Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নাটক ‘জননী’: একটি একলা চলার গল্প ও নামধারী জ্ঞানীদের মুখোশ উন্মোচনের আখ্যান

সমাজে তথাকথিত এমন বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যারা সদা জ্ঞানের কথা বলেন। কী করলে কী হয় কিংবা কী করা উচিত তা বলে বেড়ান মানুষদের কাছে। কিন্তু নিজে অলস বসে থাকেন সারাদিন। কাজের নামে দেখা নেই তাদের। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘নন্দলাল’ কবিতার নন্দলালের মতো শুধু কাজ করার চিন্তা করেন। কিন্তু কাজ আর করা হয় না।

এমন ধরনের লোকও রয়েছেন, যারা তাদের পরিবারের প্রতি থাকেন উদাসীন। অস্বচ্ছল এক পরিবারের কর্তা হয়ে ঘুরে-ফিরে বেড়ান নিজের মতো। দায়িত্ব থাকার পরেও হেলায় পরিবারকে কষ্টে রাখেন তিনি।

এক্ষেত্রে পরিবারের কর্তা হয়ে ওঠেন জননী। সংগ্রাম করে সংসারকে টিকিয়ে রাখেন সযতনে। একাই পুরো পরিবারকে টেনে নিয়ে গেছেন এমন জননীর কথাও আমরা শুনেছি।

এসকল ব্যাপার নিয়েই নাটক ‘জননী’। সুইস ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন কর্তৃক নিবেদিত, হুমায়ূন আহমেদের রচনা এবং নওয়াজীশ আলী খানের পরিচালনায় নাটক ‘জননী’। এতে অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর, ডলি জহুর, আবুল খায়ের, শাওন প্রমুখ।

নাটকের শুরুটা হয় গ্রামের চিরায়ত সবুজের দৃশ্য দিয়ে। গাছের ছায়াঘেরা এক গ্রাম। ছোট্ট মেয়ে মরিয়মকে দেখা যায় ছাগলকে সাবান মেখে গোসল করাচ্ছে। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন গ্রামের এক ধার্মিক লোক। মেয়েটির সাথে লোকটির কথোপকথনে জানা যায়, মেয়েটি জ্বরে ভুগছে। তার জন্য দোয়া করে ফুঁ দিলে মেয়েটি লোকটিকে জিজ্ঞাসা করে,

আমার ছাগলটারে একটা ফুঁ দিয়া যান।

কিন্তু লোকটি হাসির মাধ্যমে ব্যাপারটিকে হালকাভাবে নেন। পরে দেখা যায়, পানির কলের তেলেসমাতি দেখে তাজ্জব হয়ে যান তিনি। সেখানে মানুষের মস্তিষ্কের প্রশংসা করে দোয়া করেন। কিন্তু সেই ছাগলটির জন্য দোয়া করেননি কেন? প্রাণীরা কি সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি নয়? শুরু থেকেই তৈরি করা হয় এমন প্রশ্ন।  

ছাগলসোহাগী মেয়ে মরিয়ম; Image Source: Youtube

আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ এসব প্রাণীকে তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেন। তাদের নিয়ে মোটেও ভাবেন না। কিন্তু এমন লোকও আছেন, যারা প্রাণীদের অনেক বেশি ভালোবাসেন। আমাদের গল্পের মরিয়ম তাদেরই একজন।

মানুষের গালে চড় মারো সেটা ভিন্ন কথা। পশুর গালে চড় মারা ঠিক না। আল্লাহ পাক নারাজ হন।

আমরা পরিচিত হই গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের সাথে। যে পরিবারে তিন মেয়ে, স্বামী ও স্ত্রী একসাথে বসবাস করে। তাদের সাথে থাকে মরিয়মের বুড়ো দাদা। পরিবারের কর্তা বদরুলের পিতা। বদরুল সবসময় জ্ঞানের কথা বলেন। দুনিয়ার জটিল বাস্তবতার কথা বলেন। নীতিকথা শোনান তার স্ত্রীকে।

কিন্তু তার স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া শুনে ধরে নেয়া যায় তিনি বদরুলের এমন কথার জন্য খুবই হতাশ হচ্ছেন। কারণ বদরুল সারাদিন এমন জ্ঞানের কথাই বলে যান। শুনতে শুনতে বিরক্ত তিনি। কিন্তু এই রাগ শুধু জ্ঞানের কথা বলার জন্য নয়। স্বামী তার সংসারের প্রতি খুবই উদাসীন, যার চিত্র আমরা পরবর্তীতে দেখতে পাবো।

আমি তো একটা মানুষ। আমার খিদা, তৃষ্ণা আছে। আছে না?

