ব্রিটিশদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত একটি নাম হচ্ছে তাদের অধিকারের দলিল তথা ‘ম্যাগনা কার্টা’। এই ম্যাগনা কার্টা যে রাজার শাসনামলে প্রণীত হয়েছে তিনি হচ্ছেন জন ল্যাকল্যান্ড বা ‘কিং জন’, যে নামে তিনি সমধিক পরিচিত। এই ম্যাগনা কার্টা, যেটিকে কিনা বলা হয় ব্রিটিশ গঠনতন্ত্রের বাইবেল, এর প্রণয়নকারী রাজাকে কেন বলা হয় ইতিহাসের অন্যতম ‘কুখ্যাত’ চরিত্র? খ্যাতির বিপরীতে ইতিহাসের খলনায়ক হয়েই কুখ্যাত হয়ে আছেন রাজা জন। কেন তার এই কুখ্যাতি? আজকের লেখায় আমরা সে গল্পই জানার চেষ্টা করবো।
শৈশব ও বেড়ে ওঠা
১১৬৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের বিউমাউন্টে অক্সফোর্ডশায়ার প্রাসাদে বড়দিনের উৎসবের প্রাক্কালে জন্মগ্রহণ করেন জন। তার বাবা বিখ্যাত রাজা দ্বিতীয় হেনরি মজা করে তার ডাকনাম রেখেছিলেন ‘ল্যাকল্যান্ড’ (ল্যাক অব ল্যান্ড থেকে ল্যাকল্যান্ড)। কারণ নতুন উত্তরাধিকারকে দেয়ার জন্য নাকি কোনো জমিই ছিল না! শিশু জন সেই পরিহাস হয়তো ভালোভাবে নেননি। তাইতো বড় হয়ে সম্পূর্ণ অ্যাঞ্জেভিন সাম্রাজ্যই নিজের দখলে নিয়ে নেন।
রাজপরিবারের কৃত্রিমতা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর চক্রান্তের মধ্যে বেড়ে ওঠা জনের মধ্যে শিশুসুলভ কোমলতার যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। সদা দুষ্টু মানসিকতার জন ল্যাকল্যান্ড অল্পতেই রেগে যেতেন। কৈশোরে তার এই রাগ এত বেড়ে যায় যে, কখনো কখনো মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটতো তার! শারীরিকভাবে দুর্বল ও নিস্তেজ জন খিটখিটে স্বভাবের জন্য বাল্যকাল কাটিয়েছেন বন্ধু ছাড়াই। তিনি ধর্মকর্মে একদমই বিশ্বাস করতেন না। এ জন্য পিতার শাসন কম হয়নি, কিন্তু জন ধর্মের প্রতি সর্বদাই উদাসীন ছিলেন।
ধর্মের প্রতি উদাসীন জনকে প্রাথমিকভাবে চার্চেই পাঠানো হয় ধর্মীয় দীক্ষা নেবার জন্য। জনের চেয়ে তার বড় ভাই রিচার্ড ছিল যথেষ্ট শক্তসামর্থ। তাই হেনরির ইচ্ছা ছিল রিচার্ডকেই রাজা বানাবেন আর জনকে চার্চের ধর্মগুরু। কিন্তু শৈশব পার করে কৈশোরে পা দিয়েই এই ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি রীতিমত বিদ্রোহ করেছিলেন জন। ১২৮৮ সালে ২১ বছর বয়সী জনের বিয়ে হয় বহু আগেই বাগদান হয়ে যাওয়া চাচাত বোন ‘ইজাবেলা অব গ্লুচেস্টার’ এর সাথে।
আয়ারল্যান্ডে জন
১১৮৫ সালে রাজা হেনরি জনকে আয়ারল্যান্ডের জমিদার হিসেবে অভিষেক করান। কথিত আছে আয়ারল্যান্ডের সেনাপ্রধান যখন জনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে রাজদরবারে আসেন, তখন জন তাকে অপমানিত করেন। তিনি সেনাপ্রধানের লম্বা দাড়ি ধরে টেনেছিলেন এবং তার পোশাক নিয়েও বিদ্রুপ করেছিলেন। এতে করে আয়ারল্যান্ডের রাজদরবারে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়। ফলস্বরূপ জন আয়ারল্যান্ড থেকে বিতাড়িত হন। জনের এহেন কর্মকাণ্ডে বেশ চিন্তিত হন রাজা হেনরি।
ক্ষমতা দখলের ব্যর্থ চেষ্টা
