Hold fast to dreams
For if dreams die
Life is a broken-winged bird
That cannot fly.Hold fast to dreams
For when dreams go
Life is a barren field
Frozen with snow.– Langston Hughes
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়- বহুল প্রচলিত একটি কথা। তবুও কেন যেন এর মানে খুঁজতে গিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হয়। ‘বড়’ দিয়ে এই বাক্যটিতে কী বোঝান হয়েছে, তা এক রহস্যই বটে। এই বড় মানে কি সফল, নাকি সক্ষম? সংগ্রামী নাকি প্রত্যয়ী? নাকি আবার সবগুলো মিলিয়েই শব্দটি জীবনের নিক্তিতে মাপা হয়? না, এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর হয়ত পাওয়া সম্ভব নয় এই ছবিটি থেকে। কারণ, ছবিটি শুধু বোঝাতে চায় স্বপ্নের মূল্য, জীবনে স্বপ্ন দেখার গুরুত্ব। আর বড় হওয়ার প্রথম শর্তই তো বড় বড় স্বপ্ন দেখা, তাই না?
সিক্রেট সুপারস্টার ছবির গল্পটা সাধারণ এক পরিবারের বেড়ে ওঠা, বড় বড় স্বপ্ন বুনে চলা ১৫ বছর বয়সী ইনসিয়া আর স্বপ্নের জন্য তার অনবরত লড়াইয়ের। খুবই সাধারণ কাহিনী মেয়েটার। ভারতের ছোট্ট একটি শহর, বরোদাতে বাবা, মা, ছোট ভাই আর দাদির সাথে বসবাস ইনসিয়ার। সাধারণ, মধ্যবিত্ত একটি পরিবার তাদের। ইনসিয়া ক্লাস টেনে পড়ে। আর দশটা মেয়ের মতো দুই বেণী করে, স্কুল বাসে চড়ে স্কুলে যায়, মাকে সময়-অসময়ে ঘরের কাজে সাহায্য করে। কোচিং করে, বন্ধুদের সাথে ভ্রমণে যায়, যাত্রাপথে গানের কলি খেলে। তবে এই সাধারণ জীবনের মাঝে অসাধারণ হচ্ছে তার প্রতিভা, তার স্বপ্ন। ছয় বছর বয়স থেকে গিটার বাজানো মেয়েটা একটু একটু করে বুকে লালন করছিল একদিন অনেক বড় গায়িকা হবার স্বপ্ন। আর সব বাঁধা অতিক্রম করে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চিত্রটি খুব সুন্দরভাবেই ফুটে উঠেছে এই ছবিতে।
সব গল্পেই নাকি একটি করে তাগড়া খলনায়ক লাগে। না হলে নাকি কোনো গল্পই বেশ একটা জমে না। তাই এই গল্পকেও উপভোগ্য করে তুলতে বেশ বড়সড় দুই খলনায়ক আছে। এক হলো ইনসিয়ার বাবা, আরেক হলো চারপাশের সমাজ। মেয়েদের জীবনটাই আসলে লড়াইয়ের। জন্মের পর প্রত্যেক মুহূর্তই যেন এক নতুন লড়াই। স্বপ্ন দেখতে হলে লড়তে হয়, স্বপ্নের জন্য লড়তে হয়, বাঁচতে হলে লড়তে হয়, নিজের অধিকারের জন্য লড়তে হয়। এমনকি কখনো কখনো তো জন্ম নেবার জন্যও লড়াই করতে হয়। এ সকল বিষয়ই বেশ স্বাভাবিক এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ছবিটিতে পরিচালক আদভেইত চন্দন। ছবিটি কোনো সামাজিক সমস্যা নিয়ে আওয়াজ তোলে না। কিন্তু সমাজের যে রীতিগুলো মেয়েদের ছোট থেকে বড়, সব ধরনের স্বপ্ন জন্ম নেবার আগেই গলা টিপে হত্যা করে সেগুলোকে বেশ দাপটের সাথেই সামনে নিয়ে আসে।
ইনসিয়ার বাবা তার কোনো সাধ-আহ্লাদকেই বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেয় না। মেয়ে বলে সবসময়েই বাড়িতে তার কদর কম। এই সমাজ সবক্ষেত্রে ছেলেদের এগিয়ে রাখে, তার ক্ষেত্রেই বা নিয়মটা ভিন্ন হবে কেন! মেয়েরা আজীবনই বোঝা, তাদের স্বপ্ন বাতুলতার সমান। ইনসিয়ার বাবা কথায় কথায় তার গিটার বাজানো আর গান গাওয়াকে তাচ্ছিল্য করে। সমাজের আর দশটা অত্যাচারী পুরুষের মতো সামান্য ভুলের জন্য হাত তোলে তার মা, নাজমার গায়ে। সব মিলিয়ে মেয়েদের প্রতি সমাজের বিরূপ ব্যবহারের উদাহরণ এই একটি পরিবারকে দিয়েই সুচারুভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। সমাজের চোখে, ছেলেদের হুকুমের দাসী মেয়েরা। এই দৃশ্যও বেশ ভালভাবেই তুলে ধরা হয়েছে এই গল্পে। কথায় কথায় গায়ে হাত ওঠানো, নিজের ইচ্ছা তাদের ঘাড়ে চাপানো একটি অতি সাধারণ বিষয় ইনসিয়াদের পরিবারে। ইনসিয়ার বাবার কোনো তোয়াক্কা নেই ইনসিয়া আর তার মায়ের প্রতি। তার সব চিন্তা তার ছেলে, ছোট্ট গুড্ডুকে ঘিরে। সবাই গুড্ডুকে আদর দিয়ে মাথায় তুলে রাখে, কিন্তু ইনসিয়ার শখের গিটারটারও জায়গা হয় না তাদের বাড়িতে।
