সিনেমাকে বলা হয় সমাজের আয়না। কিন্তু আদৌ ক’টা সিনেমায় আমরা সমাজের ছায়া খুঁজে পাই? পূর্ণ প্রতিফলনের কথা নাহয় বাদই দিলাম। বাংলাদেশে খুব সচেতনভাবেই আমাদের চারপাশের জীবনটাকে যারা সিনেমার পর্দায় তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, তাদের মাঝে একেবারেই প্রথমদিকে চলে আসে তারেক মাসুদের নাম।
তারেক মাসুদকে একাধারে সিনেমার কারিগর এবং ফেরিওয়ালা বললে ভুল হবেনা মোটেই। জীবনের রং আর স্বাদ ছেনে সিনেমা বানাতেন। তারপর সাদর আগ্রহ নিয়ে সেই ছবি মানুষকে দেখাতেন, দেশের এ প্রান্ত থেকে ও’প্রান্তে, কখনোবা সীমানা ছাড়িয়ে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প তখন মৃতপ্রায়। সিনেমাপাগল এক তরুণ তার সিনেমার ঝুলি নিয়ে ঘুরছেন দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে। বাণিজ্যিক ছবির দাপুটে বাজার, রুগ্ন সমাজ, অর্থাভাব কিংবা অসহযোগী প্রশাসন- কোনোকিছুই তার স্বপ্নকে থামাতে পারেনি। দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে মানুষটি চেয়েছিলেন এ দেশের চলচ্চিত্র আক্ষরিক অর্থেই শিল্প হয়ে উঠবে। সেই শিল্পের ছোঁয়া লাগবে দেশের তরুণ-বৃদ্ধ সবার হৃদয়ে। আত্মার মুক্তি আসবে। শিল্পসত্ত্বার দায়বদ্ধতা নিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্ব দরবারে নিজস্ব স্থান দেওয়ার জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন সেলুলয়েডের এই কবি।
তারেক মাসুদের জন্ম ১৯৫৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর। জন্মস্থান ফরিদপুর জেলার নূরপুর গ্রাম। ছোটোবেলায় ইসলামি শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে তাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় মাদ্রাসায়। ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তার পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। পরে ঢাকার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে কিছুদিন পড়ালেখা করার পর নটরডেম কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। মূলত এ সময় থেকেই তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। তিনিই এ দেশের পরিচালকদের মধ্যে প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের সূচনা করেন। আরেক কিংবদন্তী মেধাবী নির্মাতা আলমগির কবির ছিলেন তাঁর সিনেমাগুরু। আহমদ ছফার বিশেষ ভক্ত ছিলেন তিনি।
তারেক মাসুদের প্রথম কাজ ‘আদম সুরত’ (দ্য ইনার স্ট্রেংথ)। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৮৯ সালে। এটি মূলত এস এম সুলতানের উপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র। আদম সুরতের কাজ শুরু হয়েছিলো ১৯৮২ সালে। চিত্রাপাড়ে ধারণ করা হয় আদম সুরত। তারেক মাসুদ বলেছিলেন, “চিত্রা নদীর পাড়ে থাকেন চিত্রশিল্পী সুলতান। আমরা যখন সুলতান ভাইয়ের উপর ছবি বানাতে আসলাম তখন চিত্রাই হয়ে গেলো সমস্ত কিছুর কেন্দ্রবিন্দু।”
১৯৮৫ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘সোনার বেড়ী’ নামের আরেকটি প্রামাণ্যচিত্র। ‘সোনার বেড়ী’-তে মূলত এদেশের সমকালীন নারীদের আর্থসামাজিক অবস্থান এবং সেই অবস্থানে তাদের অধিকার ও ভূমিকার বিষয়টা খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। প্রামাণ্যচিত্র হওয়ায় ‘আদম সুরত’ ও ‘সোনার বেড়ী’ বোদ্ধাদের প্রশংসা পেলেও খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি।
