সাবেক এক সৈনিকের হঠাৎ করে ‘অ্যাকিউট ম্যানিয়া’ রোগ দেখা দিলো। এই রোগে প্রবল উন্মাদনা, বাতিকগ্রস্ততা, প্রচণ্ড ক্ষিপ্ততা প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়। সামলাতে না পেরে পরিবারের সদস্যরা তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আরেক কৃষক আক্রান্ত হয় ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগে। অপুষ্টির কারণে এই রোগ বাসা বাঁধে ঐ দরিদ্র কৃষকের শরীরে। বাচ্চাদের খাওয়াতে গিয়ে নিজের মুখে এক মুঠো অন্ন তুলে দেয়ার সৌভাগ্য তার আর হতো না। পরিস্থিতি খারাপ হয়ে পড়লে পরিবারের সদস্যরা তাকে মানসিক হাসপাতালে রেখে আসতে বাধ্য হয়। সেই একই মানসিক হাসপাতালে আর ছিল এক গৃহবধূ, যার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার পাঁয়তারা করতে গিয়ে জোর করে পাগল সাজিয়ে পাগলাগারদে রেখে আসে তাকে।
এমনি আরও হাজারো রোগীর ঠাঁই হয়েছিল মিসিসিপির সেই মানসিক হাসপাতালে, যাদের কাউকে পরবর্তীতে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের সবার শেষ চিহ্নই আজ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস খুঁড়ে নাম-পরিচয়হীন এমন প্রায় ৭,০০০ মানসিক রোগীর দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে এ বছরে মে মাসে। মিসিসিপির স্টেট অ্যাসাইলামে ১৮৫৫ সাল থেকে প্রায় ১১ হাজার মানসিক রোগী ভর্তি হয়। ১৯৩৫ সালে পাগলাগারদটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই বিপুল সংখ্যক রোগীর ভাগ্যে কী জুটেছিল তা জানতে কাজ করে যাচ্ছেন জ্যাকসনের মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের গবেষকরা।
গবেষকরা সম্প্রতি এ ব্যাপারে তাদের পরবর্তী পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। পরিত্যক্ত এই পাগলাগারদ ঘিরে অচিহ্নিত যেসব কবর পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো খনন করে মৃতদেহ উদ্ধার করে একটি মেমোরিয়ালে এবং স্টাডি সেন্টারে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিয়েছেন তারা। এতে করে হারিয়ে যাওয়া এই রোগীদের বংশধররা এতো বছর পরেও অন্তত জানতে পারবেন, কেন তাদের আত্মীয়রা এই মানসিক হাসপাতালে গিয়ে আর কখনো ফিরে আসেনি। আশার প্রহর গুনছিলেন যারা, তাদের অপেক্ষার পালা এবার হয়তো শেষ হতে যাচ্ছে। আশার সাথেই অবশ্য ঘুরেফিরে চলে আসে হাজারো গল্পের ঝুলি।
অ্যাসাইলাম হিল রিসার্চ কনসোর্টিয়ামের বিশেষজ্ঞদের সাথে অনবরত যোগাযোগ করে যাচ্ছেন হারিয়ে যাওয়া এসব মানসিক রোগীদের পরিবারবর্গ। তাদের ইতিহাস, পুরনো রেকর্ড, ডিএনএ প্রোফাইল, পূর্ববর্তী অনুসন্ধানের ফলাফল, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত গল্পের সত্যতা প্রভৃতি নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন গবেষণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ড. মলি জাকারম্যান জানিয়েছেন,
“মৃত ব্যক্তিদের বংশধরদের কাছ থেকে বেশি কিছু ইমেইল পেয়েছি আমি। তারা বারবার করে জানতে চাইছেন তাদের পূর্বপুরুষরা এখানে আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার উপায় কী?”
মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তিনি। যে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রজেক্টের সাথে জড়িত আছে তাদের মধ্যে মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তিনি আরও জানান,
“মেইলে অনেকে তাদের হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার মানুষগুলোর গল্প বলেছে আমাকে। কোনো কোনো গল্প খুব মর্মস্পর্শী, কোনোটা খুব নির্মম। না-বলা, না-জানা সেই গল্পগুলোই এখন উঠে আসছে নতুন করে। অনেকের সাথে জড়িয়ে আছে দক্ষিণের যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের ইতিহাস।”
একসময় ‘মিসিসিপি স্টেট লুনাটিক অ্যাসাইলাম’ হিসেবে পরিচিত এই পাগলাগারদের সাথে মিশে আছে দক্ষিণাঞ্চলের ইতিহাস। দাসপ্রথা, গৃহযুদ্ধ, পৃথকীকরণ (সেগ্রেগেশন) ইত্যাদি সমস্যার বেড়াজাল ঘিরে ধরে এই মানসিক হাসপাতালটিকেও। রোগীদের আত্মীয়রাও নিয়মিত তো দূরে থাক, খুব একটা খোঁজ-খবরই রাখতে পারতেন না তাদের। সরকারি অনুদানে কোনোমতে টিকে থাকা এই হাসপাতালটিকে হুমকির মুখে ফেলে দেয় সিফিলিস, পেলাগ্রা (অপুষ্টিজনিত এক ধরণের অসুখ যা বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দক্ষিণে মহামারী আকার ধারণ করে), হিস্টিরিয়া আর চিরাচরিত দারিদ্র্য। একের পর এক লাশ নিয়ে হিমশিম খেতে থাকে কর্তৃপক্ষ। মৃতদেহের সৎকার করার জন্য কোন আত্মীয়-স্বজনকেও খুঁজে পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় লাশগুলো কোনমতে মাটি চাপা দিয়ে ১৯৩৫ সাওলে পাগলাগারদটিই বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মাটি খুঁড়ে খুঁজে পাওয়া দেহাবশেষগুলো নিয়ে গবেষণা করছেন স্নাতক পর্যায়ের এমন এক শিক্ষার্থী মিশেল ডেভেনপোর্ট বলেন,
“অতিরিক্ত আবেগ, দুশ্চিন্তা আর মাত্রাতিরিক্ত যৌনাকর্ষণের ফলে রোগীরা দ্রুত এসব মহামারীর সহজ শিকারে পরিণত হয়।”
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহু আগে থেকেই এই মৃতদেহগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু তাদের সঠিক সংখ্যাটি কত তা তাদের ধারণাতেও ছিল না। ক্যাম্পাসের পূর্ব প্রান্তে প্রায় ২০ একর জমি জুড়ে অবস্থিত পরিত্যক্ত এই পাগলাগারদটিকে সংস্কার করে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম প্রায় ৬৬টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় এখান থেকে। ২০১৪ সালে জরিপ ও উদ্ধারকাজ চালিয়ে আরও প্রায় ২,০০০ কফিন শনাক্ত করা হয়। আর চলতি বছরের গবেষণায় প্রত্নতাত্ত্বিকরা অনুমান করছেন এখানে প্রায় ৭,০০০ মৃতদেহ রয়েছে, যারা সবাই এই পাগলাগারদের সাবেক রোগী। ৩.২ মিলিয়ন ডলারের এই প্রজেক্ট অনুযায়ী মৃতদেহগুলো একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করে সেখানে সংরক্ষণ করার কথা চলছে। যেহেতু ফান্ডের পুরোটা এখনো হাতে এসে পৌঁছায়নি, কাজেই সবগুলো দেহাবশেষ উদ্ধার করতে প্রায় আট বছর লেগে যাবে বলে ধারণা করছেন কর্তৃপক্ষ।
ড. জাকারম্যান জানান, গবেষণা শুরু করার জন্য একদম প্রথমদিকের রেকর্ডগুলো খুঁজে বের করা হচ্ছে। সে সময়ে মানসিক অসুস্থতাকে কলঙ্কিত বলে মনে করা হতো আর ঝাড়ফুঁক বা এধরনের নানা ভুল চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীদের উপর এক প্রকার নির্যাতন চালানো হতো। ভর্তির রেকর্ড এবং হাড় ও দাঁত পরীক্ষা করে রোগীদের জীবনযাপন সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য তারা পেয়েছেন যা তৎকালীন বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যায়নি। কয়েকটি পরিবারের কাছে তাদের হারিয়ে যাওয়া সদস্যের মেডিকেল রিপোর্ট জানাটা বেশি জরুরি, কোনো পরিবার আবার গুরুত্ব দিচ্ছেন আবেগের প্রতি, হারানো আত্মীয়ের অন্তত কঙ্কালটি খুঁজে পেলেও তারা নিজের সাথে রাখতে চান।