মরিয়মের দাদা তার মনের ভেতরকার হাহাকারের কথা প্রকাশ করেন এই কথাগুলোর মাধ্যমে। এই পরিবারের জন্য তিনি একটা বড় বোঝা হয়ে আছেন। একটি দরিদ্র পরিবারে একজন বাড়তি অন্ননাশকারী লোক তিনি।

প্রাণীদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা থাকা উচিত; Image Source: Youtube

আমাদের দেশের নিম্নশ্রেণীর পরিবারে প্রায়শই এমন দৃশ্য দেখি আমরা। বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের অস্কারজয়ী সিনেমা ‘পথের পাঁচালি’-তে (১৯৫৫) এমন একজন চরিত্র রয়েছে। তিনিও অপুদের পরিবারের একটি বোঝা।

কিন্তু এই পরিবারের মা সেই বুড়ো লোকটির ভালোই যত্ন করেন। এদেশের মায়েরা পরিবারের সবকিছুই খেয়াল রাখেন। রাখতে হয়। চিরায়ত এক সত্য যেন এটি।

গৃহস্থালির সব কাজ পরিবারের মাকেই করতে হয়। বদরুল শুয়ে শুয়ে আরাম করেন। আর মাঝে মাঝে জ্ঞানের কথা বলেন। এই নারী পরিবারকে কীভাবে চালাচ্ছেন সেই চিন্তা নেই তার মনে। তার কাছে দুনিয়াটা একটা মায়া। যে যত তাড়াতাড়ি এই সত্যটা বুঝতে পারবে তার কাছে দুনিয়া তত মহাশান্তির জায়গা।

মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭২) সিনেমার একটি দৃশ্যে আমরা দেখি বৃষ্টিতে রাত জেগে কাটাতে হচ্ছে একটি পরিবারের। কারণ সারারাত বৃষ্টি হলে ঘরের চালের ফুটো দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে। সেই পানি পাত্রে জমাতে হয়। পাত্র ভরে গেলে আবার পানি ফেলে নতুন করে বসাতে হয়।

‘জননী’ নাটকে দেখা যায় মা এই কাজটি করছেন। তাদের ঘরেও একই অবস্থা। চাল চুইয়ে পানি পড়ে। বদরুলের এদিকে কোনো মন নেই। সে গানের আসর বসায়। বৃষ্টির তালে তালে নাচতে নাচতে গান গায় সে। উৎফুল্ল চিত্তে গাইতে থাকে। পরিবারের হাল তার মাথায় নেই।

এদিকে ক্লান্তি নেই মরিয়মের মায়ের। সারাদিন কাজ করার পর রাতেও কাজ করেন তিনি। সাথে খেয়াল রাখেন পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের। কিন্তু পরিবারের কর্তা যেন ভোগ করার জন্যই দুনিয়াতে এসেছেন। জননীর জমানো ডিম যখন তার মেয়েরা বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যায় তখন সেখান থেকেও ডিম ভোগ করতে বোধে আঘাত লাগে না তার। সে ডিম খাওয়ার সময় তার মেয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। কিন্তু নিজের মেয়ের খুশির চেয়েও নিজের ভোগ করাকেই প্রাধান্য দেয় সে।  

ভোগেই সুখ যে বাবার; Image Source: Youtube

সারাদিন জ্ঞানের কথা বলা লোকটি একটি অন্তঃসারশূন্য মনন নিয়ে বসে থাকে। তার ট্যাঁকে টান পড়লে চুরি করে মরিয়মের প্রিয় ছাগলটি। টাকা নিয়ে নিরুদ্দেশ হয় বদরুল। কিছুদিন পর পর এমন নিরুদ্দেশ হবার অভ্যাস রয়েছে তার।

গ্রামে তখন প্রায় আকালের মতো অবস্থা। জমিতে ফসল ফলানোর মতো পানি পাচ্ছে না গ্রামবাসী। লোহার মতো শক্ত হয়ে আছে মাটি। এমতাবস্থায় মরিয়মের মায়ের কাছে প্রস্তাব আসে জমি বিক্রি করে দেয়ার। অনেকেই জমি বিক্রি করে শহরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু মরিয়মের মা জমি বিক্রির প্রস্তাব নাকচ করে দেন।

মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’ (১৯৮০) সিনেমার একটি দৃশ্যে আমরা ঠিক এমনটিই দেখি। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়েও জমি বিক্রি করেনা না খেয়ে থাকা একটি পরিবার। জমির প্রতি গ্রামের মানুষের এই টান যেন আজীবনের। জমি তাদের এক কষ্টের ধন। আপন সন্তানের মতো আগলে রাখে তাকে।  

