Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্য ব্লুয়েস্ট আই: নীল নয়নের আজন্ম অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা

একই পৃথিবীতে একই হাওয়া-জলে কেউ সুন্দর, আরাম আর বিলাসিতার জীবন কাটাচ্ছে, আর কারো কাছে জীবন মানেই কঠোর কষ্টভোগ, কারো জীবন মানেই শত বৈষম্যে ঘেরা এক অগ্নিপরীক্ষার ক্ষেত্র। একই আয়নায় মানুষের মধ্যেই একজনের মুখ সৌন্দর্যের প্রতীক, অন্যজনের মুখ যেন তার নিজের জন্যেই হীনতা বয়ে আনে কেবল। সমাজে একজন মানুষ যখন কেবল নিজের জন্মের জন্য পাচ্ছে সকল সুযোগ-সুবিধা, অন্যজন তখন একই কারণে হচ্ছে বঞ্চিতদের একজন, হচ্ছে অসম্মানিত আর অবহেলিত। এই সুন্দর পৃথিবী এক শ্রেণির মানুষের জন্য যখন স্বর্গতুল্য, অন্য আরেক শ্রেণীর মানুষের জন্য তা জন্মের পূর্ব থেকে মৃত্যুর পর পর্যন্ত এ যেন এক চলমান নরকবাস। এই অভাগা শ্রেণীর জন্যই লেখক মানিক বন্দোপাধ্যায় বলে গেছেন তার লেখনীতে, “ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে ভদ্র পল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।

অর্ধেক নয়, সম্পূর্ণ পৃথিবীটাই মানবজাতির একাংশের জন্য চিরকাল থেকেছে বৈষম্যতে পরিপূর্ণ- বর্ণ বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্য, শ্রেণী বৈষম্য, জাত বৈষম্য। এই বৈষম্যপীড়িত মানুষদের কথা আমাদের শুনিয়েছে সাহিত্য। বিশেষ করে নিপীড়িত মানুষদের জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাসগুলো সেই হাহাকারময় জীবনের এক বাস্তব রূপের লেখচিত্র আঁকে। এমনি এক উপন্যাস টনি মরিসনের লেখা ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’। লেখক যেন কৃষ্ণাঙ্গদেরই একজন হয়ে এক কৃষ্ণাঙ্গ বালিকার নির্দয় ভাগ্য আর অভিশপ্ত জীবনের কথা বলেছেন।

টনি মরিসন; source: thinglink.com

টনি মরিসন নিজে একজন আফ্রিকান-আমেরিকান লেখক হিসেবে এক কৃষ্ণাঙ্গ বালিকার জীবনের অত্যন্ত বেদনাবিধুর গল্প বলেছেন এই বইটিতে। বারো বছরের ছোট্ট কালো মেয়েটির জন্য কালো তো কেবল গায়ের রঙ নয়, কালো তার জীবনের এক অভিশাপ। কালো তাকে নগণ্য, মূল্যহীন বানায় প্রতি মুহূর্তে। কালো যেন তাকে নোংরা আর অপবিত্র করে সব সময়। তাই সে চায় নীল চোখ, সাদা ইউরোপিয়ানদের লালচে চুল আর নীল চোখ। সমাজে সৌন্দর্যের প্রতীক যে নীল চোখ, বিজ্ঞাপন আর বিলবোর্ডে উল্লেখিত সেই নীল চোখ, টেলিভিশনের নায়িকাদের মতো মনোমুগ্ধকর সেই নীল চোখ। নিজেকে সে আপাদমস্তক বদলে ফেলতে চায়। তার যে বর্ণের জন্য, গড়নের জন্য সে আজ অবহেলিত, মা তাকে ভালোবাসে না, কেউ প্রশংসা করে না, সেই বর্ণ আর গড়ন বদলে ফেলাই যেন জীবনের মূল কেন্দ্র হয়ে যায় তার।

দুটি নীল চোখের আকাঙ্ক্ষা; source: youtube.com

কিন্তু কেন সেই বারো বছরের পেকোলার নিজের প্রতি এত ঘৃণা জন্মালো? অতটুকু মেয়ে, যার জীবন শুরুই হলো না ভালোভাবে, কেন সে জীবনকে এখনই পর করে দিলো? আর কেনই বা জীবনও তাকে প্রত্যাখ্যান করলো বিনা দোষে? সেই গল্পই এই বইটির মূল উপজীব্য। পেকোলার জীবনের গল্প কোনো একটি জীবনের বৈষম্যের গল্প না, এই গল্প একইসাথে দেখায় তার বাবা-মায়ের নিষ্পেষিত ও অভিশপ্ত জীবন।

পরিবার ও সমাজ থেকে পেকোলার প্রত্যাখ্যাত জীবনের সাথে সাথে লেখিকা এখানে একইসাথে বলেছেন কীভাবে পেকোলার মা নিজের পরিবারের কাছেই অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে পড়ে, কীভাবে এই কিশোরীর পিতা নিজের শৈশবেই পতিত হয় জীবনযুদ্ধে আর কীভাবে তাদের ছেলে তাদেরই সেই শৈশবের উত্তরাধিকারী হয়। একটি চরিত্র দিয়ে এ যেন পুরো পরিবারের চিত্রায়ন করা, আবার একটি কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের দুর্দশা দিয়ে লেখিকা যেন বলতে চেয়েছেন এমন হাজারো পরিবারের গল্প। ম্যাকটিয়ার পরিবার, জেরাল্ডিন বা স্যামসন ফুলার- যে চরিত্রের কথাই বলা হোক না কেন, তা দেখায় বর্ণবৈষম্যের কোপানলে পিষ্ট হতে থাকা মানবজীবনকে।

একইসাথে এটাও বলতে হবে, উপন্যাসটি কেবলমাত্র বর্ণবৈষম্যের ওপর চিত্রিত কোনো সাহিত্যসৃষ্টি নয়, জীবনে অর্থনীতির প্রভাবও স্পষ্ট দেখানো হয়েছে এখানে। ম্যাকটিয়ার পরিবার বা জেরাল্ডিনের জীবন আর্থিক স্বচ্ছতার জন্য ব্রীডলাভ পরিবার থেকে বেশ খানিকটা সহজ হয়েছে। আবার পরিবারের ছেলে সন্তান থেকে মেয়ে সন্তান কীভাবে সকল বৈষম্যের শিকার সবার আগে হয়, সেটাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এখানে। নিজের পরিবারের যন্ত্রণাদায়ক জীবন থেকে ভাই স্যামি পালাতে পারলেও পালাতে পারে না পেকোলা। বাবা-মায়ের কলহের শিকার হতে তার দৃঢ় আপত্তি, তাই প্রায়ই সে মাস ধরে থাকে বাড়ির বাইরে। ছেলে হিসেবে যে স্বাধীনতা স্যামি ভোগ করে, তার সাথে আজীবন সম্পূর্ণ অপরিচিত থাকে বাড়ির ছোট্ট মেয়েটা। এই লিঙ্গ বৈষম্যের সর্বোচ্চ উদাহরণ পাওয়া যায় যখন পেকোলা নিজের পিতার হাতেই হয় শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার, দু-দু’বার মদ্যপ পিতার হাতে ধর্ষিতা হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে পেকোলা।

পিতৃস্নেহ তো দূরের কথা, মাতৃস্নেহও জোটে না পেকোলার ভাগ্যে। যে নিজেই কখনো আলো দেখেনি, সে কীভাবে আলো চেনাবে অন্যকে? পেকোলার মায়ের নিজের জীবনই অন্ধকারময়, স্নেহ-ভালোবাসার সাথে পরিচয় হয়নি কোনোকালে, আজন্ম নিজেকে নিজের পঙ্গুত্ব আর চেহারার জন্য, কখনো মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য কেবল দোষারোপ করতে জেনেছে। কালো বর্ণকে সে জেনেছে নোংরা আর ঘৃণার প্রতীক হিসেবে। নিজের সন্তানদের কালো বর্ণও তাকে তা-ই মনে করায় সব সময়। মেয়ের মধ্যে নিজেরই প্রতিবিম্ব দেখেছিল বলে নিজের মতো মেয়েকেও ঘৃণা করেছে সব সময়। তাই নির্যাতিত পেকোলার আশ্রয় হয় না সে মা হয়েও, বরং চারিত্রিক ত্রুটির আরোপ লাগায় সে নিজে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বন্দী জীবন বেছে নেয় মেয়ের জন্য।

একটি রিক্ততা আর ঘৃণার আখ্যান; source: pinterest.fr

ছোট্ট পেকোলাও নিজেকে চেনার আগে চিনেছে নিজের প্রতি ঘৃণাকে, চিনেছে বৈষম্য আর বিভেদকে, জেনেছে কেবল জন্ম আর বর্ণের ফেরে সে মানব সমাজে নেমে গেছে অনেক নিচে, হয়ে উঠেছে অবহেলা আর ঘৃণার পাত্র। পেকোলা যতটা না চকোলেট খেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি ভোগ করেছে দোকানদারের অবজ্ঞা। তার ভাগ্যে পুতুল জোটেনি কখনো, কিন্তু সে জানে সোনালি চুলের নীল নয়না পুতুলই সুন্দর, বোচা নাকের কালো কোনো পুতুল সুন্দর হতে পারে না। সে জানে তার আশ্রয়দাতা ম্যাকটিয়ার পরিবারের শিশুরা নিরাপদ, কাঙ্ক্ষিত ও আদুরে, কিন্তু তার পরিবারের শিশুদের এত কিছু চাইতে নেই। তাই সে চায়ও না কখনো এসব, খুব একা লাগলে নিজেদের ভাড়াটিয়া পতিতাদের সাথে গল্প করে।

বইটি একটি শিশুর শৈশবের কথা বলে না যেন, বরং বলে মানবজাতির মধ্যে থাকা আরো একটা জাতির কথা- যে জাতিকে ঠিক সেভাবে মানুষ ভাবা হতো না বহুকাল, ভাবা হতো পশু, শ্রমিকজাত, করা হতো ঘৃণা আর নৃশংস নির্যাতন, এমনকি যাদের হত্যা করাটাও দেখা হতো না কোনো অপরাধ না বড় ঘটনা হিসাবে। তাদের পণ্য বানিয়ে চালান করা হতো জাহাজ ভরে, যাদের জন্তু বানিয়ে দেখানো হতো চিড়িয়াখানার- পেকোলা, তার মা-বাবা বা বইটির অন্যান্য চরিত্রগুলো যেন প্রতিনিধিত্ব করে সেই মানুষদের।

শত শত পেকোলার না বলা কথা বলেছেন যিনি; source: slpl.org

বইটি শেষ হয় একটি শৈশবের করুণ পরিণতি দিয়ে, অনেকগুলো মনের হত্যা দিয়ে, মানবতার চরম পতন দিয়ে। শুধু শেষ হতে হতে বলে যায় সাদা চামড়ার এক জোড়া নীল চোখ কীভাবে হয়েছে সৌন্দর্য আর সামাজিক সম্মানের পরিমাপক, মানুষে মানুষে বাড়িয়েছে দূরত্ব অথবা হয়ে উঠেছে অভিশাপ হাজার জীবনের, বিষে নীলাভ করেছে শত সহস্র শৈশবকে। বইটি যেন পক্ষপাতী পৃথিবীর বৈষম্য আর বাস্তবতার এক কর্কশ হুংকার।

This is a Bangla article. It's a review of the book 'The Bluest Eye'.

Featured Image: investingbb.com

Related Articles