চলচ্চিত্র একটি শিল্প, সেটা তো চিরন্তন সত্য কথা। আর এই চলচ্চিত্রকে বিভিন্ন মাত্রায় পরিমাপ করে আবার অসংখ্য শাখায়, উপশাখায় বিভক্ত করা হয়ে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম একটি শাখা হলো অ্যানিমেটেড ফিল্ম। আজ অবধি নির্মিত সকল ভাষার অ্যানিমেটেড ফিল্মের ওপর গবেষণা চালালে দেখা যাবে যে, এদের মধ্যে বেশিরভাগ ফিল্মই রূপকথা অথবা কোনো একটি বিশেষ শিক্ষণীয় বার্তা দর্শকদের কানে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু আজ যে অ্যানিমেটেড ফিল্ম নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি , সেটি এই প্রচলিত ধারার উর্ধ্বে। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে, বলতে হয়, এটি শুধু বায়োগ্রাফিক্যাল অ্যানিমেটেড ফিল্মই নয়, এটি একটি আর্ট ফিল্মও বটে। তা-ও আবার, একজন আর্টিস্টের জীবনের গল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ফিল্ম।
গত বছর যে কয়টি অ্যানিমেটেড ফিল্ম মুক্তি পেয়েছে, তার মধ্যে ‘লাভিং ভিনসেন্ট‘ সিনেমাটি অন্যতম। বেশিরভাগ সিনেমাবোদ্ধা হয়তো গত বছরে ডিজনি ও পিক্সেলের যৌথ প্রযোজিত অ্যানিমেটেড ফিল্ম ‘কোকো’কে সেরার আসনে বসাবেন। দর্শকপ্রিয়তার দিক থেকে, পুরস্কার অর্জনের হিসাবে ও সিনে সমালোচকদের দৃষ্টিতে হয়তো ‘কোকো’ সিনেমাটি এগিয়ে আছে। কিন্তু ভিন্নধর্মী ও নতুনত্বের কথা চিন্তা করলে, ‘লাভিং ভিনসেন্ট’ সিনেমাটি শুধু অ্যানিমেশন দুনিয়াতেই নয়, পুরো চলচ্চিত্র জগতে এক বিপ্লবী আবির্ভাবের নাম।
‘লাভিং ভিনসেন্ট’ সিনেমাটি নিয়ে কথা বলার আগে এই সিনেমাটি যাকে ঘিরে চিত্রায়িত করা হয়েছে, সেই বিখ্যাত মানবের জীবন থেকে একটু ঘুরে আসা যাক।
সময়টা ৩০ মার্চ, ১৮৫৩ সাল। নেদারল্যান্ডের জুন্দার্ত নামক স্থানে ‘ভ্যান গগ’ পরিবারে ভিনসেন্ট নামক একজন বালকের জন্ম হয়েছিল। ছোটকাল থেকেই বালকটি ছিল শান্ত, চুপচাপ গোছের ও অত্যন্ত বাস্তববাদী। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া এই বালকটি দারুণ ভ্রমণ পিপাসু হলেও, বয়স বাড়ার সাথে সাথে কেমন যেন একটা হতাশা তার মধ্যে বসবাস করতে শুরু করলো।
প্রথমে আর্ট ডিলার, তারপর ধর্ম যাজক, এরপর আবার আর্টিস্ট হিসেবে পেশা জীবনকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। সারাক্ষণ মানসিক অস্থিরতা ও মতিভ্রমের শিকার হয়ে থাকা এই শিল্পী নিজের জীবনের শেষ দশক কঠোর অধ্যবসায় ও বিধাতা প্রদত্ত অসাধারণ মেধাশক্তি দ্বারা দারুণ কিছু অভূতপূর্ব শিল্পকর্ম উপহার দিয়ে গেছেন মানবসভ্যতাকে। মাত্র ৩৭ বছরের জীবনে এই শিল্পী প্রায় ২,১০০ চিত্রকর্মের সৃষ্টি করেছিলেন। তার মধ্যে ৮৬০ এর মতো তৈলচিত্র ও বাকিগুলোর মধ্যে জল রঙ, নকশা, অঙকন, চিত্র, মানবচিত্র ইত্যাদি ছিল।
