জুলাই ২০১১, এক সন্ধ্যায় ব্রাজিল সহ সারা বিশ্বের লাখো ফুটবলপ্রেমীর চোখ সান্তোসের ভিলা বেলমিরো স্টেডিয়ামে। এই মাঠেই সেদিন দু’বার বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের খেতাব পাওয়া রোনালদিনহোর মুখোমুখি হবে নেইমার নামের ১৯ বছর বয়সী হ্যাংলা পাতলা এক ছেলে। সেই ম্যাচে নেইমারের পারফর্মেন্স ছিলো চোখে লাগার মতো। পুরো ম্যাচ জুড়েই ছেলেটি ছিলো জীবন্ত। এক পর্যায়ে নেইমার তার মুভমেন্ট এবং ড্রিবলিংয়ের মাধ্যমে একাই ৬ জন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। ঘটনাটি এতই দ্রুত ঘটেছিলো যে, ধীর গতির ভিডিও ছাড়া কী ঘটেছিলো সেটি বোঝাই কষ্টসাধ্য। সে ম্যাচের পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি নেইমারকে। ফুটবল বিশ্বে আবির্ভাব ঘটলো নতুন এক তারকার। নেইমারের নামডাক এতটাই ছড়িয়ে পরে যে, ইউরোপের বাঘা বাঘা ক্লাবগুলো তার পিছনে ছোটা শুরু করে সাইন করানোর জন্য।
অবশ্য নেইমারের প্রতিভার খোঁজ ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ পেয়েছিলো আরো বছর পাঁচেক আগেই। আরেক সান্তোস তারকা রবিনহোকে অল্প বয়সেই ৩০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে রিয়াল মাদ্রিদে পাঠিয়েছিলো ওয়েংগার রিভেরো। রবিনহোকে মাদ্রিদে পাঠানোর এক বছর পর ১৪ বছর বয়সী নেইমারকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ দেখাতে নিয়ে যায় তার সেই ওয়েঙ্গার রিভেরো। নেইমার যেহেতু তখনো কোনো ক্লাবের সাথে পেশাদারী চুক্তি সই করেনি, তাই তার ইউথ ক্লাব সান্তোসের ভয় ছিলো, রিয়াল মাদ্রিদ নেইমারকে সাইন করে ফেলবে। সে ভয় থেকে সান্তোসের কর্মকর্তারা খেলাধুলা বিষয়ক আইনজীবী মার্কস মোত্তার সাথে যোগাযোগ করে এবং রিয়াল মাদ্রিদকে জানায় যে, তারা যদি নেইমারকে সাইন করানোর চেষ্টা করে, তাহলে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার কাছে তারা অভিযোগ করবে। মোত্তার ভাষ্যমতে- “আমি মাদ্রিদকে বলেছিলাম, দেখুন, নেইমার এখনো অপ্রাপ্তবয়স্ক। আমরা ফিফার সাথে যোগাযোগ করেছি এবং ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশনের সাথেও যোগাযোগ করেছি।” রিয়াল মাদ্রিদ জানায়, নেইমার সেখানে শুধু ঘুরতে গিয়েছে। এরপরেই নেইমার সান্তোসের সাথে তার প্রথম পেশাদারী চুক্তি সাক্ষর করেন।
নেইমারকে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলো যত বেতন অফার করছিলো, সান্তোসের পক্ষে তত বেতন দেয়া সম্ভব ছিলো না। তাই নেইমারের চুক্তি নবায়নের সময় তার এজেন্ট সান্তোসের সাথে সমঝোতা করতে সক্ষম হয় এই মর্মে যে, ভবিষ্যতে কোনো ক্লাবে নেইমারকে বিক্রি করা হলে ট্রান্সফার ফি এর ৪০% পাবে নেইমার নিজেই। তরুণ খেলোয়াড়দেরকে আরো এক-দুই মৌসুম ধরে রাখার জন্য ব্রাজিলের ক্লাবগুলোতে এটি খুবই প্রচলিত একটি পন্থা। কিন্তু ফিফার নিয়ম অনুসারে, একজন খেলোয়াড় ১৫% এর বেশি তার নিজের মালিকানার অংশীদার হতে পারবে না। এই সমস্যার সমাধানের জন্য সান্তোস নেইমারের বাবাকে জানায়, ট্রান্সফার হওয়ার আগেই তারা একজনকে ম্যানেজ করেছে, যে নেইমারের সেই ৪০% অংশীদারিত্ব কিনতে ইচ্ছুক। লোকটি ছিলো চেইন সুপারমার্কেটের মালিক ডেলকির সোন্দা। নেইমারের বাবা তাদের অংশীদারিত্বের মূল্য নির্ধারণ করে ১.৮ মিলিয়ন ইউরো। কিন্তু সোন্দা আরো ৫ লাখ ডলার বেশি দিতে রাজি হয়। এভাবেই নেইমার ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই মিলিনিয়ারের খাতায় নিজের নাম লিখে ফেলে।
