গার্লফ্রেন্ডের পীড়াপীড়িতে তার পরিবারের সাথে দেখা করতে রাজি হয় আফ্রিকান আমেরিকান ফটোগ্রাফার ক্রিস। তার শ্বেত গার্লফ্রেন্ড রোজের বাবা-মা তাকে গ্রহণ করে নিবে কিনা এ নিয়ে ক্রিস শুরুতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগলেও রোজ জানায় তার বাবা-মা লিবারেল, রেসিস্ট না। সম্ভব হলে তারা ওবামাকেই তৃতীয়বারের মত ভোট দিতো। রোজের কথায় নির্ভার হয়ে রোজের গ্রামের বাড়ির পথে রওনা দেয় ক্রিস। রোজের নিউরোসার্জন বাবা এবং হিপনোথেরাপিস্ট মায়ের সাথে পরিচয় হয় ক্রিসের। তারা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে নিলেও কোথায় যেন ক্রিসের খটকা লাগে ক্রিসের। সেটা হতে পারে এই শ্বেত পরিবারের দুই কালো ভৃত্যকে দেখে, হতে পারে ক্রিসের উপর তাদের সন্দেহজনক নজরদারি দেখে, হতে পারে রোজের ভাই জেরেমির করা বর্ণবাদী মন্তব্য শুনে কিংবা ক্রিস আসার পরপরই তাদের বাড়িতে আয়োজন করা শ্বেতাঙ্গদের বিশাল মিলনমেলা দেখে। একটা সময় ক্রিস বুঝতে পারে এই শ্বেতাঙ্গদের জগতে সে আটকে গিয়েছে। অশনি সংকেত পেয়ে এখান থেকে বের হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে ক্রিস। কিন্তু পারবে কি ক্রিস এই শ্বেত সাম্রাজ্য থেকে বের হতে?
হরর সিনেমার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, হরর সিনেমায় সমাজের প্রতিরূপ ফুটিয়ে তোলা হয় না। গড়পড়তা হরর মুভির প্রধান উদ্দেশ্য থাকে অদ্ভুত এবং ভৌতিক কাহিনী আর ভীতিকর সাউন্ড ট্র্যাক ব্যবহার করে মানুষের স্নায়ুকে নাড়া দেয়া। সমাজ বিদ্বেষ ও এই সস্তা ফর্মুলার কারণেই মূলত গড়পড়তা হরর মুভিগুলো চলচ্চিত্র সমালোচকদের চক্ষুশূল। যে কারণে একাডেমী এওয়ার্ডের প্রায় একশ বছরের ইতিহাসে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি হরর সিনেমা সেরা চলচ্চিত্রের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে। সেই ক্ষেত্রে ‘গেট আউট’ বলতে গেলে হরর সিনেমার সংজ্ঞাই পালটে দিয়েছে। হরর হলেও সিনেমায় অশরীরী কোনোকিছুর উপস্থিতি নেই, সিনেমায় নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে আমেরিকান সমাজের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়টি।
এই অসাধারণ হররটির মূল কারিগর জর্ডান পিল। ছবিটির লেখক ও পরিচালক জর্ডান পিলের পরিচালনা জগতে অভিষেক হয়েছে এই সিনেমা দিয়েই। পরিচালক জর্ডান পিল এমনিতে একজন নামকরা কমেডিয়ান। তিনি কমেডির জনপ্রিয় ধারা ‘স্কেচ কমেডি’র জন্য বিশ্বজুড়ে নন্দিত। কমেডি সেন্ট্রালের জনপ্রিয় শো ‘কি এন্ড পিল’ এর সহ-উদ্ভাবক এবং শো রানার ছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, আমেরিকাসহ বিশ্বজুড়ে স্কেচ কমেডিকে জনপ্রিয় করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে ‘কি এন্ড পিল’। এই ‘কি এন্ড পিল’-এরও মূল উপজীব্য ছিল বর্ণবাদের প্রতি বিদ্রূপ। ‘গেট আউট’ দিয়ে কমেডি ছেড়ে সিনেমার নতুন জগতে প্রবেশ করলেও পরিচিত পথেই হেঁটেছেন জর্ডান পিল।