ভিনসেন্টের অসংখ্য অসাধারণ সৃষ্টিকর্মের মধ্যে ‘সরো’, ‘দ্য পটেটো ইটার্স’, ‘সান ফ্লাওয়ার্স’, ‘দ্য স্ট্যারি নাইট’, ‘পোর্ট্রেট অব ড. গাচেট’, ‘বেডরুম ইন আর্লেস’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৮৯০ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মানসিক ও শারীরিকভাবে নানা জটিলতায় ভোগা এই গুণী শিল্পী আত্মহত্যা করেন। আর এভাবেই পৃথিবীর বুক থেকে সম্পূর্ণ রূপে পরিস্ফুটনের আগেই ঝরে পড়েছিল একজন বিস্ময়কর মানব। যদিওবা তিনি জীবিত থাকাকালে বেশ কিছু অদ্ভুত ও অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন এবং তার মৃত্যুর পেছনের গল্পটাও ঈষৎ রহস্যজনক।
‘লাভিং ভিনসেন্ট’ সিনেমাটি সম্পর্কে কথা বলতে হলে, আজ থেকে ঠিক চার-পাঁচ বছর আগে ফিরে যেতে হবে, যখন থেকে মূলত সিনেমাটির নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। সিনেমাটিকে যতই আমরা অ্যানিমেটেড ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্তই করি না কেন, এই সিনেমার নির্মাণকাজে কিন্তু কোনো অ্যানিমেটরের সরাসরি অংশগ্রহণ তো দূরের কথা, সামান্যতম ভূমিকাও ছিল না। কারণ এই সিনেমার পেছনে কাজ করেছিলেন পৃথিবীর বিশটি দেশ থেকে বাছাইকৃত ১২৫ জন চিত্রশিল্পী। আর তারা কিন্তু যেনতেন শিল্পী নন। কারণ প্রায় ১,০০০ শিল্পী এই প্রজেক্টে অংশগ্রহণের আগ্রহ দেখালে তাদের মধ্যে নানা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরেই চূড়ান্ত দলটি নির্বাচন করা হয়েছিল। সাধারণ সিনেমা নির্মাণে যতটা সময়, শ্রম ও মেধার প্রয়োগ করা থাকে, এই সিনেমার ক্ষেত্রে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বাকি কলাকুশলীদের অনেক গুণ বেশি দিতে হয়েছিল, কারণ সিনেমাটি জনসম্মুখে আসার আগে বেশ কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে এসেছিল।
সিনেমাটির নির্মাণশৈলীর শুরুটা হয়েছিল ডোরোটা কোবিয়েলা ও হিউ ওয়েলশম্যান নামক দুজন গুণী পরিচালকের নির্দেশনায় ডগলাস বুথ, জেরোম ফ্লিন, রবার্ট গুলাজিক প্রমুখ অভিনয়শিল্পীদের সবুজ পর্দায় আগমনের মধ্য দিয়ে। দুটি স্থির চিত্রকে পাশাপাশি জোড়া লাগিয়ে ভিডিও আকারে রূপান্তরিত করার নিমিত্তেই পরিচালকেরা সিনেমাতে সবুজ পর্দায় ব্যবহার করেছিলেন। চিত্রধারণের কাজ শেষ করার পর, ব্যাকগ্রাউন্ডে ভিনসেন্টের চিত্রশিল্পকে সংযোজন করার জন্য সেগুলোকে চিত্র সম্পাদকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেই ধাপ সম্পন্ন হবার পর নানা সামান্য কিছু কাটছাঁট করেচিত্রগুলোকে কাহিনীর সাথে সমন্বিত রেখে সংযুক্ত করে ভিডিও রূপ দেওয়া হয়। কিন্তু তখনো সিনেমার আসল আকর্ষণ ও পরীক্ষামূলক ধাপটির কাজ বাকি ছিল।
মনে আছে, সেই ১২৫ জন চিত্রশিল্পীর কথা যে বলেছিলাম? এই ধাপে তাদেরকে দিয়ে সিনেমার প্রতিটি ফ্রেমকে ফাঁকা ক্যানভাসের ওপর তৈলচিত্র রূপে আঁকিয়ে নেওয়া হয়। চিত্রশিল্পীরা ভিনসেন্টের অনুকরণে প্রায় ৬৫,০০০ ক্যানভাসের ওপর সিনেমার চিত্রনাট্যকে ফুটিয়ে তোলার পর, সেখান থেকে সেরা ১,০০০-কে সিনেমাতে ব্যবহারের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। আর অবশেষে, সেই এক হাজার ক্যানভাসকে পুনরায় একসাথে জুড়ে দিয়ে বানিয়ে ফেলা হয়েছিল ‘লাভিং ভিনসেন্ট’ নামক ব্যতিক্রমধর্মী এই সিনেমাটি। আর নির্মাতাদের এই বুদ্ধিদীপ্ত ও চ্যালেঞ্জিং প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে, দর্শক শুধু সিনেমার গল্পেই নয়, প্রতিটি ফ্রেমে, প্রতিটি দৃশ্যের অন্তরালে খুঁজে পাবে ভিনসেন্টের প্রতিচ্ছবি।
