থ্রিলারধর্মী সিনেমার জন্য কোরিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি অনেক আগে থেকেই বিখ্যাত। পরতে পরতে টুইস্ট এবং কাহিনীর বৈচিত্র্যে দক্ষিণ কোরিয়ান বেশ কিছু সিনেমা হলিউডের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে। এরকমই ৫টি সিনেমার কথা আজ বলবো। প্রতিটি সিনেমা আপনাকে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত পর্দায় চোখ আটকে রাখতে বাধ্য করবে, তা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়।
১) আই স দ্য ডেভিল (২০১০)
আমি তোমাকে খুন করবো, আমি তোমাকে খুন করবো যখন তুমি ব্যথায় কাতরাবে তখন। ভয় তোমাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে আর আমি তোমাকে ধীরে ধীরে খুন করবো। এটাই আমার প্রতিশোধ, সবচেয়ে সুন্দর এবং পরিপূর্ণ প্রতিশোধ।
নাম থেকে বোঝা যায় কেউ একজন শয়তানরুপী কাউকে দেখেছে। সিনেমাটিতে আছে এক সাইকোপ্যাথ সিরিয়াল কিলার যে কিনা খুন করে অসম্ভব নৃশংসতায়। এমনকি খুন করার পর শিকারের শরীরের বিভিন্ন অংশ জঘন্যভাবে কেটে ফেলে রেখে যায়। শয়তানরুপী মানুষ বলতে কি তাহলে তাকেই বোঝানো হয়েছে?
সিনেমাটি আসলে ভয়ংকর এক প্রতিশোধের গল্প বলে। সবচেয়ে কাছের মানুষটির হত্যার বদলা নিতে একজন সিক্রেট এজেন্ট একটি বিচিত্র পরিকল্পনা করে। সে মনে করে, হত্যাকারীকে শুধু হত্যা করলেই সেটা উপযুক্ত প্রতিশোধ হয় না, তার জন্য দরকার আরও বেশি কিছু। আর এই পরিকল্পনাই তাকে পরিণত করে ভয়ানক এক দানবে, যার নৃশংসতা ছাড়িয়ে যায় ঐ সিরিয়াল কিলারের নৃশংসতাকেও।
সিনেমাটি সম্পর্কে শুধু এটুকুই বলা যায়, এটি একটি খাঁটি রিভেঞ্জ মুভি। এছাড়া সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার, ক্রাইম কিংবা হরর সব উপাদান পাওয়া যাবে এতে। সাইকোপ্যাথ সিরিয়াল কিলার হিসেবে অসাধারণ অভিনয় করেছে ওল্ডবয় খ্যাত চয় মুন সিক। সাইকোপ্যাথ হিসেবে একটি চরিত্রের মধ্যে যা যা দরকার তার সবটুকুই সে ফুটিয়ে তুলেছে। সিক্রেট এজেন্টের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছে লি বিইয়ুং হুন, যার চরিত্রের শীতলতায় আপনার মেরুদন্ড বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যাবে।
আগেই বলে রাখা ভালো সিনেমাটিতে রয়েছে প্রচুর ভয়াবহ অপরাধমূলক দৃশ্য। শুরু থেকে শেষপর্যন্ত প্রতি মুহুর্তে আপনার মানসিক শক্তির সর্বোচ্চ পরীক্ষা করবে আই স দ্য ডেভিল।
এখনই এত দুর্বল হলে চলবে? এটাতো সবে শুরু। তোমার দুঃস্বপ্নের শুরু হলো মাত্র।
পরিচালক: জি-উন কিম
জনরা: অ্যাকশন, ড্রামা, হরর
আইএমডিবি রেটিং: ৭.৮
২) অ্যা বিটারসুইট লাইফ (২০০৫)
অ্যা বিটারসুইট লাইফ সিনেমার মূল চরিত্র কিম সুন উ একটি কুখ্যাত সন্ত্রাসী দলের একদম উপরের দিকে থাকা একজন। হোটেলের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বসের ডানহাত সে। বসের সাথে তার সম্পর্ক খুবই ভালো এবং তার আনুগত্য নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই। সবকিছু ভালোই চলছিলো, কিন্তু হঠাৎ পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে গেলো যখন পর্দায় আবির্ভাব ঘটলো তার বসের সুন্দরী স্ত্রী হি সু এর। বসের ধারণা তার স্ত্রী অন্য কারো সাথে পরকীয়ায় জড়িত।
