ইয়ট ব্যবহারের ইতিহাস বহু পুরনো। ১৭ শতক থেকেই ব্রিটিশ এবং ডাচরা ইয়ট ব্যবহার করতো। তবে ব্যবহারটা তখন ছিল ভিন্ন উদ্দেশ্যে। ডাচ শব্দ ‘ইয়াট’ থেকে আজকের ইয়ট শব্দটির উৎপত্তি, যার অর্থ শিকার করা। ডাচরাই প্রথম একধরনের ছোট কিন্তু দ্রুতগামী জাহাজের নাম দেয় ইয়াট, যা তারা সমুদ্রে দস্যুদের ধরতে ব্যবহার করতো। সময়ের বিবর্তনে আজকের বিশ্বে ইয়টের সেই মধ্যযুগীয় ব্যবহারের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। এখন ইয়ট শব্দটি কানে গেলেই সবার পূর্বে যে ছবিটি মাথায় ভেসে ওঠে, তা হচ্ছে একটি অত্যন্ত সুন্দর, রাজকীয় এবং বিলাসবহুল জাহাজ, যেখানে অবসর যাপন করছে কিছু বিত্তশালী মানুষ।
ইয়ট বলতে এখন আমরা যা বুঝি, তা হচ্ছে প্রমোদতরী। বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ হাই-প্রোফাইল ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ, বিশেষ করে ব্যবসায়ী শ্রেণী নিজেদের অবসর যাপনের জন্য একটি ব্যক্তিগত ইয়ট রাখতে পছন্দ করেন। ঠিক যেমনি ডিসি কমিক্সের কাল্পনিক গোথাম শহরের ধনকুবের ব্রুস ওয়েইনও একটি ইয়ট ব্যবহার করতেন (ডার্ক নাইট মুভিতে)! যা-ই হোক, সময়ের সাথে ইয়টের সৌন্দর্য এবং ব্যবহার দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এর ব্যয়। ধনী ব্যক্তিরা যেন একে অপরের সাথে এক অঘোষিত প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, একে অপরের চেয়ে বড় এবং দামি ইয়ট নির্মাণে। সেই প্রতিযোগিতার ফসলই আজকের লেখার বিলাসবহুল ইয়টগুলো।
৫) আল সাইদ (৩০০ মিলিয়ন)
বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ইয়টের তালিকায় ৫ম স্থান দখল করে নিয়েছে ওমানের সুলতান কাবুস বিন সাইদ আল সাইদের নিজ নামে নামকরণ করা ইয়ট ‘আল সাইদ’। ২০০৬ সালে ৩০০ মিলিয়ন ডলার সম্ভাব্য আয় ধরে এর নির্মাণ কাজ শুরু করে লারসেন শিপইয়ার্ড। প্রাক্কলিত ব্যয়েই ২০০৮ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ৭০ জন অতিথি এবং ১৫০ জন ক্রু ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই ইয়টের দৈর্ঘ্য ১৫৫ মিটার, যা একে করেছে পঞ্চম বৃহত্তম ইয়ট। কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখবার কারণে এই ইয়ট সম্পর্কে এই খুচরো তথ্যগুলোর বাইরে আর কিছুই জানা যায় না।
৪) মোটর ইয়ট-এ (৩২৩ মিলিয়ন)
২০১৮ সালে ফোর্বসের শীর্ষ ধনী তালিকায় ৮৮তম স্থানে থাকা রাশিয়ান শিল্পপতি এবং ইউরোকেমের প্রধান শেয়ারহোল্ডার আন্দ্রে মেলনিশেনকোর ব্যক্তিগত ইয়ট মোটর ইয়ট-এ এই তালিকায় ৪র্থ স্থানে আছে। ২০০৬ সালে এই ইয়টের নির্মাণ কাজ শুরু হয়, যা ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে শেষ হয়। এর নির্মাণ ব্যয় ৩২৩ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি টাকায় সংখ্যাটা ‘মাত্র’ ২,৬০০ কোটি টাকা! স্বাভাবিকভাবেই বিলাসিতা এবং শৌখিনতায় কানায় কানায় পূর্ণ এই ৪০০ ফুট লম্বা ইয়টটি। একটি যুদ্ধজাহাজের স্মারকস্বরূপ তৈরী এই জাহাজের নকশা এবং নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে ‘ব্লম+ভস’ নামক একটি জার্মান জাহাজ নির্মাণকারী কোম্পানি।