পরদিনই সান্তোসের হয়ে প্রথম পেশাদারি ম্যাচ খেলতে নামে নেইমার। খেলার ৭০ মিনিটে বদলি হিসেবে মাঠে প্রবেশের মাধ্যমেই অভিষেক হয় নেইমার জুনিয়রের। মাঠে নামার সময়েই দর্শকরা “নেইমার, নেইমার” বলে স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে তোলে। নেইমারের অভিষেক ম্যাচ নিয়ে পরদিন পত্রিকায় খবর হয় ‘The boy set fire to the game’ এই শিরোনামে।
প্রথম মৌসুমে সান্তোসের হয়ে ১০ গোল করেন নেইমার এবং দ্বিতীয় সিজনে করেন আরো ১৭ গোল। ততদিনে নেইমারের ট্রান্সফার স্বত্ব কেনার জন্য আরো অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করে। সান্তোসের কিছু ধনী ফ্যান মিলে নেইমারের ভবিষ্যৎ ট্রান্সফার সত্ত্বের ৫% কিনে নেয়। অন্যদিকে সুপারমার্কেটের মালিক সোন্দা এবং তার উপদেশদাতারা নেইমারের বাবার সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখে। তাদের ইচ্ছে ছিল, নেইমারকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভালো দামে ইউরোপে পাঠিয়ে বড় অংকের টাকা মুনাফা করা। নেইমারের এজেন্ট এবং তার বাবার ইউরোপ গমন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সোন্দার একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানা যায়, চেলসির মালিক আব্রামোভিচের সাথে নেইমারের বাবার লন্ডনে একটি সাক্ষাত হয়েছিলো।
২০১০ সালের আগস্টে আমেরিকার বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচে ব্রাজিলের হয়ে অভিষেক হয় নেইমারের। ঠিক সেদিনই চেলসির কর্মকর্তা, নেইমারের বাবা, এজেন্ট ওয়েংগার রিভেরো, ট্রান্সফার ব্রোকার জাহাভি এবং নতুন নির্বাচিত সান্তোস প্রেসিডেন্ট অলিভিয়েরা রিভেরো নিউইয়র্কের হিল্টন হোটেলে মিলিত হন। চেলসির দেয়া ৩৫ মিলিয়ন ইউরোর অফার খুব দ্রুতই বাতিল করে দেন সান্তোসের প্রেসিডেন্ট। উপরন্তু নেইমারকে যতদিন সম্ভব ধরে রাখার জন্য তিনি ব্রাজিলে ফোন করে সান্তোসের কর্মকর্তাদের আদেশ দেন নেইমারের জন্য বিশেষভাবে কিছু পরিকল্পনা করার। এই পরিকল্পনার আওতায় ছিলো নেইমারকে ইংরেজি এবং স্প্যানিশ ভাষা শেখানো, শারীরিকভাবে প্রস্তুত করার জন্য প্রশিক্ষক নিয়োগ এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনার একটি দল নিয়োগ করা, যারা টাকা পয়সার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করবে।
১৯৬৩ সালে পেলের পর ২০১১ সালে নেইমার সান্তোসকে দক্ষিণ আমেরিকার ক্লাব প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ মর্যাদার আসর কোপা লিভারতেদোরেসের ফাইনালে নিয়ে যান। এই প্রতিযোগিতায় মোট ৬টি গোল করেন নেইমার। লিভারতাদোরেসের দুই লেগের ফাইনালে প্রথম লেগ গোলশূন্য ড্র হলে ২য় লেগে নেইমারের লিড নেয়া গোলে ২-১ এ জিতে যায় সান্তোস। সেই ম্যাচে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন নেইমার।