১১৮৯ সালে পারিবারিক বিবাদে রাজা হেনরির উভয় ছেলে রিচার্ড এবং জন তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেন। সে বছরই হেনরি মারা যান। এর ধারাবাহিকতায় রিচার্ডের সাথেও প্রতারণা করেন জন। একই বছর তৃতীয় ক্রুসেড শুরু হলে রিচার্ড ক্রুসেডের জন্য প্রাসাদ ছেড়ে সৈন্যবাহিনী নিয়ে বেরিয়ে যান। তবে যাবার আগে নিজের ভাইয়ের প্রতি সন্দেহ থেকে তিনি জনকে বিশাল সম্পত্তির মালিক করে দিয়ে যান এই আশায় যে জন তার প্রতি অনুগত থাকবে। কিন্তু ভাইয়ের কাছে প্রাপ্ত সম্পত্তিতে নিজের নামের পাশে থাকা ‘ল্যাকল্যান্ড’ শব্দটি বাদ পড়লেও ভাইয়ের সাথে প্রতারণা করতে এক মুহূর্ত ভাবেননি জন। তিনি রিচার্ডকে সরিয়ে সিংহাসনে বসার চেষ্টা চালান। রাজার অবর্তমানে রাজদরবারের কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে থাকা উইলিয়াম লংক্যাম্ফকে অর্থের বিনিময়ে হাত করার চেষ্টা করেন জন।
এদিকে রিচার্ড অস্ট্রিয়ার রাজা লিওপোল্ডের কাছে বন্দী হন। লিওপোল্ড রিচার্ডের বিনিময়ে বিশাল অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করেন। অগত্যা সেই অর্থ দিয়েই ১১৯৪ সালে রিচার্ডকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। অন্যদিকে জন সিংহাসনে বসার ব্যর্থ চেষ্টা চালানোর পর ভাইয়ের ফিরে আসার ভয়ে নরম্যান্ডিতে পলায়ন করেন। কিন্তু রিচার্ড দেশে ফিরেই জনকে ক্ষমা করে দেন। তিনি জনকে কেবল এটুকুই বলেন, “আরো গভীরভাবে ভাবতে শেখো জন। তুমি এখনো শিশু এবং তুমি যা করেছ কারো কুমন্ত্রণা কানে নিয়েই করেছ।”
সিংহাসনে আরোহণ
ভাইয়ের অমায়িক ব্যবহারে কিছুটা হলেও প্রভাবিত হন জন। তিনি পরবর্তী ৫ বছর রিচার্ডের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত হয়ে কাটান এবং রিচার্ডের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ১১৯৯ সালে ‘রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট’ মারা গেলে জন সিংহাসনে বসেন। তাৎক্ষণিকভাবে জনের সিংহাসনে বসা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং নিজেকে রাজা দাবী করেন তার ভ্রাতুষ্পুত্র আর্থার। কেননা নরমান আইন অনুসারে হেনরির একমাত্র জীবিত পুত্র জনেরই রাজা হওয়ার কথা। অন্যদিকে এঞ্জেভিন আইন মোতাবেক রাজা হবার কথা রিচার্ডের পুত্রের। তবে রিচার্ড মৃত্যুশয্যায় জনকে উত্তরাধিকার হিসেবে ঘোষণা করে গেছেন বলে শোনা যায়। ওয়েস্টমিনিস্টারে তার রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। নরম্যান্ডিতেও জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হয়।
প্রাথমিকভাবে আর্থারকে তেমন কোনো সমস্যা মনে করেননি জন। কিন্তু আর্থার গিয়ে ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ অগাস্টাসের সাথে হাত মেলান। আর ফিলিপও ইংল্যান্ডকে দুর্বল করার এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। তাই তিনি নরম্যান্ডি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই পরিস্থিতিতে একটি আত্মঘাতী ভুল করে বসেন জন। তিনি ইজাবেলা অব গ্লুচেস্টারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের ইতি ঘোষণা করেন (কোনো সন্তান না হওয়ায়) এবং ১২ বছর বয়সী ‘ইজাবেলা অব এঙ্গোলেমে’-কে বিয়ে করেন। এদিকে ইজাবেলা অব এঙ্গোলেমের যখন ১০ বছর বয়স, তখনই তার সাথে এঙ্গোলেমের রাজা লুসিগানের বাগদান সম্পন্ন হয়। কেবল অপেক্ষা করা হচ্ছিল ইজাবেলার বয়স আরেকটু বৃদ্ধির। ফলে জনের এই কাজে অত্যন্ত ক্রুব্ধ হলেন লুসিগান। তিনিও রাজা ফিলিপ আর আর্থারের সাথে যোগ দেন। এদিকে রাজা জন নতুন স্ত্রীর প্রতি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েন। কথিত আছে, প্রথম কয়েক মাস তিনি শয়নকক্ষ থেকে দুপুরের আগে বের হতেন না!