মোটর-এ এর অভ্যন্তরে মোট ২৪ হাজার বর্গ ফুট জায়গা রয়েছে, যার মধ্যে ২,৫০০ বর্গ ফুট জায়গা জুড়ে আছে মেলনিশেনকোর প্রধান বেডরুমটি। সম্পূর্ণ মেঝেটাই বিলাসবহুল সুদৃশ্য কাঁচে তৈরি। মেলনিশেনকোর বেডরুম ছাড়াও ইয়টটিতে রয়েছে আরো ৬টি অতিথি স্যুট, যেগুলোতে ৩০ জন অতিথি থাকতে পারবেন। এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো অতিথি কক্ষের চলনশীল দেয়ালগুলো! অর্থাৎ দেয়ালগুলো প্রয়োজনে চলাচল করতে পারে এবং সেগুলোর বিন্যাস পরিবর্তন করে ৬টি স্যুট থেকে তৈরি করা যাবে ৪টি বড়সড় সভাকক্ষ! জাহাজের প্রতিটি আসবাব, খাবার টেবিল এমনকি কাচের বাসনপত্রাদিও উন্নতমানের ফরাসি ক্রিস্টালে তৈরি। ডেকের একপাশে রয়েছে একটি ৩০ ফুট লম্বা স্পিডবোট, অপর পাশে একটি হেলিপ্যাড। অতিথিদের বিনোদনের জন্য রয়েছে একটি সুদৃশ্য ডিসকো এবং তিনটি সুইমিংপুল, যার একটির পৃষ্ঠতল সম্পূর্ণ কাচের তৈরী।
৩) দুবাই (৪০০ মিলিয়ন)
ব্যয়বহুল প্রমোদতরীর তালিকা করা হচ্ছে, আর সে তালিকায় কোনো আরব আমিরাতের ধনকুবেরের তরীর নাম থাকবে না, তা কি হতে পারে? তালিকার তৃতীয় স্থানটি দখল করে আছে দুবাই নামক এই বিলাসবহুল ইয়ট, যার মালিক সংযুক্ত আরব আমিরাতের বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট শেইখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাখতুম। এই ইয়টটি প্রাথমিকভাবে ব্রুনাইয়ের যুবরাজ জেফরি বলকিয়াহর জন্য যৌথ অর্থায়নে নির্মাণ কাজ শুরু করেছিল ব্লম+ভস এবং লারসেন কোম্পানি। ১৬২ মিটার লম্বা এই প্রমোদতরীর মালিকানা পরে রশিদ আল মাখতুম কিনে নেন। এটি বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ইয়ট।
দুবাই ইয়টটির বিশেষত্ব হচ্ছে এর নজরকাড়া সব জ্যাকুজি (বিশেষ ধরনের শৌখিন বাথটাব) এবং সুইমিং পুল। ভেতরের সর্পিলাকার সিঁড়িগুলো সম্পূর্ণ পরিবর্তনশীল রঙিন কাঁচে তৈরি, যা এই ইয়টকে করেছে অনন্য। মেঝে থেকে শুরু করে দেয়াল, বেডরুম আর সিলিং সবই সাজানো হয়েছে হস্তনির্মিত মোজাইক দ্বারা, যা মন ভালো করে দেয়ার মতোই সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। সব মিলিয়ে ১১৫ জন অতিথি অনায়াসে থাকতে পারবেন এই ইয়টে, যাদের জন্য রয়েছে দুটি সুদৃশ্য বার। ডেকের উপর হেলিপ্যাডের কথা আর আলাদা করে না বললেও চলে। তবে যে ব্যাপারটি উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে এর ভেতরকার ডিজাইনারের কথা। দুবাই ইয়টটির ভেতরের ডিজাইন করেন স্বয়ং রশিদ আল মাখতুম।
২) আজম (৬৫০ মিলিয়ন)
সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট এবং আবু ধাবির আমির, খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ান হচ্ছেন তালিকার ২ নম্বর স্থানে জায়গা পাওয়া ইয়ট আজমের মালিক। ১৮০ মিটার লম্বা এই বিলাসবহুল ইয়টটি সমুদ্রে ভাসানো হয় ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে। এটি এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর বৃহত্তম ইয়ট। প্রধান প্রকৌশলী মুবারক সাদ এর নেতৃত্বে এবং লারসেন শিপইয়ার্ডের আওতায় ৬৫০ মিলিয়ন ডলার খরচে এই ইয়টটি নির্মাণ করতে সময় লাগে ৩ বছর। অগভীর জলে চলাচলের জন্য এতে ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ প্রকৌশল, যা এই তালিকার অন্য ইয়টগুলো থেকে আজমকে করছে অনন্য।