এই সিনেমার প্রধান চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন ড্যানিয়েল কালুইয়া (ক্রিস ওয়াশিংটন), এলিসন উইলিয়ামস (রোস আর্মাটাজ), ক্যাথরিন কিনার (মিসি আর্মাটাজ), ব্র্যাডলি উইটফোর্ড (ডিন আর্মাটাজ), লিলরেল হাওয়ারি (রড উইলিয়ামস)। প্রধান চরিত্রগুলোতে অভিনয় করা এদের সবার অভিনয়ই ছিল অনবদ্য, বিশেষ করে সিনেমার পোস্টার বয় ড্যানিয়েল কালুইয়ার অভিনয়। এক চোখে অশ্রুবর্ষণ করা এই তরুণ অভিনেতা এই ছবিতে তার মনোমুগ্ধকর অভিনয়ের জন্য ইতোমধ্যে অস্কার নমিনেশনও পেয়েছেন ‘সেরা অভিনেতা’ ক্যাটাগরিতে। ইংল্যান্ডের অধিবাসী হয়েও আমেরিকান একসেন্ট এতটাই নিখুঁতভাবে রপ্ত করেছেন তিনি যে পুরো সিনেমায় কোনো সংলাপ শুনেই বোঝার উপায় ছিল না যে তিনি আসলে একজন ব্রিটিশ। সিনেমার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিলেন লিলরেল হাওয়ারি। ক্রিসের একমাত্র বন্ধু টিএসএ এজেন্ট রড উইলিয়ামসের চরিত্রে অভিনয় করা লিলরেল এই সিনেমায় প্রয়োজনীয় কমিক রিলিফ দান করেছে। এমনিতেই ছবিটি হরর ঘরানার, তার উপর এর বিষয়বস্তুও আবার খুবই স্পর্শকাতর এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ, যে কারণে এই কমিক রিলিফটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। লিলরেলের হিউমারাস সংলাপের জন্য ছবিটি দর্শকের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।
(সামনে সামান্য স্পয়লার আছে!)
গেট আউট সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ধারার একটি হরর মুভি। গেট আউটের প্রধান উপজীব্যই ছিল হাজার বছর ধরে আমেরিকান সমাজের শিকড় গেড়ে থাকা বর্ণবাদ। কালো সম্প্রদায়ের উপর হাজার বছর ধরে চলে আসা উৎপীড়ন এবং একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মার্কিন উচ্চ-মধ্যম শ্রেণীর শ্বেতদের অন্তরে বিদ্যমান বর্ণবাদকে চপেটাঘাত করেছে ‘গেট আউট।
গেট আউট বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গদের মুখে ছুড়ে দেয়া একটা বড়সড় প্রহসনও বটে। কেন প্রহসন, সেটা আপনি সিনেমাটি দেখতে বসলেই বুঝতে পারবেন। আগেই বলেছি হরর সিনেমা হওয়া সত্ত্বেও এই সিনেমায় ভৌতিক বা অশরীরী কোন কিছুর উপস্থিতি নেই। তাহলে আমরা ভয় পাবোটা কি দেখে বা কাকে দেখে? শুনতে অদ্ভুত শোনালেও এখানে আমরা ভয় পাচ্ছি বিত্তবান শ্বেতাঙ্গদের দেখে। এই মুভিতে বিত্তবান লিবারেল শ্বেতাঙ্গ সমাজকে দৃশ্যায়িত করা হয়েছে এবং তাদের উদার চিত্তের ভিতরের কালো রূপটা দেখানো হয়েছে।
প্রহসনটা কোথায় ধরতে পারছেন? যুগ যুগ ধরে এই বিত্তবান শ্বেতাঙ্গরাই ভোগবাদ, পুঁজিবাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে নিপীড়িত কৃষ্ণাঙ্গ ও নিম্নবিত্তদের ব্যবহার করে। খুব নিখুঁতভাবে এই সিনেমায় সিম্বোলিজমের প্রয়োগ করেছেন জর্ডান পিল, বিত্তবান শ্বেতাঙ্গদের দেখিয়েছেন অশুভ শক্তি হিসেবে। সার্বিকভাবে বলতে গেলে এর আগে কোন সিনেমাই বর্ণবাদকে এরকম বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ঘায়েল করে নি। এই কারণে জর্ডান পিল আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, ‘গেট আউট’ হবে সেই সিনেমা যার জন্য কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরা বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছে।