প্রাথমিক বিদ্রোহ দমন ও নরম্যান্ডির ক্ষমতা হারানো
১২০৩ সালে রাজা ফিলিপ আনুষ্ঠানিকভাবে আর্থারের দাবিকে সমর্থন জানান। তিনি আর্থারের জন্য নরম্যান্ডি মুক্ত করবেন বলে ঘোষণা দেন। এই ঘোষণায় নড়েচড়ে বসেন জন। তিনি আর্থারকে ফিলিপের সঙ্গ ত্যাগ করে ফিরে আসার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আর্থার তাতে কর্ণপাত করেননি। ১২০৪ সালে ফিলিপ ও লুসিগানের মিলিত সৈন্যবাহিনী নরম্যান্ডি আক্রমণ করেন। তবে এ সময় মিরাব্যুর যুদ্ধে আকস্মিকভাবে জনের সৈন্যবাহিনী আর্থারকে গ্রেপ্তার করে এবং খুব সম্ভবত জন নিজের হাতেই আর্থারকে হত্যা করেন। কথিত আছে তিনি মদ্যপ অবস্থায় জেলে বন্দী আর্থারকে তরবারির আঘাতে হত্যা করেন। আর্থার ছাড়াও জন আরো প্রায় কয়েকশত বিদ্রোহী গ্রেপ্তার করেন। বন্দীদের সাথে চলতে থাকে জনের নিষ্ঠুর আচরণ। উচ্চপদস্থ একদল সৈনিককে তিনি এত কষ্টদায়ক পরিস্থিতিতে রেখেছিলেন যে ২২ জন বন্দী মারা যায়। বন্দীদের সাথে এহেন আচরণে জনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন তার অনেক অনুগত স্বদেশী প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গই। তাছাড়া আর্থারের অনুগতরা ততদিনে জনের শত্রুতেই পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে নরম্যান্ডিও চলে যায় ফিলিপের দখলে।
জনের রাজ্য পরিচালনার ধরণ
এঞ্জেভিন রাজাদের শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি ছিল ‘ফোর্স এন্ড উইল’ বা জোরপূর্বক সম্মতি আদায়। জনের পিতা রাজা দ্বিতীয় হেনরি তো রাজার আসনটিকে রীতিমত স্বর্গীয়ই ভাবতেন! তবে জনের সময়ে সমাজের ব্যারন শ্রেণীর মধ্যে রাজার স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হতো। ফলে জন তার পিতার মতো হতে পারেননি। তবে এসব থেকে বেরিয়ে আসার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি বলা হয় তিনি হলেন জনের প্রধান উপদেষ্টা হুবার্ট ওয়াল্টার। ওয়াল্টার যতদিন বেঁচে ছিলেন, জনের শাসন ছিল ন্যায়ের শাসন। তবে পুরোপুরি ন্যায়ের শাসন বলা যাবে না। কারণ ব্যারনদের প্রতি জন ছিলেন বরাবরই কঠোর। ফলে ব্যারনরা কখনোই জনকে ভালো চোখে দেখেনি।
রাজ্য পরিচালনার জন্য যে বিশাল অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন ছিল, এঞ্জেভিন শাসকরা তা তিনটি উৎস থেকে সংগ্রহ করতো। জমিজমার উপর কর, রাজ্যের প্রতিটি মানুষের নিকট রাজার প্রতি আনুগত্যের কর এবং দ্রব্যমূল্যের উপর কর। এক্ষেত্রে জনকে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিল। কেননা রিচার্ডের শাসনামল থেকেই কর আদায় কমে আসছিল। জনের সময় তা আরো অনেক কমে যায়। সাধারণ জনগণের কর দেয়ায় একপ্রকার অনীহা সৃষ্টি হয়। জন তখন এই পরিস্থিতি থেকে প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করেন। তিনি নিজের সমর্থকদের জন্য কর মওকুফের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ব্যারনদের উপর করের বোঝা ভারী করেন। দেখা যায় সমাজের সুবিধাবাদী মহল এ বিষটিকে স্বাগত জানাচ্ছে। তবে এই ব্যাপারটি ব্যারন সমাজে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
চার্চের সাথে বিবাদ