মাঠে ভালো পারফর্ম করার কারণে সান্তোসের সাথে দর কষাকষিতে বেশ ভালো অবস্থানে চলে আসেন নেইমারের বাবা। তারপরই ঘটে সেই আশ্চর্য ঘটনা, সান্তোসের সাথে নেইমারের বাবা একটি চুক্তি করেন। চুক্তি অনুসারে, সান্তোসের সাথে তখন নেইমারের চার বছরের চুক্তি অবশিষ্ট থাকলেও ক্লাবের অনুমতি ছাড়া নেইমারের বাবা অন্য ক্লাবের সাথে ট্রান্সফারের ব্যাপারে কথা বলতে পারবেন। জানা যায়, সে সময়ে নেইমারের বাবা বায়ার্ন মিউনিখ, রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনার সাথে কথা বলেছিলেন।
অল্প কয়দিনেই অনেক জনপ্রিয় হওয়ায় নাইকি, রেড বুল এবং প্যানাসোনিক সহ অনেক বড় বড় কোম্পানি নেইমারের সাথে স্পন্সরশিপ চুক্তি করে। নেইমার, তার বাবা এবং এজেন্টের পরিকল্পনা ছিলো, ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত সান্তোসে থাকা এবং ইউরোপে পাড়ি দেয়ার আগে বিশ্বকাপকে ব্যবহার করে এই স্পন্সরশিপের ফায়দা উঠানো। রিয়াল মাদ্রিদ নেইমারের স্পন্সরশিপ টানার ক্ষমতার ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছিলো। যুগে যুগে রিয়াল বেকহামদের মতো মার্কেটিং বান্ধব খেলোয়াড়দের দলে ভেড়াতো; কারণ রিয়াল মাদ্রিদের পলিসি অনুসারে এসব স্পন্সরশিপের ৫০% পেতো খেলোয়াড় আর বাকি ৫০% পেতো ক্লাব।
২০১১ সালে রিয়ালের জেনারেল ডিরেক্টর হোসে এঞ্জেল সাঞ্চেজ সোন্দার আইনজীবীর সাথে মাদ্রিদে একটি বৈঠকে মিলিত হন। রিয়াল ৪৫ মিলিয়ন ইউরোর একটি দর হাঁকে, কিন্তু সেটিও বাতিল হয়। তারপর রিয়ালের প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ অন্যভাবে চেষ্টা করেন নেইমারকে সাইন করানোর। সান্তোসের প্রেসিডেন্ট লুইস আলভারো তার সন্তানদের নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন ফ্রান্সে। পেরেজ তাকে ফোন করে প্রাইভেট প্লেনে রিয়ালে আসার প্রস্তাব দেন, কিন্তু লুইস সেটি প্রত্যাখ্যান করে পেরেজকে বিমানে তেল খরচ করতে মানা করেন। পেরেজ সেখানেই থেমে থাকেননি, লুইস আসতে রাজি না হওয়ায় পেরেজ নিজেই প্লেন নিয়ে চলে যান ফ্রান্সে এবং সেখানকার একটি রেস্টুরেন্টে দেখা করেন লুইসের সাথে। কিন্তু তারপরও নেইমার বিক্রির জন্য নয় বলে জানিয়ে দেন।
অন্যদিকে, প্রথমবার নেইমারকে সাইন করাতে ব্যর্থ হলেও হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন না চেলসির মালিক আব্রামোভিচ। চেলসির ডিরেক্টর অফ ফুটবল মিশেল ইমিনালো আবারো চেষ্টার জন্য লন্ডন থেকে সান্তোসে উড়ে যান। মোত্তার মতে, নেইমারের বাবাকে দেয়া ইমিনালোর ‘সেলস স্পিচ’টা ছিলো তার জীবনে শোনা শ্রেষ্ঠ স্পিচ। মোত্তা আরো জানান, এই প্রথম নেইমারের বাবা কারো কথা মনোযোগ দিয়ে ৩০ মিনিট শোনেন ফোনের দিকে না তাকিয়ে। চেলসির ডিরেক্টর নেইমারের বাবাকে মাইকেল জর্ডান এবং শিকাগো বুলসের কাহিনী শোনান, কীভাবে মাইকেল জর্ডান শিকাগো বুলসকে বড় টিম বানান এবং ইন্টারন্যাশনাল আইকন হিসেবে তৈরি করেন। নেইমার হবেন চেলসির মাইকেল জর্ডান, এমনটাই বলেছিলেন ইমিনালো।