ঘটনা সত্যি হলে তাকে নির্দেশ দেওয়া হয় হি সুকে মেরে ফেলার জন্য। কিন্তু হি সু এর প্রতি দুর্বল হয়ে যায় সে, অমান্য করে বসের আদেশ। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে বস লোক পাঠায় তাকে মেরে ফেলার জন্য। নিজেকে বাঁচানোর জন্য তাকে এবার লড়াই করতে হবে পুরো একটি সন্ত্রাসী দলের সাথে। এরপরের কাহিনী প্রতিশোধ এবং ঘাত-প্রতিঘাতের। তার জীবন হয়ে যায় সিনেমার নামের মতো।
সিনেমার সবচেয়ে ভালো দিক এর দুর্দান্ত অ্যাকশন দৃশ্যগুলো। এছাড়া স্পেশাল ইফেক্টও যথেষ্ট ভালো। নায়কের ‘বিটারসুইট লাইফ’ আপনাকে স্পর্শ করবে গভীরভাবে।
পরিচালক: জি-উন কিম
জনরা: অ্যাকশন, ড্রামা
আইএমডিবি রেটিং: ৭.৭
৩) দ্য চেজার (২০০৮)
আর্থিক সমস্যার কারণে সাবেক ডিটেকটিভ ইয়োম জং হো জড়িয়ে পরে যৌন ব্যবসায়। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে সে লক্ষ্য করে, তার তত্ত্বাবধানে থাকা মেয়েরা একে একে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। তার ধারণা টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে তারা।
একদিন তার পরিচিত একজন একটি মেয়ের জন্য তাকে কল করে। আপাদমস্তক লোভী ইয়োম জং হো-কে আর যা-ই হোক, ভালো মানুষের কাতারে ফেলবে না কেউ। অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও মি জিন নামের একটি মেয়েকে ঐ লোকটির কাছে যেতে বাধ্য করে সে। এরপর সে হঠাৎ আবিষ্কার করে, এখন পর্যন্ত যতগুলো মেয়ে হারিয়ে গেছে, তাদের সবাইকে সে ঐ লোকের কাছে পাঠিয়েছিলো!
ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে কত বড় ভুল করে ফেলেছে সে। তার অনুশোচনা হয় মি জিন আর তার ছোট্ট মেয়ের জন্য। হন্যে হয়ে সে খুঁজতে থাকে ঐ লোককে, বুঝতে পারে তার উপর নির্ভর করছে মেয়েটির জীবন। ওদিকে মি জিনও বুঝতে পারে সে ভয়ানক এক সিরিয়াল কিলারের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে। নিজের বুদ্ধিমত্তার সর্বোচ্চটা দিয়ে সে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করে ঐ ফাঁদ থেকে। বাঁচা-মরার এই লড়াইয়ে কার জয় হবে শেষপর্যন্ত সেটা জানার জন্য সিনেমাটি দেখে নিন।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি দৃশ্য আপনাকে আবেগতাড়িত করবে, চরিত্রগুলোকে মনে হবে খুব কাছের, যার মূল কারণ হলো সবার অসাধারণ অভিনয়। এর সাথে সিনেমাটির দুর্দান্ত সমাপ্তি তো আছেই।
পরিচালক: হং-জিন না
জনরা: অ্যাকশন, ক্রাইম, থ্রিলার
আইএমডিবি রেটিং: ৭.৯
৪) দ্য গুড দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য উইয়ার্ড (২০০৮)
এবারে আপনাদের বলা হবে একটি পুরোদস্তুর অ্যাকশনধর্মী কোরিয়ান সিনেমার কথা। মনে আছে সার্জিও লিওনের ১৯৬৬ সালে মুক্তি পাওয়া সেই বিখ্যাত ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্র দ্য গুড দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি এর কথা? কবরস্থানের নিচে লুকনো সোনার মুদ্রা পাওয়ার জন্য তিনজনের মধ্যে সেই লড়াই অনেক আগেই পেয়েছে ক্লাসিকের মর্যাদা।