ধর্মের সাথে জনের সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না। চার্চের প্রতি কখনো ব্যাঙ্গাত্মক আবার কখনো তীর্যক মন্তব্য ছুঁড়ে সমালোচিত হয়েছেন বহুবার। ১২০৫ সালে জনের উপদেষ্টা ‘আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবুরি’ হুবার্ট ওয়াল্টার মারা যায়। পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট নিজের পছন্দের ব্যক্তি ল্যাংটনকে আর্চবিশপ নিযুক্ত করেন। কিন্তু জনের তা পছন্দ হয়নি। তিনি নিজের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে দাবি করে চার্চের সন্ন্যাসীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। এই ঘটনায় রেগে গিয়ে ১২০৯ সালে পোপ রাজা জনকে গীর্জা সম্প্রদায় হতে বহিষ্কার করেন। জনও এর জবাবে চার্চের ক্লার্জিদের সম্পত্তি নানান অজুহাতে বাজেয়াপ্ত করতে থাকেন। কিন্তু ১২১২ সালে তিনি তথ্য পান যে ফ্রান্সের রাজা চার্চের সাথে জনের দ্বন্দ্বের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইংল্যান্ড আক্রমণ করতে পারে। এই খবর পেয়ে দ্রুতই তিনি পোপের সাথে আলোচনায় বসেন এবং ল্যাংটনকে আর্চবিশপ হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
গৃহযুদ্ধ ও ম্যাগনা কার্টা
১২১৪ সালে জন রাজা ফিলিপের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেন। তার সাথে যোগ দেন ফিলিপের শত্রু সম্রাট অটো। তাদের মিলিত সৈন্যবাহিনী আনজু এবং পইতোতে আক্রমণ করে। কিন্তু চতুর ফিলিপের রণকৌশলের কাছে মার খায় জন এবং অটোর রণনীতি। এই যুদ্ধে হার রাজা জনের গলার কাঁটার মতো হয়ে ওঠে। দেশে ব্যারন সমাজের কাছে তিনি ততদিনে পরিত্যাজ্য হয়ে গেছেন। ফলে জনের পক্ষে কথা বলার মতো কেবল পোপই অবশিষ্ট ছিলেন।
১২১৫ সালের এপ্রিল মাসে ব্যারনদের একটি বিশাল সমাবেশ হয় যেখানে তারা সকলেই সশস্ত্র ছিল। এই ঘটনায় রাজা জন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। একে তো ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ যেকোনো সময় আক্রমণ করতে পারে সেই চিন্তা, তার উপর যদি গৃহযুদ্ধ ঘটে তাহলে তার পরিণাম যে ভালো হবে না সেটা জন ভালোভাবেই টের পাচ্ছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। তিনি বাধ্য হয়ে ব্যারনদের বাজেয়াপ্ত করা জমিজমা ফিরিয়ে দিলেন। তাদের শান্ত করতে ওয়াদা করলেন যে পুরাতন নিয়মগুলো পরিবর্তন করে তিনি নতুন নিয়ম কানুনের প্রবর্তন করবেন। তিনি নিজে থেকে অনেক কিছু প্রস্তাব করলেও ব্যারনরা তা গ্রহণ করেনি।
অবশেষে ১৫ জুন ১২১৫ সালে তিনি বিদ্রোহীদের সাথে অনেক আলোচনা করে, আক্ষরিক অর্থে তাদের মতের প্রতিফলন ঘটিয়ে ঐতিহাসিক এক গঠনতন্ত্রের দলিলে সই করেন। তাই এই দিনটিকেই ম্যাগনা কার্টার প্রচলনের দিন হিসেবে ধরা হয়। উইন্ডসোরের রানিমেডে জন এই ব্রিটিশ স্বাধীনতার দলিলে সই করেন। এই দলিলে ব্যাপক পরিমাণ রাজনৈতিক সংস্কারের উল্লেখ করা হয়। করারোপের নতুন নিয়ম, অবৈধ বন্দীদের দ্রুত মুক্তি প্রদান, দ্রুত বিচারকার্য সম্পন্ন করা, যথাযথ কারণ ছাড়া কারো সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত না করা সহ আরো অসংখ্য বৈপ্লবিক ধারার অবতারণা করা হয়। সর্বোপরি রাজার ক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস করা হয় এবং রাজ্য পরিচালনায় জনমতের প্রতিফলনের ব্যবস্থা করা হয়।
মৃত্যু