ফরাসি ডিজাইনার ক্রিস্টোফার লিওনির তৈরি নকশা এই ইয়টটিকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। ইয়টের ভেতরের কক্ষগুলো এবং করিডরগুলো এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যে অনেকের মতে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল ইয়ট! এর একটি অভিনব দিক হচ্ছে এর বৈঠকখানা এবং বারগুলো, যেগুলোর একটিতেও কোনো পিলার নেই! আর বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এর গতি। ঘন্টায় ৫৬ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম এই ইয়ট, যা শুনতে বেশ সাদামাটা মনে হয়। কিন্তু ভিরমি খেতে হবে, যখন জানবেন এই ইয়টের রয়েছে নিজস্ব মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং একটি সাবমেরিন! নিঃসন্দেহে একটি সাবমেরিনকে ৫৬ কিলোমিটার/ঘন্টা গতিতে বয়ে নেয়া কোনো ইয়টের জন্যই সহজ নয়।
১) ইকলিপ্স (৫০০ মিলিয়ন থেকে ১.৫ বিলিয়ন)
এই তালিকার ইয়টগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে পরিচিত নামটি হচ্ছে ‘ইকলিপ্স’। এর কারণটাও খুব স্বাভাবিক। এই ইয়টের মালিক যে রাশিয়ান ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচ। অন্য সকলের সাথে প্রতিযোগিতায় বেশ বড় ব্যবধানেই জিতেছেন এই ধনকুবের। তার ইয়টের নির্মাণ ব্যয়ের ধারেকাছেও নেই আর কেউ। ১৬৩ মিটার লম্বা এই ইয়টটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ইয়ট, যা মাত্র ১ মিটারের ব্যবধানে হারিয়েছে দুবাইকে। এই ইয়টটিও নির্মাণ করেছে নজরকাড়া সব ইয়ট নির্মাণে পারদর্শী জার্মান শিপইয়ার্ড ব্লম+ভস। এর নির্মাণ খরচ নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। কোনো কোনো সূত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলার দাবি করলেও, অধিকাংশ সূত্রের মতে ইকলিপ্সের নির্মাণ ব্যয় দেড় বিলিয়ন ডলার। খুব সম্ভবত, প্রাথমিক ব্যয় সংকলনের হিসাবটি ছিল ৫০০ মিলিয়ন ডলার, যা কিনা নির্মাণকালের ব্যয় বৃদ্ধি, নতুন ডিজাইন সংযোজন এবং মূল্যস্ফীতি মিলিয়ে ১.৫ বিলিয়নে ঠেকেছে।
যেকোনো বিলাসবহুল ইয়টে একটি হেলিপ্যাড থাকবে, এ আর এমন কী? কিন্তু ইকলিপ্সে রয়েছে দুটি হেলিপ্যাড, যেগুলোতে একসাথে মোট চারটি হেলিকপ্টার অবতরণ করতে পারে! তাছাড়া এতে রয়েছে দুটি সুদৃশ্য সুইমিং পুল এবং বিশাল একটি ডিস্কো হল। আজমের মতো এই ইয়টটিতেও সংযুক্ত আছে একটি ছোট সাবমেরিন। প্রতিরক্ষার জন্য রয়েছে মিসাইল ডিটেকশন পদ্ধতি এবং টর্পেডো। বেডরুমের জানালাগুলোও বুলেটপ্রুফ। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপারটি হচ্ছে, পুরো ইকলিপ্স সর্বদা একটি ‘অ্যান্টি-পাপারাজ্জি’ লেজার শিল্ডের আওতায় থাকে। পাপারাজ্জিদের গোপনে ছবি তোলার দিন বুঝি শেষ হয়ে এলো!
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই তালিকা থেকে প্রসিদ্ধ দুটি নাম, ‘দ্য হিস্ট্রি সুপ্রিম’ এবং ‘স্ট্রিটস অব মোনাকো’কে বাদ রাখা হয়েছে। প্রথমত, স্ট্রিট অব মোনাকো ইয়টটি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল ২০১৩ সালে। কিন্তু, অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী এবং ব্যয়বহুল এই ইয়টের নির্মাণ কাজের কোনোরূপ অগ্রগতিই এখনো পর্যন্ত হয়নি। অন্যদিকে, ১ লক্ষ কেজি স্বর্ণ ব্যবহার করে, অবিশ্বাস্য ৪.৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে তৈরি করা হিস্ট্রি সুপ্রিম ইয়টটি আসলে কোনোদিন তৈরিই করা হয়নি! এটি ছিল একটি নিছক ধাঁধা, যদিও এখনো ইন্টারনেটে অনেক তালিকায় একে এক নম্বরে রাখা হয়!
ফিচার ছবি: bianchimarine.com