বড় বড় ক্লাবগুলোর এত আগ্রহ দেখে নেইমারের বাবা বুঝতে পারেন এই ট্রান্সফারের মাধ্যমে তিনি অনেক টাকা হাতিয়ে নিতে পারবেন। তারপর নেইমারের বাবা দাবি করেন, কেউ যদি তার ছেলেকে সাইন করাতে চায়, তাহলে সাইন করানোর আগেই ১০ মিলিয়ন ইউরো তাকে দিতে হবে এবং ডিল সম্পূর্ণ হলে আরো ৩০ মিলিয়ন- মোট ৪০ মিলিয়ন ইউরো দিতে হবে।
কিছু কিছু সূত্রমতে, শুধুমাত্র একটি ক্লাবেই নেইমার যেতে ইচ্ছুক ছিলো, সেটি হচ্ছে বার্সেলোনা। নেইমারের বয়স তখন ১৯, তাদের পুরনো বাসা থেকে নতুন বাসায় এসে গোপনে বার্সেলোনার সাথে চুক্তি সম্পন্ন হয়। ২০১১ সালের ১৫ নভেম্বর নেইমার রাজি হন ২০১৪ সালে বার্সেলোনাতে আসতে। চুক্তি অনুসারে নেইমারের বাবাকে অগ্রীম ১০ মিলিয়ন ইউরো প্রদান করে বার্সেলোনা। বাকী ৩০ মিলিয়ন তিনি বার্সাতে গেলেই পাবেন এমন আশ্বাস দেওয়া হয়। তিন দিন পরে নেইমারের বাবা ‘N&N Consultoria Esportivo e Empresarial’ নামে একটি কোম্পানি খোলেন এবং এই কোম্পানির একাউন্টেই বার্সেলোনা তাদের প্রথম পেমেন্ট প্রদান করে।
বার্সেলোনা কিংবা নেইমারের বাবা কেউই তাদের এই চুক্তির কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি। এমনকি নেইমারের ক্লাব সান্তোসও এই ব্যাপারে কিছু জানতো না। ৮ মাস পরে বার্সেলোনার প্রকাশিত ফাইনান্সিয়াল রিপোর্টের ১৭৮ নম্বার পৃষ্ঠায় এই পেমেন্টকে ভবিষ্যৎ ট্রান্সফারের ডাউন পেমেন্ট হিসেবে দেখানো হয়। তবে কোথাও নেইমারের কথা উল্লেখ ছিলো না। অন্যদিকে নেইমারের বাবা সান্তোসকে চাপ দিতে থাকেন নেইমারের কন্ট্রাক্ট এক বছর কমিয়ে ২০১৩-তে নিয়ে আসার জন্য। বার্সেলোনা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নেইমারকে আনুষ্ঠানিকভাবে সাইন করাতে চাচ্ছিলো, কারণ রিয়াল তখনো সব দিক থেকে তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছিলো নেইমারকে সাইন করানোর জন্য।
রিয়াল মাদ্রিদ নেইমারকে বেশি বেতন অফার করে এবং নেইমারের বাবা বার্সা থেকে যে ৪০ মিলিয়ন নেওয়ার জন্য চুক্তি করেছিলো সেগুলোও দিতে রাজি হয়। রিয়াল মাদ্রিদ প্রায় সফলও হয়েছিলো এই অফারের মাধ্যমে, কিছুদিন আগে রিয়াল প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ জানান, নেইমার মাদ্রিদে আসার জন্য মেডিক্যাল চেকআপও সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নেইমার আর রিয়াল মাদ্রিদে আসেননি। বার্সা নেইমারকে মনে করিয়ে দেয়, রিয়াল মাদ্রিদে গেলে তাকে স্পন্সরশিপের টাকা ৫০% মাদ্রিদের সাথে ভাগাভাগি করতে হবে, কিন্তু বার্সেলোনাতে আসলে পুরো ১০০% তিনি রেখে দিতে পারবেন। বার্সেলোনা নেইমারকে সাইন করানোর এই ইঁদুর দৌড়ে জিতে যায় এবং সান্তোসের সাথে ১৭ মিলিয়ন ইউরো ফিতে চুক্তি হয়।