১ ঘণ্টা ৪৪ মিনিটের ছবিটি মুক্তি পায় গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি। মুক্তির পরপরই পুরো আমেরিকা জুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে ছবিটি। মাত্র ৪.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেটের ছবিটি প্রথম সপ্তাহান্তে ব্যাগে ভরে প্রায় ৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। শুধু আমেরিকাতেই ছবিটির আয় দাঁড়ায় ১৭৬ মিলিয়ন ডলারের মতো। আর সবমিলিয়ে বৈশ্বিকভাবে এর মোট আয় ২৫০ মিলিয়নের চেয়েও বেশি। দর্শক এই ছবিকে কতটা ভালোবেসেছে তা বোঝানোর জন্য এরচেয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন বোধহয় নেই। ‘গেট আউট’-কে দর্শকদের চেয়েও বেশি আপন করে নিয়েছে অবশ্য সমালোচকরা।
টাইম ম্যাগাজিনের হয়ে ‘গেট আউট’ এর রিভিউ করেছেন স্টেফানি জ্যাকারেক, “অনেক অভিজ্ঞ ফিল্মমেকাররাও যে জায়গায় হোঁচট খায়, সেখানে সফল হয়েছেন জর্ডান পিল। তিনি এমন একটি বিনোদনের ক্ষেত্র তৈরি করেছেন যার সামাজিক আর সাংস্কৃতিক মন্তব্যগুলো তার সাথে এতটা জোরালোভাবে গাঁথা যে আপনি হাসতে হাসতে ভাববেন, আবার ভাবতে ভাবতে হাসবেন।”
সিনে ভার্টিগো তাদের রিভিউ এ বলেছে, “…নিখুঁতভাবে লিবারেল শ্বেতাঙ্গদের ভণ্ডামিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে…”
সমালোচকদের বিচারে গত বছরের সেরা হরর সিনেমা গেট আউট। শুধু সেরা হররই না, গেট আউট গত বছরের সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একটি। এ বছরের অস্কারে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা অভিনেতা, সেরা পরিচালকসহ মোট চারটি ক্যাটাগরিতে নমিনেশন পেয়েছে ছবিটি। ছবিটির আইএমডিবি রেটিং ১০ এ ৭.৭, মেটাক্রিটিক স্কোর ৮৪% এবং রটেন টমেটোজ স্কোর ৯৯%।
ট্রিভিয়া
- কমেডিয়ান এডি মারফির স্ট্যান্ড-আপ ফিল্ম ‘এডি মারফি: ডিলিরিয়াস’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জর্ডান পিল এ সিনেমার কাহিনী লিখেন।
- বিখ্যাত মার্কিন র্যাপ মিউজিক তারকা চ্যান্স দ্য র্যাপার এই সিনেমা দেখে এতটাই মুগ্ধ হন যে তিনি শিকাগোর মুভি থিয়েটারগুলো থেকে সব টিকেট নিজেই কিনে নিয়ে আসেন, যাতে করে মানুষ বিনামূল্যে সিনেমাটি উপভোগ করতে পারে।
- প্রথমে সিনেমার প্রধান চরিত্র হিসেবে এডি মারফিকেই রাখার চিন্তা করা হয়েছিল। কিন্তু ‘ক্রিস’ চরিত্রটির তুলনায় মারফি অনেক বেশি বয়স্ক হওয়ায় পরে ক্যাস্টে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
- পুরো সিনেমাটি চিত্রায়িত হয়েছে মাত্র ২৩ দিনে।