১৯৯৫ সালে তারেক মাসুদ তৈরি করেন ‘মুক্তির গান’। তখনকার প্রেক্ষাপটে এই কাজটির দরকার ছিল খুব। রাজনৈতিক অস্থিরতা সহ বিভিন্ন কারণে ‘৭৫ এর পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনেকটাই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছিলো। মুক্তির গান তৈরির গল্পটাও বেশ চমকপ্রদ।১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন বাংলাদেশে আসেন। তার ক্যামেরায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত অঞ্চলের একদল শিল্পীর কাজ ধারণ করেন। পথশিল্পীদের এই দলটি ট্রাকে করে ঘুরে বেড়াতো গেরিলা ক্যাম্প, শরণার্থী শিবির এবং হাসপাতালগুলোতে। আর গাইতো মুক্তির গান। লেভিন তার ক্যামেরায় এসব ফুটেজ ধারণ করে রাখেন। যুদ্ধের পরে লেভিন ফিরে যান যুক্তরাষ্ট্রে। পরবর্তীতে ব্যস্ততা এবং অর্থাভাবে সেই ফুটেজগুলো নিয়ে কোনো কাজ করা হয়নি। প্রায় দু’দশক পরে ১৯৯১ সালে তারেক মাসুদের সাথে লেভিনের দেখা হয়। তারেক মাসুদ ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ এই ফুটেজগুলো নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। লেভিনও রাজি হয়ে যান সানন্দেই।
‘মুক্তির গান’ শুধু যে লেভিনের ফুটেজগুলো দিয়েই তৈরি হয়েছে তা নয়, বরং অন্যান্য চিত্রগ্রাহকদেরর কাছ থেকে সংগৃহীত ফুটেজও ব্যবহার করা হয়েছে এতে। গল্পের প্রয়োজনে আরো কিছু তৈরিকৃত দৃশ্য সংযোজন করেন তারেক মাসুদ। মুক্তির গান অনেকটা গল্পের মতো। গল্পের কথক শিল্পীদলেরই এক সদস্য, শহুরে তরুণ তারিক আলী। মুক্তির গান আসলে তৎকালীন মুক্তির চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য অনেক বড় একটা প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তারেক মাসুদ আর ক্যাথরিন মাসুদের। তাদের সম্পাদনা আর তীক্ষ্ণ মেধার জোরেই কিছু ফুটেজ হয়ে উঠেছে অনবদ্য ‘মুক্তির গান’। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের উপর ভিত্তি করেই তারেক মাসুদ তৈরি করেন ‘মুক্তির কথা’ ও ‘ নারীর কথা’ নামের আরো দুটি প্রামাণ্যচিত্র।
২০০২ সালে নির্মিত হয় ‘মাটির ময়না’। এটি নিঃসন্দেহে তারেক মাসুদের তৈরি অন্যতম সেরা কাজ। ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে এটি জিতে নেয় ‘ফিপরেস্কি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস প্রাইজ’। এছাড়াও অস্কারে ‘সেরা বিদেশী ভাষার ছবি’ ক্যাটাগরিতে প্রথম বাংলাদেশী সিনেমা হিসেবে ‘মাটির ময়না’কে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
‘মাটির ময়না’র গল্প গড়ে উঠেছে ষাটের দশকের বাংলাদেশ, মানুষের জীবন এবং মুক্তিযুদ্ধে ইসলামের প্রভাবের সংমিশ্রণে। আনু গ্রামের এক রক্ষণশীল মুসলিম ঘরের ছেলে। তার বাবা কাজী সাহেব। কাজী সাহেব ছেলেকে ধর্মীয় শিক্ষার উদ্দেশ্যে ভর্তি করে দেন মাদ্রাসায়। যুদ্ধ শুরু হয়। সিনেমার একটি অংশে দেখা যায় বাউল গান। বাউল তার অদ্ভুত সুন্দর কণ্ঠে বলছেন, “যদি আল্লার সন্ধান চাও গো, প্রেম রাখিও অন্তরের ভিতর।” গানের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে ঘুণে ধরা সমাজের নারী-পুরুষ ভেদাভেদ, কাঠমোল্লাদের দৌরাত্ম্য, অন্ধ বিশ্বাস আর লোক দেখানো আচারের বিভিন্ন দিক।