“এখানে হারিয়ে যাওয়া আমার পূর্বপুরুষ, যিনি বহু সন্তানের জননী ছিলেন, তার যথাযথ সম্মান পেয়েছিলেন কি?” উদ্ধারকাজে সংশ্লিষ্টদের কাছে প্রশ্ন রেখে যান এক নারী। “কখনোই তার কাছে যেতে না পারার আক্ষেপটা সারাজীবনই থেকে যাবে”, বলছিলেন ৫৬ বছর বয়সী এলেইন পেরিম্যান। তিনি এসেছিলেন তার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া এথেলের খোঁজে। এথেল ছিলেন আফ্রিকান এক নারী যাকে দত্তক নেন শ্বেতাঙ্গ এক আমেরিকান দম্পতি। কিন্তু ক্রীতদাসের সেই যুগে আফ্রিকান-আমেরিকান দ্বন্দ্বের দেয়াল শেষ পর্যন্ত ভাঙতে পারেননি তারা। গৃহযুদ্ধের সময় দত্তক নেয়া মেয়ের প্রাণ বাঁচাতে তাকে এই অ্যাসাইলামে রেখে যান আমেরিকান দম্পতিটি। আফসোস করে বলেন এলেইন, “শেষ রক্ষা আর হলো কোথায়? তবুও আমার পূর্বপুরুষের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এথেলের সাথে। একবারের জন্য হলেও যদি তার মৃতদেহটা দেখতে পেতাম তাহলে কিছুটা শান্তি লাগতো।”
২০১৩ সালে মৃতদেহের উদ্ধার কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই বাকিদের মতো এলেইনও সপ্তাহে অন্তত একদিন এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন তার আত্মীয়কে পাওয়া গেছে কিনা। ৭,০০০ মৃতদেহ এখানে সমাহিত আছে শুনে আশার আলো খুঁজে পেয়েছেন তিনি। আর এতো সংখ্যক দেহাবশেষের কথা শুনে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমও হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মিসিসিপি ক্যাম্পাসকে ঘিরে। সব মিলিয়ে সেখানে এখন পুরোদমে উদ্ধারকাজ চলছে। কনসোর্টিয়ামের প্রধান ড. র্যালফ ডিডলেক বলেন,
“এখানে লোক সমাগম এতো বেড়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা, স্বাস্থ্যসুরক্ষা ও গবেষণা কাজ ব্যাহত হচ্ছে। তাই বলে কেউ যদি পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাকে খুঁজতে এখানে আসে তাদেরকে তো আমরা মানাও করতে পারি না।”
বিস্মৃত এই হারিয়ে যাওয়া মানসিক রোগীদের আত্মীয়রা একে অন্যকে পুরনো দিনের হাজারো স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেন। শুরুতে যে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত দরিদ্র কৃষকের কথা বল হয়েছিল তার নাম জন বি. হুইটফিল। তার নাতি, ৭১ বছর বয়সী জেমস টি. লি, জানান ১৯০০ সালের দিকে ভাগ্যের অন্বেষণে দাদা কেন্টাকি ছেড়ে মিসিসিপিতে চাষাবাদ শুরু করেন। প্রান্তিক এই কৃষক পাঁচ সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে গিয়ে নিজে বেছে নেন অনাহারীর জীবন। ভিটামিন বি এর অভাবে শীঘ্রই ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন তিনি এবং ১৯৩২ সালে তাকে রেখে দিয়ে আসা হয় অ্যাসাইলামে। পরিবারের সদস্যদের সেখানে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন স্থানীয় শেরিফ। লির ধারণা না খেতে পেয়েই মারা গেছে তার দাদা। এক বছর ধরে নিয়মিত এখানে আসছেন তিনি, কিন্তু এখনো তার দাদার কোনো রেকর্ড খুঁজে বের করতে পারেননি।
কেউ তার দাদা, কেউবা পর-দাদা, কেউ বা নানীর নানী খুঁজছেন এই সমাধিক্ষেত্রে। হারিয়ে যাওয়া এই মানুষগুলোর কঙ্কালের সাথে মিশে আছে দক্ষিণের করুণ ইতিহাস। সেই ইতিহাসের সাক্ষীদের প্রতি সম্মান জানাতেই একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা।