গভীর সাগরে ট্রলার নিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে ডাকাতের হাতে পড়ে মনু মিয়া (ফজলুর রহমান বাবু)। নৌকার সবাইকে ডাকাতরা গুলি করে মেরে ফেললেও বদির (মোশারফ করিম) সাহসিকতার জন্য জান নিয়ে ফিরে মনু আর বদি। মনুর জীবন বাঁচানোর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বাস্তুহীন বদিকে তাদের বাড়িতে স্থান দেয় মনুর স্ত্রী জমিলা। এই সময়েই তাদের মেয়ে হাসুর (নুসরাত ইমরোজ তিশা) সাথে একরকম সখ্যতা তৈরি হয় বদির।
সেদিন মনু মিয়া সমুদ্র থেকে বেঁচে ফিরে ঠিকই, কিন্তু তার মাছ ধরার সব জাল নিয়ে যায় ডাকাতেরা। নিঃস্ব মনুর কাঁধে চাপে দেনার পাহাড়। এই দেনা থেকে তাকে মুক্তির পথ দেখায় পাওনাদার। বিত্তশালী নাদের চৌধুরী (জাহিদ হাসান) তার মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ইটকলের মালিক নাদের পূর্ব-বিবাহিত এবং নিঃসন্তান। শুধু একটি সন্তানের জন্যই সে হাসুকে ঘরে আনতে চায়। শুরুতে রাজি না হলেও বাবার দুরবস্থা দেখে বিয়েতে রাজি হতে হয় হাসুর। নতুন জীবন শুরু হয় তার। বড় বৌয়ের হিংসা, স্বামীর অত্যাচারের মাঝে হাসুর মন টিকে না। ফিরে যেতে চায় বদির কাছে।
সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশের সিনেমায় নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষেরা বলতে গেলে প্রায় উপেক্ষিত। এক তারেক মাসুদের পর আর কোনো নির্মাতার চোখ ঐদিকে যায় নি। ব্যতিক্রম এক তৌকীর আহমেদ। বুয়েটে স্থাপত্যকলায় পড়া একসময়ের নন্দিত এই অভিনেতার সিনেম্যাটিক ভিশনে বারবার উঠে এসেছে উপেক্ষিত খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত শ্রেণীই। সুনিপুণ নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে স্বল্প বাজেটে মানুষের জীবনের গল্প বলে যাওয়া তৌকীরের সিনেমা যেমন দেশের রুচিশীল মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে, তেমনি হয়েছে সমালোচক নন্দিতও। ‘অজ্ঞাতনামা’র পর নির্মাতা তৌকীর আহমেদ এবার হাজির হয়েছেন উপেক্ষিত হালদা পাড়ের মানুষ এবং যাকে ঘিরে এই মানুষদের জীবন, সেই হালদা নদীর কান্না নিয়ে।
খাতায় কলমে ‘হালদা’কে একটা সাধারণ সিনেমা মনে হতে পারে, কিন্তু রূপালি পর্দায় তৌকীর আহমেদ তার সব বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলনে এক মনোমুগ্ধকর অর্কেস্ট্রা পরিবেশন করেছেন। সিনেমার প্রতিটি ফ্রেম সাজানো হয়েছে যত্নের সাথে। এনামুল হক সোহেলের ক্যামেরার প্রতিটি দৃশ্যায়নে রয়েছে শৈল্পিক ছোঁয়া। ফ্রেমিং, ক্যামেরার কাজ, সাউন্ডট্র্যাক, ফিল্টার এবং আলোছায়ার ব্যবহার এতোটাই নিখুঁতভাবে করা হয়েছে যে, সবকিছুর মিশেলে সিনেমাটি একদম জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তৌকীর আহমেদ ‘হালদা’ নিয়ে কথা বলার সময় বলেছেন, অজ্ঞাতনামা বক্স অফিসে ব্যর্থ হওয়ার পর হালদায় তিনি নতুন ফর্মূলা প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন যাতে এবার ছবিটি সর্বসাধারণের মাঝে পৌঁছায়। তার সে চেষ্টার স্বাক্ষর ছবিতে রয়েছে। শিল্প-মান বজায় রেখে ছবিকে যতটা দর্শক-বান্ধব করা সম্ভব করেছেন। সিনেমায় সংগীতের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। দুই ঘণ্টা পনের মিনিটের সিনেমায় গান আছে মোট সাতটি। সিনেমার প্রথম অর্ধেককে মিউজিক্যাল বললেও ভুল বলা হবে না। তৌকীরের আগের কোনো সিনেমায় আমরা এতো সংগীতের ব্যবহার দেখিনি। তবে পিন্টু ঘোষের সংগীত হতাশ করেনি। মিউজিক সিনেমাটিকে আরও সজীব করেছে, জীবন্ত করেছে।
নির্মাতা তৌকীর আহমেদকে আমরা সবসময়ই দেখেছি একজন পারফেকশনিস্টের ভূমিকায়। এই ছবিতে তিনি একত্র করেছেন তার মতোই একদল পারফেকশনিস্টকে। তিশা, জাহিদ হাসান, মোশারফ করিম, ফজলুর রহমান বাবু, দিলারা জামান; বাংলাদেশের অভিনয় জগতের প্রায় সব মহারথীকে একত্র করা হয়েছে ‘হালদা’য়। এবং বলা বাহুল্য, সবাই তাঁদের সেরাটাই দিয়েছেন। চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষা (চাটগাঁইয়া ভাষা) সবাই এতোই নিখুঁতভাবে রপ্ত করেছে যে আপনার মনে হবে এদের সবাই বুঝি ছোটবেলা থেকেই এই চাটগাঁইয়া ভাষাতেই কথা বলে আসছে। ভাষার পাশাপাশি সিনেমায় চট্টগ্রামের লোক-ঐতিহ্যও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিপুণভাবে। নৌকা-বাইচ, বলিখেলা, পালাগান- বাদ ছিল না কোনকিছু। এছাড়া সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যই ছিল প্রাকৃতিক। বৃষ্টির দৃশ্য, বজ্রপাতের দৃশ্য কিংবা বর্শা দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য, প্রতিটি দৃশ্যই যতটুকু বাস্তব করা সম্ভব করা হয়েছে।
‘হালদা’র মাধ্যমে পরিচালক একটি বড় সামাজিক ও জাতীয় সঙ্কট আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন, যা এতোদিন আমাদের কাছে উপেক্ষিত ছিল। হালদা দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র এবং বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাঁটার নদী। আমাদের অবহেলা এবং ভোগবাদীদের অর্থলোভের কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারাচ্ছে হালদা, বিপর্যস্ত হচ্ছে হালদা পাড়ের মানুষের জীবন। পরিচালক মূল কাহিনীর সাথে সিনেমার কাঠামোটা এমনভাবে সাজিয়েছেন যাতে করে এই সামাজিক দায়বদ্ধতা আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। তারেক মাসুদের পর এদেশে কোনো নির্মাতা এতো দৃঢ় বার্তা নিয়ে, সামাজিক দায়বদ্ধতার কাহিনী নিয়ে আমাদের কাছে আসেননি।
নিঃসন্দেহে ‘হালদা’ এ বছরের অন্যতম সেরা বাংলা চলচ্চিত্র। তৌকীর আহমেদ নিজে কিছুটা প্রচারবিমুখ হওয়াতে তার আগের ছবিগুলোও দেখেনি তেমন বাণিজ্যিক সাফল্য। কিন্তু ‘জয়যাত্রা’ থেকে শুরু করে ‘অজ্ঞাতনামা’, তার সব ছবিই এদেশের সিনেমা-প্রেমীদের স্পর্শ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সাড়া ফেলেছে অজ্ঞাতনামা। কিন্তু এ ‘সাড়া’ ছবি হলে চলা অবস্থায় ফেলেনি। ইউটিউবে বের হওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তোলে অজ্ঞাতনামা। গতবারের ভুল শুধরে এবার কিছুটা ভিন্ন পথে হেঁটেছেন পরিচালক। এবারের ছবিকে দর্শকবান্ধব করার জন্য তৌকীরের প্রয়াস দৃশ্যমান।