নেইমারকে সাইন করানো ছিলো বার্সা প্রেসিডেন্ট সান্দ্রো রোসেলের জন্য ব্যাক্তিগত বিজয়। কিন্তু এই বিজয়ের স্বাদ বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি রোসেল। ইউনিসেফের লোগো বাদ দিয়ে কাতারের সাথে একটি বাণিজ্যিক চুক্তির জের ধরে বার্সেলোনার অনেক ক্লাব মেম্বারের সাথে সান্দ্রো রোসেলের শত্রুতা সৃষ্টি হয়। তাদের মতে, রোসেল বার্সার ‘মোর দ্যান আ ক্লাব’ মোটোকে সম্মান প্রদর্শন করছেন না। বার্সেলোনার যেহেতু কোনো মালিক নেই, বরং ক্লাবের মালিক হলো সাধারণ জনগণ যারা ‘সোশিও’ নামে পরিচিত; তাই প্রেসিডেন্ট ইচ্ছে করলেই ভোট ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এই সোশিওদের একজন ছিলেন জরদি কেসেস। অন্য আরো অনেক সোশিওর মতো কেসেস ছিলেন কাতারের সাথে চুক্তির বিরোধী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে চুক্তি তিনি থামাতে না পারলেও রোসেলের উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ফাইনান্সিয়াল রিপোর্টে উল্লেখ করা সেই ডাউন পেমেন্টের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়ে বার্সা বোর্ডকে চিঠি প্রদান করেন তিনি। কিন্তু বার্সা বোর্ড তাকে কোনো উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যায়। চিঠির উত্তরে রোসেল বিস্তারিত তো বলেনইনি, উল্টো কেসেসকে হুমকি-ধমকি দিয়ে চুপ করানোর চেষ্টা করেন।
পরবর্তীতে কেসেস স্পেন ন্যাশনাল কোর্টে ফ্যাক্সের মাধ্যমে লিখিত অভিযোগ করেন এবং এই ডিল অনুসন্ধানের জন্য আবেদন জানান। এবারে বার্সা বোর্ডের টনক নড়ে এবং তারা চিঠির উত্তর প্রদান করে। বোর্ড জরদি কেসেসকে অভিযোগ তুলে নেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে এবং গোপন তথ্য ফাঁস হলে তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করারও হুমকি দেয়। ৪০ বছর বয়সী এই ফার্মাসিস্ট তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং ক্রিসমাসের ছুটির পর বিচারক পাবলো রুইজ অনুসন্ধান করতে রাজি হন। অবস্থা বেগতিক দেখে রোসেল প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন। প্রেস কনফারেন্সে তিনি বেআইনি কিছু করেননি বলে জানান এবং বার্সা সদস্যদের সাথে তার খারাপ সম্পর্কের প্রভাব যাতে ক্লাবের উপর না পড়ে এজন্য পদত্যাগ করেছেন- এমনটাই দাবি করেন সান্দ্রো রোসেল।
নেইমারের পরিবার থেকে অনুমতি পাওয়ার পর বার্সেলোনার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট জোসেপ বারতামেউ সংবাদ সম্মেলন করেন এবং নেইমারের ট্রান্সফার ফি মোট ৫৭.১ মিলিয়ন ইউরো বলে জানান। জানানো হয়, ১৭.১ মিলিয়ন সান্তোসকে দিতে হয়েছে, আর বাকি ৪০ মিলিয়ন ইউরো পেয়েছেন তার বাবা। যদিও এই ট্রান্সফারে অনেকগুলো বোনাস পেমেন্ট ছিলো- প্রতি বছর নেইমার পাবেন ৫ লক্ষ ইউরো, ব্রাজিলে বার্সার তথাকথিত এম্বাসেডর হওয়ার জন্য এবং ৪ লক্ষ ইউরো পাবেন নেইমারের বাবা প্রতি বছর সান্তোসের ৩ জন তরুণ খেলোয়াড়কে স্কাউট করার জন্য। এই বোনাসগুলো ছিলো ১০ মিলিয়ন বেতনের বাইরে উপরি পাওনা। পরবর্তীতে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার অভিযোগে স্পেনের কর বিভাগকে আরো ১৪ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা দিতে হয় বার্সেলোনাকে। সব মিলিয়ে নেইমারকে সাইন করাতে ঠিক কত খরচ করেছে বার্সেলোনার, এটির একদম সঠিক হিসেব এখনো না পাওয়া গেলেও একটি ইন্টার্ভিউতে বারতামেউ স্বীকার করেন, নেইমারের ট্রান্সফার খরচ হিসেবে বার্সাকে ১০০ মিলিয়ন ইউরোর কাছাকাছি গুণতে হয়েছে!