‘মাটির ময়না’য় তারেক মাসুদ তার বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছেন। তার মাদ্রাসা জীবন, সেখানকার শিক্ষক, তৎকালীন সমাজ, গ্রামীণ সমাজের খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে অন্ধ বিশ্বাসের প্রভাব- সবকিছুর স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায় সিনেমাটির পরতে পরতে।
তারেক মাসুদ নির্মিত আরো দুটি চলচ্চিত্র হলো ‘রানওয়ে’ (২০১০) এবং ‘অন্তর্যাত্রা'(২০০৬)। সিনেমাগুলোতে আপাতদৃষ্টিতে জঙ্গি, মৌলবাদী কিংবা অস্তিত্বহীন চরিত্রগুলোর পেছনের গল্প তুলে এনেছেন তিনি, দেখিয়েছেন পারিপার্শ্বিকতা কীভাবে তাদেরকে ভুল পথে নিয়ে গেছে। ‘রানওয়ে’তে মৌলবাদের শিকার জঙ্গি রুহুল কিংবা ‘অন্তর্যাত্রা’র তরুণ অভিবাসী সোহেল সবাইকে তারেক মাসুদ ফিরিয়ে এনেছেন। ‘মাটির ময়না’তেও কাজী সাহেব তার ভুল বুঝতে পারেন। তার সৃষ্ট চরিত্রের সবাই অবশেষে জীবনের স্বরূপ খুঁজে পায়। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ক্ষুদ্র জিনিস যে অফুরন্ত ভালোবাসার উৎস সেটি তারা অনুভব করতে পারে। এ দেশের প্রতিটি প্রাণ জীবনের স্বরূপ খুঁজে পাবে এই স্বপ্ন, এই প্রত্যাশা নিয়েই সিনেমা বানিয়েছেন তারেক মাসুদ।
‘রানওয়ে’র প্রদর্শনী করানোর তারেক মাসুদ জন্য ঘুরেছেন দেশের প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে। নামমাত্র মূল্যে মানুষকে সিনেমা দেখিয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন দেশের সিনেমা হলগুলো বাঁচুক। সিনেমা হোক জাগরণের মাধ্যম।
আহমদ ছফার মাধ্যমেই ক্যাথরিনের সাথে তারেকের পরিচয়। ক্যাথরিনকে তার সহধর্মিণী না বলে সহযোদ্ধা বলাটাই বেশি মানায়। তাদের দুজনের একমাত্র সন্তান বিংহাম পুত্রা নিষাদ মাসুদ। তারেক মাসুদ জীবন যাপনে ছিলেন অতিসাধারণ। কথায়-চিন্তায়-আচরণে একটা সহজ নিঃসংকোচ আবহ পাওয়া যেত। গানও লিখতেন তিনি। তারেকের মৃত্যুর পর ক্যাথরিনের উদ্যোগে তার লেখা গান নিয়ে প্রকাশিত হয় একটি অ্যালবাম।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জ থেকে ‘কাগজের ফুল’ সিনেমার লোকেশন ঠিক করে ঢাকা ফিরছিলেন তারেক মাসুদ। সাথে ছিলেন সাংবাদিক মিশুক মুনীর এবং ক্যাথরিন। পথিমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর। রক্ষা পেয়ে যান ক্যাথরিন। তারেকের মৃত্যুর পর ক্যাথরিনের উদ্যোগে এবং শুভাকাঙ্খীদের সাহায্যে গড়ে উঠেছে ‘তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’, স্বপ্ন তারেক মাসুদের অসম্পূর্ণ স্বপ্নগুলোকে সম্পূর্ণ করা। জীবন মানুষটাকে থামিয়ে দিয়েছে তো কি? স্বপ্নগুলো পূর্ণতা পাক।
তারেক মাসুদ একজন যোদ্ধা, কবি ও চির তরুণ। ভিন্নধর্মী সিনেমা বানিয়ে শুধু দেশ-বিদেশের প্রদর্শনী করা আর পুরস্কার পাওয়ার মাঝেই তার স্বপ্ন আটকে ছিলো না। তিনি চেয়েছিলেন, শহরের শিক্ষিত তরুণ থেকে শুরু করে গ্রামের চাষাভূষো সবাই সিনেমা দেখুক। পর্দার চরিত্রে তারা নিজেদের আবিষ্কার করুক। শিল্পের দায় থেকেই তিনি এটা চেয়েছিলেন। শিল্পের অদ্ভুত সুন্দর জগতের সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন দেশের সর্বস্তরের মানুষকে। সিনেমাপাগল এই মানুষটিকে দেশের বড় দরকার ছিলো। কিন্তু অদ্ভুত অসময়ে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই চলে গেলেন সেলুলয়েডের এই কবি। শুধু রেখে গেলেন স্বপ্ন জাগানিয়া কিছু কাজ।