Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বোয়ানথ্রপি: নিজেকে গরু মনে হয় যে রোগে

-সামান্য একটা ম্যাথ করতে পারিস না! তুই একটা গরু।

-গাধার মতো কথা বলবি না সব সময়!

-তুই একটা ছাগল।

-তোর মতো বলদ আমি জীবনেও দেখি নাই!

চারপেয়ে গরুর সাথে মানুষের তুলনা করা হয় অহরহ; Source: youtube.com

নিজেদের পরিবারের কাছ থেকে বা বন্ধুদের কাছ থেকে বা শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছ থেকে এরকম চারপেয়ে নিরীহ গৃহপালিত পশুর সাথে নিজের তুলনা শুনে হয়তো সকলেই অভ্যস্ত। যদি বলেন আপনি এমনটা কখনোই শুনেন নি, তাহলে বলব আপনি এক দুর্লভ শ্রেণির মানুষ। সে যা-ই হোক, যারা প্রতিনিয়ত শুনে থাকেন বা মাঝেমাঝেই শোনেন, তারা যদি নিজেদেরকে সত্যি সত্যি গরু-ছাগল বা গাধা ভাবতে শুরু করেন তাহলে? মনে হতেই পারে এসব পাগলের প্রলাপ, কিন্তু একেবারেই তা নয়। বিরল এক মানসিক ব্যাধি রয়েছে যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে গরু বা ষাঁড় ভাবতে শুরু করে! এই মানসিক ব্যাধির নাম ‘বোয়ানথ্রপি’।

বোয়ানথ্রপিতে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে গরু মনে করে; কৃতজ্ঞতাঃ খায়রুন নিসা

বোয়ানথ্রপি কী?

বোয়ানথ্রপি হলো এমন এক ধরনের মানসিক রোগ যাতে আক্রান্ত হলে ব্যক্তি একাগ্রচিত্তে বিশ্বাস করে সে একটা গরু। তবে শুধু বিশ্বাস করাই নয়, বরং তার আচার, ব্যবহার ইত্যাদিও সেরকমই হয়ে যায়। গরু কী কী করে তা ভাবার আগে ‘বোয়ানথ্রপি’ শব্দটি কোথা থেকে এলো তা জেনে নেয়া যাক। ল্যাটিন শব্দ Bo (গবাদি পশু) এবং গ্রিক শব্দ Anthropy (মানুষ) থেকে ইংরেজি Boanthropy শব্দের উৎপত্তি। এর শাব্দিক অর্থ দাঁড়ায় ‘গবাদি পশুর ন্যায় মানুষ’।

কীভাবে বুঝবেন আপনার বোয়ানথ্রপি হয়েছে?

এবার আসা যাক গরু আসলে ঠিক কী কী করে সেদিকে। গরু ঘাস খায়, শিং দিয়ে গুঁতোয়, গোয়াল ঘরে থাকে মাঠে চরে বেড়ায় ইত্যাদি। একজন বোয়ানথ্রপি রোগীও এরকম আচরণই করে থাকে। যেমনঃ

-ভাত-মাছ-মাংস খাওয়া বাদ দিয়ে ঘাস চিবানো শুরু করবে।

-বিছানা বাদ দিয়ে মাটিতে ঘুমাবে।

-হাত দুটিকে পা ভাববে এবং গরুর মতো হাঁটার চেষ্টায় হামাগুড়ি স্টাইলে হাঁটবে।

-কথা বলা কমিয়ে দেবে বা একেবারেই বলবে না। তবে হাম্বা-হাম্বা করতেই পারে!

-নখ কাটবে না।

-ঘরের বাইরে; যেমনঃ মাঠে-ঘাটে থাকতে পছন্দ করবে।

বোয়ানথ্রপিতে আক্রান্ত ব্যক্তি ঘাস খাওয়া শুরু করবে; Source: theinfoscience.com

মোট কথা, শুরু হবে তৃণভোজী হবার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বাকি বৈশিষ্ট্যগুলো তার আচরণে প্রস্ফুটিত হবে।

কাদের হয় এমনটা?

মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা যে কারোই হতে পারে, তেমনি বোয়ানথ্রপিও যে কারোই যে কোনো বয়সে হতে পারে। তবে বলা হয় বোয়ানথ্রপিতে আক্রান্তদের বেশিভাগই পুরুষ!

কেন হয়?

যেহেতু বোয়ানথ্রপি বিরল একটি মানসিক রোগ, সেহেতু এটি নিয়ে গবেষণাও খুবই কম। কেস স্টাডি থেকে যে কারণগুলো পাওয়া যায় সেগুলো হলো:

-জীবনে প্রবল হতাশা (Severe Depression)
-উৎকণ্ঠা (Anxiety)
-স্ট্রেস (Stress)

জীবনে এগুলোর পরিমাণ খুব বেড়ে গেলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই অসুখী হয়ে পড়ে। মুক্তি পেতে চায় এই দুঃসহ অবস্থা থেকে। এক্ষেত্রে নিজের চরিত্র বদলে নতুন রূপ দিতে নিরীহ প্রাণী গরুর মতো আচরণ করতে পারে। অর্থাৎ চরিত্র বদলের মাধ্যমে কষ্ট থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা।

এছাড়াও আরো কিছু আনুষঙ্গিক কারণ থাকতে পারে, যেমন-

অন্যের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত খারাপ মন্তব্য যেমন “তুই একটা গরু”, “তুই একটা বলদ” ইত্যাদি শুনতে শুনতে এক সময় নিজের ভেতরেই এ বিশ্বাস চলে আসতে পারে যে, সে আসলেই গরু এবং তার পরপরই আচরণে পরিবর্তন দেখা যেতে পারে।

ছোটবেলায় সকলেই নানা কল্পকাহিনী শুনে থাকবেন। তার ভেতর ‘টোটেম’ এর কথা শুনেছেন কী? না শুনে থাকলে একটু জেনে নেয়া যাক। টোটেম হলো কোনো বস্তু বা প্রাণী বা গাছ, যা কোনো পরিবার বা গোষ্ঠী বা কোনো পূর্বপুরুষের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এমন হতে পারে অনেকেই এই টোটেমের গল্প বা ইতিহাস শুনতে শুনতে নিজেকেই টোটেম ভাবা শুরু করলো। ব্যাপারটা অনেকটা এমন – পূর্বপুরুষ গরু বা ষাঁড় ছিল এবং আমিও আমার পূর্বপুরুষের ন্যায় হয়ে যাচ্ছি।

আসলে নিজের অবস্থান থেকে পলায়নের চেষ্টাই হলো বোয়ানথ্রপির প্রধান কারণ।

আদৌ কি কারো হয়?

নিজেকে নিজে গরু ভাবার মতো মানুষ আসলেই আছে কিনা এমন ভাবনা মনে আসাটা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। আগেই বলা হয়েছে এটি একটি বিরল মানসিক রোগ, তাই অন্যান্য মানসিক রোগগুলোর মতো হরহামেশা শোনা যাবে না সেটাই স্বাভাবিক। সংখ্যাগরিষ্ঠ রোগী না থাকলেও বোয়ানথ্রপির দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখানো যায় এমন কেস নিশ্চয়ই রয়েছে।

কেস- ১

রাজা নেবুচাঁদনেজার প্রতিকৃতি; Source: onedio.com

ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান সম্পর্কে কম-বেশি সকলেই জেনে থাকবেন। তবে এর নির্মাতা সম্পর্কে কতটুকু জানেন সবাই? খ্রিষ্টপূর্ব ৬০৫ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬২ পর্যন্ত ব্যাবিলনের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় নেবুচাঁদনেজার। দিগ্বিজয়ী এই রাজা জুদাহ এবং জেরুজালেম জয় করে ইহুদিদের নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানও তারই নির্মাণ। তার অহংকারের মাত্রাও ছিল অনেক বেশি। বাইবেলে কথিত আছে- তার এই অহংকার, তার এই ক্ষমতার দম্ভের জন্য ঈশ্বরের অভিশাপে মানুষ থেকে ষাঁড়ে রূপান্তরিত হয়েছিলেন তিনি। বাহ্যিক গঠনের পরিবর্তন না হয়ে আচার-আচরণ, মানসিক অবস্থা সবকিছুই সেরকম হয়ে যায়। প্রায় ৭ বছর তিনি এভাবেই দিনাতিপাত করেছিলেন।