‘লাভিং ভিনসেন্ট’ এর প্লট অন্যান্য জীবন-বৃত্তান্ত এর ওপর গড়ে ওঠা সিনেমা থেকে বেশ আলাদা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো মানবের জীবন কাহিনীকে কেন্দ্র করে নির্মিত সিনেমাতে সেই মানবের বেঁচে থাকাকালীন সময়কে প্রাধান্য দেওয়া হলেও, এই সিনেমাতে ভিনসেন্টের মৃত্যু পরবর্তী কালকে মূল প্রেক্ষাপটে রাখা হয়েছে। সিনেমার শুরুটা করা হয়, ভিনসেন্টের মৃত্যুর প্রায় এক বছরের পরের সময় থেকে। সিনেমাটি ভিনসেন্টের জীবন নিয়ে হলেও, পর্দায় যিনি সিনেমার মূল চরিত্র হিসেবে থেকেছেন তিনি ভিনসেন্টের ডাকপিয়ন বন্ধু জোসেফ রাওলিনের পুত্র আরম্যান্ড রাওলিন। আরম্যান্ডের চরিত্রে তরুণ অভিনেতা ডগলাস বুথ অভিনয় করেছেন।
সিনেমাটির যাত্রা শুরু হয়, আরম্যান্ড তার বাবার কাছ থেকে একটি বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে সঁপে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। আর সেই দায়িত্বটি ছিল, ভিনসেন্টের লেখা সর্বশেষ চিঠিটি, সেটির প্রাপকের হাতে পৌঁছে দেওয়া। চিঠিটির প্রাপক ছিলেন ভিনসেন্টের ভাই থিওন ভ্যান গগ, যাকে ভিনসেন্ট সমগ্র দুনিয়াতে একমাত্র আপন ও ভরসাস্থল বলে গণ্য করতেন। আরম্যান্ডের মনে ভিনসেন্টকে নিয়ে নানা ক্ষোভ ও ঘৃণা কাজ করা সত্ত্বেও সে পিতার আদেশ পালন করতে বেরিয়ে পড়েছিল। আর তারপর শুরু হয় সিনেমার আসল ঘটনাপ্রবাহ। ভিনসেন্টের আত্মহত্যার পেছনের আসল কারণ, ভিনসেন্ট মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন ও ভিনসেন্টের জীবনের বাস্তবতা ও নানা গোপনীয় তথ্যকে আরম্যান্ডের হাত ধরে ও তার চোখ দিয়ে দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে সিনেমাটিতে। সিনেমাটি দেখার পর, খানিকক্ষণ চুপ থেকে, একান্তে প্রত্যেক দর্শকই ভাবতে বাধ্য হবেন, জীবনের মর্মার্থ, শুধু এটুকুই কথা দেয়া যায়।
‘লাভিং ভিনসেন্ট’ সিনেমাটির চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করেছিলেন ডোরোটা কোবিয়েলা, হিউ ওয়েলশম্যান ও জ্যাসেক ড্যাহনেল। ৯৫ মিনিট ব্যাপ্তিকালের এই সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফির কাজ করেন ট্রিস্টান অলিভার ও সংগীতায়োজনে ছিলেন ক্লিন্ট ম্যানসেল। ‘ব্রেক থ্রু প্রোডাকশন’ ও ‘ট্রেডমার্ক ফিল্মস’ প্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এই সিনেমাটি পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত সিনেমা হিসেবে মুক্তি পেয়েছিল। ইংরেজি ভাষার এই সিনেমার পেছনে প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয়েছিল ও বক্স অফিস থেকে সেটি প্রায় ২৮.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে সক্ষম হয়।