জনের দুর্ভাগ্যই ছিল বটে, এতকিছু করেও তিনি গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে পারলেন না। ব্যারনরা যেকোনো মূল্যে জনের অপসারণের জন্য উঠেপড়ে লাগে। তারা প্রথমেই রোচেস্টার দুর্গ দখল করে নেয়। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থা জন ভালোভাবেই সামলে নেন। তিনি রোচেস্টারের সাথে অন্য সব স্থানের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন। ফলে বিদ্রোহীরা লন্ডনে একা হয়ে যায়। এই সুযোগে তিনি রোচেস্টার পুনর্দখল করেন। ১২১৬ সালের জানুয়ারি মাসে জন ইংল্যান্ডের নটিংহাম আক্রমণ করেন। সেখানে স্কটল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় আলেক্সান্ডার বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়ে অবস্থান করছিলেন। জন নটিংহামও পুনর্দখল করলে আলেক্সান্ডার স্কটল্যান্ড পালিয়ে যান।
ব্যারন বিদ্রোহীরা উপায়ন্তর না দেখে ফ্রান্সের রাজা ফিলিপকে যুদ্ধে আমন্ত্রণ জানায়। রাজা ফিলিপ ব্যারনদের সাহায্যার্থে নিজের পুত্র লুইসকে প্রেরণ করলেন। এদিকে পোপ ইনোসেন্ট লুইসকে সমাজচ্যুত ঘোষণা করলেন এই যুদ্ধে জড়ানোর জন্য। তবে লুইস সে ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। কিন্তু এখানে জন একটি মারাত্মক ভুল করেছিলেন যা তাকে ইতিহাসে খলনায়ক করে রেখেছে। তিনি ম্যাগনা কার্টা অস্বীকার করলেন এবং সকল বিদ্রোহীকে সমাজচ্যুত ঘোষণার জন্য পোপের কাছে প্রার্থনা করলেন। এছাড়াও তিনি ম্যাগনা কার্টার শর্ত ভঙ্গ করে ব্যারনদের উপর পুনঃরায় অত্যাচার চালাতে শুরু করেন।
প্রাথমিকভাবে জন লুইসকে আক্রমণ করার জন্য কেন্টের দিকে রওনা দেন। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে পথিমধ্যে এক ভয়াবহ ঝড়ের কবলে পড়ে তার সৈন্যবাহিনীর একটি বিরাট অংশ মারা যায়। হারিয়ে যায় তাদের মালামালবাহী গাড়িগুলো। কোনো উপায় না দেখে জন নিউওয়ার্ক দুর্গে চলে গেলেন। সেখানেই ১৯ অক্টোবর ১২১৬ সালে বেশ কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর তার মৃত্যু হয়। ওরচেস্টার ক্যাথেড্রালে জনকে সমাহিত করা হয়।
জনের মৃত্যুর পর আরো এক বছর গৃহযুদ্ধ চলে। ফিলিপের পুত্র লুইস যেহেতু দ্বিতীয় হেনরির নাতনীকে বিয়ে করেছিলেন, সেহেতু তিনিও ব্রিটিশ সিংহাসনের দাবিতে যুদ্ধ চালিয়ে যান। আর জনের ৯ বছর বয়সী পুত্র তৃতীয় হেনরিকে রাজা ঘোষণা করে রাজদরবার। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত হেনরির দায়িত্ব গ্রহণ করেন উইলিয়াম মারশাল। ১২১৭ সালে লিংকন এবং ডোভার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে লুইস ব্রিটিশ সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করেন এবং ল্যামবেথ সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। শেষ হয় গৃহযুদ্ধ।
পাঠক, শুরুর সাথে শেষের অমিল কি ধরতে পারছেন? প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছিল জন হবেন অত্যন্ত বাজে একজন শাসক। কিন্তু শেষে এসে কি সে ধারণা কিছুটা হলেও পাল্টেছে? আসলে জনের শাসনামলে তার অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি লক্ষ্য করা গেলেও তাকে এতোটা বাজেভাবে কেন উপস্থাপন করা হয় সে বিষয়ে আধুনিক ইতিহাসবিদগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে সে সব কথা অন্য বিতর্কের জন্ম দেবে। মোদ্দা কথা রাজা জন মূলত ব্যারনদের সাথে শত্রুতায় জড়িয়েই ইতিহাসে নিজের অবস্থান দুর্বল করেছেন। আর শেষদিকে অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও ম্যাগনা কার্টার শর্ত ভঙ্গ করা তো আছেই।