রাজা নেবুচাদনেজার; Source: twitter.com

নেবুচাঁদনেজারের রোগের সকল লক্ষণই বোয়ানথ্রপির অন্তর্ভুক্ত। তবে আরো কিছু ব্যাখ্যাও দেয়া যেতে পারে। যেমন- তার ‘পোরফাইরা’ হতে পারে যেটি শরীরে এনজাইমের একপ্রকার সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে রোগী হ্যালুসিনেশন, উদ্বিগ্নতা, হতাশা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। আবার অন্য ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সিফিলিসে আক্রান্ত হয়ে তার প্যারালাইটিক ডিমেনশিয়াও হয়ে থাকতে পারে। তবে বেশিরভাগ মানুষের মতে, ঈশ্বরের অলৌকিক অভিশাপের ব্যাখ্যা হয় না।

কেস- ২

পারস্যে বুয়াইদ রাজপুত্র মজিদ-আল-দৌলা ছোট বয়সে একবার ভাবতে শুরু করেন যে তিনি গরু হয়ে গিয়েছেন। গরুর মতো ডাকার পাশাপাশি তিনি বলতে থাকেন তাকে যেন জবাই করা হয় গরুর মতো এবং সেই মাংস খাওয়া হয়। তার এই অবস্থা থেকে তাকে সুস্থ স্বাভাবিক করে আনেন ইবনে সিনা।

ইবনে-সিনা; Source: thefamouspeople.com

এরকম আরো কোনো রোগ আছে কি?

মানুষ পশুতে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে এমন মানসিক পরিস্থিতিগুলোকে ‘থেরিয়ানথ্রপি’ বলা হয়। বোয়ানথ্রপিও এর অন্তর্ভুক্ত। আরো কয়েকটি এধরনের মানসিক অবস্থার কথা শোনা যায়। যেমন-

লাইকেনথ্রপি

আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে নেকড়ে ভাবতে থাকে।

লাইকেনথ্রপি; Source: fanpop.com

সাইন্যানথ্রপি

মানুষ যখন নিজেকে কুকুর ভাবতে থাকে। প্রাচীন গ্রিসে এ রোগের কথা শোনা যেত।

এর চিকিৎসা কী?

উদ্বিগ্নতা এবং হতাশা এ রোগের প্রধান কারণ বলে ধারণা করা হয়। তাই কাউন্সেলিং এবং স্পিচ থেরাপি এক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হতে পারে। তবে এর চেয়েও কার্যকরী থেরাপি দরকার হতে পারে যা এখনো অজানাই রয়ে গেছে। যেহেতু খুবই নগণ্য সংখ্যক মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয় তাই কোনো মনোবিজ্ঞানী-ই তাদের সময় এর পেছনে ব্যয় করতে চান না। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে মনোবিজ্ঞানীরা এ রোগের উত্তম চিকিৎসা খুঁজে বের করবেন সে আশা করাই যায়।

কিছু কথা না বললেই নয়

বোয়ানথ্রপি সম্পর্কে শুনে অনেকেরই মনে হতে পারে এটি স্কিজোফ্রেনিয়া, কেননা গরু হয়ে যাচ্ছে এই বিষয়টাকে হ্যালুসিনেশন হিসেবেই নিতে পারেন। তবে বোয়ানথ্রপি এবং স্কিজোফ্রেনিয়া এক নয়। স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির চিন্তায় অসামঞ্জস্যতা, কথাবার্তায় অসামঞ্জস্যতা এবং কিছু দেখতে পাচ্ছে এ ধরনের হ্যালুসিনেশন দেখা যায়। কিন্তু বোয়ানথ্রপিতে আক্রান্ত ব্যক্তির চিন্তায় অসামঞ্জস্য দেখা যায় না, বরং একটা নির্দিষ্ট দিকে চিন্তা স্থির থাকে। এছাড়াও স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মতো হ্যালুসিনেশনও বোয়ানথ্রপি আক্রান্ত ব্যক্তিদের হয় না। তাই স্কিজোফ্রেনিয়া এবং বোয়ানথ্রপিকে একই কাতারে ফেলাটা ঠিক হবে না।

ফিচার ইমেজ: সুপ্তি হাওলাদার

Related Articles