বার্সেলোনার স্টেডিয়াম ক্যাম্প ন্যুতে আনুমানিক ৫৬,৫০০ দর্শকের উপস্থিতিতে নেইমারকে আনুষ্ঠানিকভাবে বার্সার খেলোয়াড় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ২০১৩-১৪ মৌসুমে লা লিগার প্রথম ম্যাচে লেভান্তের বিপক্ষে এলেক্সিস সাঞ্চেজের বদলি হিসেবে বার্সার হয়ে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে প্রথমবারের মতো খেলতে নামেন নেইমার। নতুন এসে ইউরোপীয় ফুটবলে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগাযন, সেই মৌসুম খুব একটা ভালো কাটেনি নেইমারের। তিনি ৪১ ম্যাচে ১৫ গোল এবং ১৫টি এসিস্ট করলেও সেই মৌসুমে মেজর কোনো ট্রফি জিততে পারেনি বার্সেলোনা।
পরের মৌসুমেই বার্সার জার্সিতে বাজিমাত করেন নেইমার। ৫১ ম্যাচে মোট ৩৯টি গোল এবং ১১টি এসিস্ট করে বার্সাকে ট্রেবল জিততে সাহায্য করেন কাতালান ক্লাবটির তারকা হয়ে ওঠা নেইমার। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল এবং সেমিফাইনালসহ নক-আউটের প্রতিটি ধাপেই গোল করেন নেইমার। মোট ১০ গোল নিয়ে রোনালদো এবং আরেক বার্সেলোনা সতীর্থ মেসির সাথে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের টপ স্কোরার হন তিনি। ভালো পারফর্মেন্সের স্বীকৃতিও পান সেবার ‘ব্যালন ডি অর’ রেসে তৃতীয় হয়ে।
২০১৫-১৬ মৌসুমেও ভালো পারফর্মেন্সের ধারা বজায় রাখেন নেইমার। ওই সিজনে ৪৯ ম্যাচে করেন ৩১ গোল এবং সতীর্থদেরকে বানিয়ে দেন আরো ২৭ টি গোল। সেবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে বাদ পরলেও ‘লা লিগা’ এবং ‘কোপা দেল রে’ জিতে নেয় বার্সেলোনা।
২০১৬ সালের ট্রান্সফার উইন্ডোতে পিএসজি, ইউনাইটেড নেইমারের ২০০ মিলিয়ন রিলিজ ক্লজ দিয়ে তাকে বার্সা থেকে নিয়ে যাবে এমন গুজব শোনা গেলেও, শেষ পর্যন্ত জুলাইতে বার্সেলোনা থেকে নেইমারের সাথে চুক্তি নবায়নের ঘোষণা আসে। নতুন চুক্তি অনুসারে নেইমারের বেতন বাড়িয়ে ১০ মিলিয়ন থেকে ১৬ মিলিয়ন করা হয় এবং চুক্তির মেয়াদ ২০১৮ সাল থেকে বাড়িয়ে ২০২১ সাল পর্যন্ত করা হয়। অন্যদিকে রিলিজ ক্লজ ২০০ মিলিয়ন ইউরো থেকে বাড়িয়ে ২২২ মিলিয়নে নির্ধারণ করা হয়।
২ এপ্রিল ২০১৭, নেইমার বার্সেলোনার হয়ে তার ১৭৭তম ম্যাচে ১০০তম গোল করেন। অন্য দুই মৌসুমের তুলনায় ২০১৬-১৭ মৌসুম খুব একটা ভালো কাটেনি নেইমারের। এই মৌসুমে ৪৫ ম্যাচে ২০ গোল এবং ২৭টি এসিস্ট করলেও শুধুমাত্র ‘কোপা দেল রে’ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় বার্সেলোনাকে।
বার্সেলোনার হয়ে আমেরিকাতে প্রি-সিজন ট্যুরে থাকাকালীন ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিক মার্সেলো বেচলার টুইটারে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে জানান, পিএসজি নেইমারের রিলিজ ক্লজ দিতে ইচ্ছুক এবং নেইমারও এতে সম্মত হয়েছেন। প্রথমদিকে এই খবরকে কেউ পাত্তা না দিলেও, অন্যান্য নির্ভরযোগ্য সাংবাদিকরাও যেমন- ইতালির ডি মারজিও এই খবরটি নিশ্চিত করেন। এরপরে চলতে থাকে অনেক জল্পনা-কল্পনা। মাঝে বার্সেলোনার জেরার্ড পিকে টুইটারে “সে থাকছে” এই ক্যাপশন দিয়ে একটি ছবি পোস্ট করলে সবাই ধরে নেয়, নেইমার বার্সায় থাকতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু পরদিনই সংবাদ সম্মেলনে পিকে এটি অনুমান করে পোস্ট করেছেন বলে জানান।