সব শ্রেণীর দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবার মতো সিনেমা হয়তো এটি নয়। তবে যাদের মনে আর্ট ফিল্মের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে ও যারা ভিনসেন্টের জীবন সম্পর্কে জানতে কৌতূহলী, তাদের জন্য এই সিনেমাটি একটি মাস্টারপিস বলা যায়। আর চিত্রশিল্পের প্রতি ঝোঁক অথবা চিত্রশিল্প অনুরাগী হলে তো, তাদের জন্য এটি দুর্লভ এক সৃষ্টিকার্য।
সিনে সমালোচকরা অবশ্য এই সিনেমার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তার প্রমাণ হিসেবে ‘রোটেন টমেটোস’ এর মতো সাইটে সমালোচকদের দেওয়া রেটিং পর্যবেক্ষণ করলেই পাওয়া যায়। নানা এওয়ার্ড শোতে ও ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রায় বাইশটির মতো পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন লাভ করেছে সিনেমাটি। তার মধ্যে ৯০ তম অস্কার ও ৭৫তম গোল্ডেন গ্লোবে ‘বেস্ট অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্ম’ এর শাখায় মনোনীত হওয়াটা ছিল সবথেকে সম্মানজনক। ৩০তম ইউরোপিয়ান ফিল্ম এওয়ার্ডে বেস্ট অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্মের পুরস্কার ও রাশিয়া থেকে বেস্ট ফরেইন ল্যাংগুয়েজ ফিল্ম হিসেবে ‘গোল্ডেন ঈগল এওয়ার্ড’ জয় লাভ করতে সার্থক হয় সিনেমাটি।
‘লাভিং ভিনসেন্ট’ সিনেমাটি শুধুই একটি সিনেমা নয়, বরং একে জীবন সম্পর্কে ও বেঁচে থাকার সার্থকতা সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা অর্জনের জন্য দারুণ একটি উদ্যোগ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। ভিনসেন্টের জীবনের গল্পের সত্যান্বেষণের মধ্য দিয়ে ও তার সৃষ্টি-রহস্যের ভেতর দিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে, তবে তাৎপর্য সহকারে অনেক কথা দর্শকদের কানে পৌঁছাতে চেয়েছেন যেন নির্মাতারা। এই সিনেমা যেকোনো সিনেমাপ্রেমীর হৃদয়কে ছুঁয়ে যাবে, যদি তিনি এটার ভাবার্থ উপলব্ধি করতে পারেন। চোখ ধাঁধানো সকল ক্যানভাসের সাথে গভীর এক তত্ত্বের সংমিশ্রণে সিনেমার নাম ‘লাভিং ভিনসেন্ট’।
একজন মানুষ জীবিত থাকতে সকলের ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের পাত্র থাকা সত্ত্বেও, কীভাবে তার কর্মের মাধ্যমে মৃত্যুর পরে কিংবদন্তী মানবে পরিণত হতে পারেন, তার জলজ্ব্যান্ত উদাহরণ ভিনসেন্ট ভ্যান গগ। কর্মের মাধ্যমে অমরত্বের অধিকারী হতে ও জগতের বুকে চিরন্তন হতে কজন মানুষই পারে? কিন্তু ভিনসেন্ট পেরেছিলেন। তিনি হাতেগোনা সেই সকল মহীয়ান মানবের দলে, যাদের কদর বিশ্ববাসী বুঝে উঠতে পেরেছিল তাদের রক্তে-মাংসে গড়া মানবদেহ মাটিয়ে মিশে যাবার পরে।
পরিশেষে, ভিনসেন্টের একটি বিখ্যাত উক্তির মধ্যদিয়ে ও সবাইকে সিনেমাটি একবার হলেও দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে রিভিউটির সমাপ্তি এখানেই টানছি।
“In the life of the painter, death may perhaps not be the most difficult thing. For myself, I declare I don’t know nothing about it.”
ফিচার ইমেজ: thefilmstage.com