জীবনের এই চন্দ্রগ্রহণে, ইনসিয়ার সূর্য যেন তার মা! পরিবারে তার সবচেয়ে বড় সমর্থক, বন্ধুর চেয়েও আপন মাকে ঘিরেই তাই ইনসিয়ার দুনিয়া ঘুরছে। সমাজ আর বাবা যতই না করুক, স্বপ্ন তো ভেঙ্গে যাওয়ার জন্য দেখা হয়নি। তাই ইনসিয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে নাজমা নিজের গলার হার বিক্রি করে, লুকিয়ে মেয়েকে কিনে দেন একটি ল্যাপটপ। আর সেই থেকে ঘুরে যায় ইনসিয়ার জীবন। লাইক ক্লিক আর সাবস্ক্রাইবের দুনিয়ায় ইনসিয়া সহজেই নিজের পরিচয় গড়ে নেয়। পৃথিবী জয় করে নেয় সে ১৬ ইঞ্চির পর্দাটির মাধ্যমে। ইউটিউবে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায় সে তার গান দিয়ে! কিন্তু সবার থেকে লুকিয়ে, বোরখা পরে, যাতে বাবা না জানতে পারে।
এদিকে শক্তি কুমার (আমির খান) নামে এক বলিউড কম্পোজারের নজর পড়ে তার উপর। আমির খানের চরিত্রটাই এমন যে, তাকে দেখলেই ঘৃণা করতে মন চায়। ছবিতে শক্তি কুমারের ক্যারিয়ার একবারে তলানিতে এসে ঠেকায় সে নতুন ইউটিউব গায়িকা ইনসিয়ার সাথে কাজ করতে অনেক আগ্রহ প্রকাশ করে। প্রথমে তার বাজে পরিচয়-পরিচিতির জন্য ইনসিয়া মানা করলেও, পরে বাবার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে অবশেষে রাজি হয় সে। এরপর কিভাবে ইনসিয়া আর নাজমা নিজেদের মেধা আর সাহসের উপর ভর করে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ঘুরে দাঁড়ায় তা নিয়েই বাকি গল্পটা এগিয়ে গিয়েছে।
সিক্রেট সুপারস্টার আসলে একটি সাধারণ গল্পচ্ছলে বলা কৌশলী একটি ছবি। অনুভূতির অবশ দেয়ালগুলো ভেঙ্গে, হেসে-খেলে যুদ্ধ জয়ের কাহিনী। পরিচালক আদভেইত চন্দনের প্রথম ছবি এটি। সুন্দর গল্পের পরিকল্পিত সম্পাদনা ছবিটিকে সকল প্রশংসার দাবিদার করে তুলেছে। প্রথম কাজ হিসেবে পরিচালক বেশ দুর্দান্ত কাজই করছেন বলতে হয়। স্ক্রিপ্টেও বেশ দক্ষতার ছাপ ফেলেছেন ভালভাবেই তিনি। আমির খান যে ছবি জড়িত তা বাকি সব বলিউড ছবির ফর্মুলা থেকে যোজন যোজন দূরে হাঁটবে- এটি যেন এক অলিখিত নিয়ম হয়ে গিয়েছে। গল্পটা একেবারে নতুন তা বলা যাবে না। কিন্তু পরিবেশনা যে ভিন্নরূপে করা হয়েছে এ বিষয়টি মেনে নিতেই হবে।
এরপর আসা যাক কলাকুশলীদের ব্যাপারে। ইনসিয়া চরিত্রে তুলনামূলক নতুন, ১৭ বছর বয়সী জাইরা ওয়াসিম সর্বপ্রথম নজর কাড়েন আমির খানেরই গত বছরের ছবি ‘দঙ্গল’ দিয়ে। শুরুতেই বাজিমাত করেন জাইরা। দঙ্গল ছবির জন্য সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরষ্কার বাগিয়ে নেন তিনি।
২০১৭ সালটি জাইরার জন্য বেশ ঘটনাবহুলই ছিল বলতে হবে। একদিকে যেমন কুড়িয়েছেন ‘দঙ্গল’ এর জন্য ভূয়সী প্রশংসা, অপরদিকে যৌন হয়রানি তাকে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছে বেশ অল্প বয়সেই। ‘এয়ার ভিস্তারা’ এর একটি প্লেনে যাতায়াতের সময় মধ্যবয়সী এক লোকের দ্বারা হয়রানির স্বীকার হন জাইরা। পরে ঘটনাটি তাৎক্ষণিকভাবে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করেন তিনি। এতে করে পর্দার পাশাপাশি বাস্তব জীবনেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এক শক্ত উদাহরণ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। ‘এয়ার ভিস্তারা’ এই ন্যাক্কারজনক ঘটনাটির জন্য পরে জনসমক্ষে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং পুরো বলিউড জাইরার সাহসিকতার প্রশংসা করে।