অভারের তাড়নায় এবং জমিতে ফসল ফলাতে না পেরে জমি বিক্রি করে শহরে পাড়ি জমায় তাদের প্রতিবেশী জলিল। এ যেন গ্রামের এক দরিদ্র কৃষকের প্রতিচ্ছবি। মানুষের সেবায় ব্রত হয়ে কাজ করা এ কৃষকেরা তাদের জমিতে আমাদের জন্য চাষ করার সময় পানি পান না। কখনও ফসলের জমিতে কষ্ট করে দূর থেকে কলস ভরে পানি এনে দেন জমিতে। কিন্তু আমরা তাদেরকে মানুষ হিসেবেই গণ্য করতে দ্বিধাবোধ করি।

ট্যাঁকে টান পড়ার পর ঠিকই ফিরে আসে বদরুল। এবার তাকে মনের ইচ্ছার কথা জানায় মরিয়মের মা। তাদের পরিবারকে টেনে তোলার জন্য সাহায্য চায় বদরুলের কাছে। তার স্বামীকে বলে,

আপনি একটু সংসারটা দেখবেন। আমি একলা পারতাছি না। আপনি যদি আমারে সাহায্য করেন আমি অবস্থা ফিরাইয়া ফালাবো।

তার স্বপ্ন তখন চোখেমুখে। সমাজে ভালোভাবে টিকে থাকার স্বপ্ন। কিন্তু স্বামী বদরুলের মনে তখন মরিয়মের মায়ের জমানো টাকার চিন্তা। এমনকি মরিয়ম অসুস্থ থাকার পরেও তার নজর নেই সেদিকে। টাকা চুরি করার জন্য খুঁজতে গিয়ে মেয়ের কাছে ধরা পড়ে সে। ধরা পড়ে মরিয়মের মায়ের হাতে। তখন রাগ দেখিয়ে নিজেই আবার ঘরছাড়া হয় কাপুরুষ বদরুল।

সংগ্রাম করা এক জননী; Image Source: youtube

এতসব সংগ্রাম একাই সামাল দেয় মরিয়মের মা। জগতের এই জননীর মুখের কয়েকটি শব্দেই যেন তার লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তার মেয়েকে তিনি বলছেন,

রাইতের পর দিন আসে। আমরারও দিন আসব। একদিন একটা পানির কল কিনব। জমির পানির কষ্ট দূর অইবো। সোনার ফসল ফলবো। আরও জমি কিনব। তোমরা স্কুলে যাইবা।

এদিকে মরিয়মের অসুস্থতা বাড়তেই থাকে। গ্রামের মাওলানার কাছে পানি পড়া নিয়ে আসতে গেলে তিনি চিকিৎসকের কাছে যেতে বলেন। চিকিৎসকদের কাছে যাওয়ার একটি সহীহ হাদিস শোনান তিনি। এর সাথে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলেন। আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আজও ধর্মীয় কুসংস্কার টিকে আছে। অসুখ হলে পানিপড়ার উপর ভরসা করা হয়। এই দৃশ্য যেন তা থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান।

অনেক চেষ্টার পরেও বাঁচানো যায় না মরিয়মকে। মৃত্যুর আগে মরিয়মের চিন্তায় থাকে মায়ের পানির কল কেনার কথা। কিন্তু মা টাকা দিয়েও তার মেয়েকে বাঁচাতে পারেন না।

এভাবে একের পর এক আঘাত এসে আক্রমণ করে জননীকে। সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যায়। তার সুদিনের পথ আরও কন্টাকাকীর্ণ হয়। কিন্তু পিছপা হয় না সে। একাই পুরো পথ পাড়ি দেয় সে। পানির কল কেনে একদিন। হাসি ফোটে বৃদ্ধ দাদার মুখে। হাসি ফোটে সবার মুখে।

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে

জননী মায়ের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন ডলি জহুর। তার মুখের অভিব্যক্তি ছিলো উল্লেখ করার মতো। উদাসী বাবা বদরুলের চরিত্রে ভাল মানিয়েছে আসাদুজ্জামান নূরকে। তিনি যে একজন জাত অভিনেতা তা আরেকবার প্রমাণ করেছেন। শিশুশিল্পীর চরিত্রে শাওন কোনো অংশেই কম যান না তাদের থেকে। তিনি অভিনয় করে সকলকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, একজন শাওন আসছে।

This article is about bangla drama 'Jononi'. this Drama is directed by Nouyajish Ali Khan and Written by Humayun Ahmed.

Feature Image Source: Youtube

 

Related Articles