে না! আর যাদের নেটফ্লিক্স আছে তারা বাংলাদেশ থেকেই দেখতে পাবেন এখানে ক্লিক করেই। আপনার কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না যেন!
ফিচার ইমেজ: Netflix