তারপর একে একে ইনিয়েস্তা, মাশচেরানোসহ অন্য খেলোয়াড়রা নেইমারকে থাকার জন্য অনুরোধ করলেও নেইমার পিএসজিতে যাওয়ার জন্যই মনস্থির করেন। প্রি-সিজন শেষে আমেরিকা থেকে একটি ইভেন্টে যোগ দিতে চীনে যান নেইমার। সেখান থেকে ফিরে এসে পরদিন ট্রেনিংয়ে যোগ দেয়ার কথা থাকলেও প্রায় ৩০ মিনিট পরে ট্রেনিংয়ে আসেন নেইমার এবং তার কোচসহ সতীর্থদের বিদায় জানিয়ে ট্রেনিং থেকে বিদায় নেন। এর কিছুক্ষন পরেই বার্সেলোনার অফিসিয়াল টুইটার একাউন্ট থেকে বলা হয়, নেইমারকে ট্রেনিংয়ে অংশ না নেওয়ার জন্য অনুমতি প্রদান করেছেন কোচ ভালেভারদে। তার কয়েক ঘণ্টা পর বার্সেলোনা তাদের ওয়েবসাইটে জানায়, নেইমার ক্লাব ছাড়তে চান এবং কোনো ক্লাব তাকে সাইন করাতে চাইলে রিলিজ ক্লজের ২২২ মিলিয়ন ইউরো দিয়েই তাকে সাইন করাতে হবে। অনেক জল্পনা-কল্পনার পরে আগস্টের ৩ তারিখ নেইমারের আইনজীবী বার্সেলোনার কাছে ২২২ মিলিয়ন ইউরো হস্তান্তর করেন। রিলিজ ক্লজ প্রদানের মাধ্যমে নেইমার আনুষ্ঠানিকভাবে আর বার্সেলোনার খেলোয়াড় রইলেন না।
বার্সার সাথে চুক্তি শেষ করার কয়েক ঘণ্টা পরেই প্যারিস সেইন্ট-জারমেই (পিএসজি) তাদের ওয়েবসাইটে জানায়, নেইমারের সাথে ৫ বছরের চুক্তি হয়েছে তাদের। সংবাদমাধ্যম স্কাই স্পোর্টস-এর মতে, সেখানে নেইমারের বেতন হবে ৫ বছরে ১৫০ মিলিয়ন ইউরো, অর্থাৎ প্রতি বছরে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ইউরো, যেটি রিয়াল মাদ্রিদ তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর চেয়েও বেশি। ভক্তদের উদ্দেশ্যে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেয়া বিদায়ী বার্তায় নেইমার বার্সেলোনাকে ধন্যবাদ জানান এবং নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্যই তিনি প্যারিসে যাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন। কাতার ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপ এই ক্লাবটিকে কেনার পর তাদের স্বপ্ন হচ্ছে, ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদার আসর চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা। নেইমারকে সাইন করানোর মাধ্যমে পারবে কি পিএসজি তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে? সেটি সময়ই বলে দেবে। তবে নেইমারকে দলে ভেড়ানোর মাধ্যমে তারা নিঃসন্দেহে এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে স্বপ্নপূরণের পথে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ফিচার ইমেজ- wallpapercrave.com