ওই ক্লাসিক ওয়েস্টার্ন মুভি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কোরিয়ান পরিচালক কিম জি উন নির্মাণ করেন দ্য গুড দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য উইয়ার্ড। সিনেমাটিকে রিমেক বলা যাবে না, কাহিনীতেও তেমন কোনো মিল নেই কেবল চরিত্রগুলো সামান্য সাদৃশ্য ছাড়া। আগের মতোই দ্য গুড হলো একজন বাউন্টি হান্টার, দ্য ব্যাড হলো ঠান্ডা মাথার এক খুনী আর দ্য আগলি এর জায়গা দখল করেছে একজন দ্য উইয়ার্ড যে আসলে একজন ট্রেন ডাকাত।
দ্য গুড দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি এর সাথে এই সিনেমার তুলনা করলে হয়তো হতাশ হতে পারেন অনেকে কিংবা কাহিনীর গভীরতা নিয়েও অনেকের আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ২ ঘন্টা ১০ মিনিটের এই সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো সময় জুড়ে আছে নানা ধরনের ব্যতিক্রমধর্মী অ্যাকশন দৃশ্য, যা আপনাকে দেবে নিখাঁদ বিনোদন।
পরিচালক: জি উন কিম
জনরা: অ্যাকশন, অ্যাডভেঞ্চার, কমেডি
আইএমডিবি : ৭.৩
৫) মেমোরিজ অব মার্ডারস (২০০৩)
২০০৭ এ ডেভিড ফিঞ্চারের জোডিয়াক সিনেমাটি যখন মুক্তি পেল তখন সবাই এটাকে তুলনা করতে লাগলো একটি কোরিয়ান সিনেমার সাথে যার নাম মেমোরিজ অফ মার্ডারস।
১৯৮৬ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ার শান্ত শহর হুয়েসিয়ংকে ওলটপালট করে দিয়েছিল এক কুখ্যাত সিরিয়াল কিলিংয়ের ঘটনা। ঐ সময়টুকুর মধ্যে বিভিন্ন বয়সী ১০ জন নারীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয় এবং সবার লাশ পাওয়া যায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায়। পুলিশ প্রশাসন আদাজল খেয়ে নামে তদন্তের জন্য। অনেক পুলিশ সদস্য এবং গোয়েন্দা নিয়োগ করা হয় আসল খুনিকে ধরতে। সন্দেহভাজনদের তালিকা ক্রমশ বড় হতে থাকে এবং ধারণা করা হয় সংখ্যাটি সব মিলিয়ে ২১,২৮০ তে গিয়ে দাঁড়ায়!
সেই সত্য ঘটনা অবলম্বনে জুন-হো বং নির্মাণ করেন মেমোরিজ অফ মার্ডারস। সিনেমাটির শুরুতে একজন স্থানীয় ডিটেকটিভকে একটি খুনের ঘটনা তদন্ত করতে দেখা যায়। তার কাছে মনে হয় খুনিকে ধরা খুবই সহজ হবে, কারণ তার মতে সে অনেক ক্লু নাকি পেয়ে গেছে। কিন্তু তার ধারণা যে কতটুুকু ভুল তা সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারে এবং এর মধ্যেই ঘটে যায় আরেকটি খুনের ঘটনা। এমন সময় সিউল থেকে আরেকজন ডিটেকটিভ আসে তাকে সহায়তা করার জন্য, যা বদলে দেয় তদন্তের গতিপথ। তারা এই ঘটনার সাথে যোগসূত্র খুঁজে পান আরেকটি খুনের, কিন্তু অধিকাংশ সময়েই দুজন একে অপরের কথার সাথে একমত হতে পারে না। এভাবে এগিয়ে যেতে থাকে এক সিরিয়াল কিলারকে ধরতে দুই ডিটেকটিভের তদন্তের অনবদ্য কাহিনী।
শুরুতে এই সিনেমাটি একটু ধীরগতির মনে হতে পারে, কিন্তু শুরুর দিকের ধীরগতির এই সিনেমাটিই আপনাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেবে। সিরিয়াল কিলিং নিয়ে সিনেমা এবং ডিটেকটিভ থ্রিলার যাদের পছন্দ, তাদের জন্য এই কোরিয়ান মাস্টারপিসটি একদম যথোপযুক্ত।
পরিচালক: জুন-হো বং
জনরা: অ্যাকশন, ক্রাইম, ড্রামা
আইএমডিবি রেটিং: ৮.১