পরিশেষে, ‘হালদা’ জীবন ও জীবিকার গল্প। পাওয়া, না-পাওয়ার গল্প। হালদা পাড়ের মানুষের দিবারাত্রির এই কাব্য চিত্রায়নের পাশাপাশি পরিচালক একটি জরুরি সামাজিক দায়বদ্ধতার দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করাতে চেয়েছেন। বহুবছর পর আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, সমাজ-সচেতনতা তৈরির একটি হাতিয়ার হচ্ছে সিনেমা। দিনশেষে ‘হালদা’ তৌকীর আহমেদের আরেকটি মাস্টারপিস হিসেবেই জায়গা করে নিবে। আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির জন্যও ‘হালদা’ একটি অমূল্য রত্ন। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে সমৃদ্ধ করতে হলে এরকম আরও ‘হালদা’ দরকার। দেশের চলচ্চিত্রে বিপ্লব আনতে হলে, চলচ্চিত্রের বিশ্বায়নে জায়গা করে নিতে হলে আমার আরও ‘তৌকীর’ দরকার।
কেন দেখবেন ‘হালদা’?
- প্রথমত, এটি তৌকীর আহমেদের চলচ্চিত্র। ‘অজ্ঞাতনামা’র পর সারা দেশের সিনেমাপ্রেমীরাই অপেক্ষা করে আছে তার পরবর্তী ছবির জন্য।
- ‘হালদা’য় একত্র করা হয়েছে এদেশের সিনেমায় স্মরণকালের সবচেয়ে শক্তিশালী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। তিশা, মোশারফ করিম জাহিদ হাসান, ফজলুর রহমান বাবুদের একসাথে দেখা মিলবে না অন্য কোনো এখন পর্যন্ত অন্য কোনো সিনেমায়।
- জাহিদ হাসান প্রথমবারের মতো নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করছেন এই সিনেমায়। যে জাহিদ হাসানকে আমরা সবসময় দেখে এসেছি রোমান্টিক বা রসিক চরিত্রে, এ সিনেমায় সেই জাহিদ হাসানকে দেখা যাবে খল চরিত্রে।
- সিনেমার দৃশ্যায়ন করা হয়েছে চট্টগ্রামের মনোরম সব স্থানে। এই দৃশ্যায়নই আপনার চোখকে সোয়া দু’ঘণ্টা সিনেমার পর্দায় আটকে রাখবে।
- ছবিটি এককথায় সংগীতময়ও। পিন্টু ঘোষের প্রতিভার ছাপ পড়েছে সিনেমার প্রতিটি স্কোরে।
- যারা ভাষা নিয়ে ভয় পাচ্ছেন, তাদের জন্য সুসংবাদ। ইংরেজি সাবটাইটেল আছে সাথে।
ট্রিভিয়া
- সিনেমার কাহিনী, সংলাপ ও দৃশ্যায়নকে বাস্তবসম্মত করতে একজন গবেষকও কাজ করেছেন তৌকীরদের সাথে। গবেষণার দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া।
- এবারই প্রথমবারের মতো তৌকীর আহমেদের সিনেমায় অভিনয় করছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা।
- তৌকীর আহমেদের পরিচালনায় এটি মোশাররফ করিমের পঞ্চম ছবি। মজার ব্যাপার হচ্ছে তৌকীর আহমেদের পরিচালিত মোট ছবির সংখ্যাও পাঁচ। নিজের প্রতিটি ছবিতেই তৌকীর আস্থা রেখেছেন গুণী এই অভিনেতার উপর।
- চিরকুট থেকে বের হওয়ার পর এই প্রথম কোনো সিনেমার সংগীত পরিচালনা করলেন পিন্টু ঘোষ।
- সিনেমাটির পোস্টার ডিজাইন করছেন বিপাশা হায়াত নিজে।