দঙ্গলের পর আবারও আমির খানের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন জাইরা, সিক্রেট সুপারস্টার ছবিটিতে। আর সিক্রেট সুপারস্টারের আসল স্টার তো আমির খান না, এই অল্প বয়সী মেয়েটি। পুরোটা ছবি তিনি তার প্রাণবন্ত পরিবেশনায় দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছেন। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই এমন সম্পাদনা জাইরার প্রতিভার উপর সবাইকে বিশ্বাস জোগাচ্ছে। এত কম বয়সে পুরো একটা ছবি নিজের কাঁধে তুলে নেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। জাইরা অবশ্য তা বেশ ভালভাবেই করে দেখিয়েছেন। তার অভিনয় প্রতিভা দর্শক-সমালোচক সবারই মন কেড়ে নিয়েছে। জাইরার মা চরিত্রে মেহের ভিজও বেশ নন্দিত হচ্ছেন সব মহলে। অশিক্ষিত, নিপীড়িত স্ত্রী এবং মমতাময়ী মায়ের চরিত্রে তার পরিবেশনা অত্যধিক সমাদৃত হচ্ছে। তার এবং জাইরার মা-মেয়ের রসায়ন মন ছুঁয়েছে লাখো মানুষের।
আর একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি হচ্ছেন আমির খান। ছবিতে ছিলেন খুব কম সময়ের জন্য। কিন্তু যেটুকু সময় ছিলেন তার রসিকতা, তামাশা আর অভিনয় দিয়ে দর্শকদের ভরপুর বিনোদন দিয়ে গিয়েছেন। যদিও শেষাংশে তার চরিত্রের কার্যকলাপ কিছুটা প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু তার স্বভাবসুলভ অভিনয়ে কোনো ত্রুটি ছিল না। তাছাড়া বন্ধুর চরিত্রে তীর্থ, বাবার চরিত্রে রাজ অর্জুন সবার অভিনয়ই বেশ দৃষ্টিনন্দন এবং স্বাভাবিক ছিল। তবে এই ছবির একটি বড় দুর্বল দিক ছিল এর সংগীত। ‘মেরি পেয়ারি আম্মি’ এবং ‘নাচদি ফিরা’ এই দুটি গান বাদে কোনো গানই তেমন কানে লাগে না। যেহেতু ছবিটি গান এবং বলিউডের সংগীত জগতকে ভিত্তি করে রচিত, তাই এর সংগীত আরও সুন্দর এবং দর্শকপ্রিয় হওয়া দরকার ছিল।
ছবিটি অবশ্য ভারতে তেমন ব্যবসা করতে পারেনি। দিওয়ালিতে মুক্তি পাবার পরেও বক্সে অফিসে ছবিটি আশানুরূপ ব্যবসা করতে ব্যর্থ হয়। এর মূল কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে একই দিনে বড় বাজেটের গোলমাল রোহিত শেঠীর ছবি ‘গোলমাল এগেইন’ এর মুক্তিকে। ভারতে ছবিটির আয় ছিল মাত্র ৬৩ কোটি রুপি। তবে আশ্চর্যজনকভাবে চীনে ছবিটির তিন সপ্তাহে আয় ছিল প্রায় এর থেকে দশ গুণেরও বেশি, ৭৫০ কোটি রুপি। এমনকি সবাইকে চমকে দিয়ে ছবিটি পিছনে ফেলে একই সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘মেইজ রানার’ এর তৃতীয় এবং শেষ কিস্তিকেও। এর আগে আমির খানের ‘দঙ্গল’ও একই রকম সাড়া পেয়েছিল চীনা বক্সঅফিসে।
পরিশেষে বলতেই হবে, ছবিটা অনুভব করার মতো একটি ছবি। পরিবার নিয়ে উপভোগ করার ছবি। এই ছবি হাসতে হাসতে কাঁদার, কাঁদতে কাঁদতে হাসার ছবি। হয়ত বড় কোনো সামাজিক সমস্যা এই ছবি দেখে রাতারাতি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আর সমাধান করাও অতটা সহজ হবে না। তবে যে সমস্যাগুলো আমরা চোখের সামনে অহরহ দেখি এবং চোখ ফিরিয়ে নেই সংকোচে সেগুলোকেই কিছু সময়ের জন্য আমাদের চোখের একদম সামনে এনে দাঁড় করায় ছবিটি।
হয়ত এমন করে দেখতে দেখতেই একদিন প্রতিরোধ গড়া সম্ভব হবে আমাদের দ্বারা। কারণ যেদিন সমস্যাগুলোর কথা ইচ্ছে করে ভুলে যাব আমরা, সেদিন কিন্তু ছোট-বড় সব স্বপ্নের মৃত্যু হবে!
ফিচার ইমেজ- blogTO