প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা আর ঐতিহ্যের এক মেলবন্ধন সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। ইতিহাস আর সংস্কৃতিকে নিয়ত লালন করা সেই দেশে ছড়িয়ে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য। ঐতিহ্যকে যথাযথভাবে মেনে চলার বিষয়ে জাপানীদের জুড়ি মেলা ভার। জাপানের এ ধরনের অনেক স্থান রয়েছে যা ইতিহাস এবং সংস্কৃতির দিক থেকে সম্পদশালী। আজ জাপানের এমনই এক দ্বীপের গল্প শোনাব যেখানে প্রাচীন ঐতিহ্যকে মানা হয় অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও কঠোরতার সাথে।
ওকিনোশিমা দ্বীপ
জাপানের চতুর্দিকে ঘিরে আছে ছোট-বড় অনেক দ্বীপ। এই দ্বীপগুলো নানা ঐতিহ্যের সাক্ষী। তেমনি এক দ্বীপ ওকিনোশিমা। জাপানের মূল কিউশু দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে এবং কোরিয়ান উপদ্বীপের মাঝখানে অবস্থিত ছোট্ট একটি দ্বীপ ওকিনোশিমা। ২৪৪ মিটার (৮০১ ফুট) দীর্ঘ এই দ্বীপের মোট আয়তন ৯৭ হেক্টর (২৪০ একর)। দ্বীপটি মূলত জাপানের মুনকাতা শহরের অংশবিশেষ। ওকিনোশিমাকে মুনকাতার পবিত্র তীর্থভূমি হিসেবে স্থানীয় অধিবাসীরা খুবই মেনে চলে। বর্তমানে এই দ্বীপসহ এর আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা আরো চারটি অঞ্চলকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
প্রাচীন ইতিহাস
ওকিনোশিমা দ্বীপটি ছোট হলেও ঐতিহাসিকভাবে এই দ্বীপটি জাপানীদের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ জাপানের উল্লেখযোগ্য প্রধান তিনটি ধর্মীয় মঠের একটি রয়েছে এই দ্বীপে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা হতে জানা যায়, প্রাচীন যুগ থেকে জেলেরা দ্বীপটিকে খুব পবিত্র মনে করতেন। নবম শতাব্দী থেকে অঞ্চলটিতে মৎস্যজীবীরা মাছ ধরার উদ্দেশ্যে অস্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। মাছ ধরার সময় সমুদ্র যেন শান্ত থাকে সেজন্য জেলেরা তাদের নিরাপত্তার আশায় এ দ্বীপের অস্থায়ী মঠে এসে প্রার্থনা করতেন। মাছ ধরা শেষে তারা আবার নিজেদের গ্রামে ফিরে যেতেন। ফলে জেলেরা সে সময় থেকে এই দ্বীপের পবিত্রতাকে রক্ষা করে চলেছেন। ঐতিহাসিকভাবেও এই দ্বীপের বেশ গুরুত্ব রয়েছে। এই দ্বীপকে কেন্দ্র করে প্রাচীনকালে কোরিয়া ও চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। শিন্টো ধর্মযাজকরা মূলত নিয়ন্ত্রণ করে সম্পূর্ণ দ্বীপটি। আর শুধু ধর্মযাজক ও মঠের কর্মচারীরাই বর্তমানে ওকিনোশিমা দ্বীপে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
দ্বীপের অনন্য বৈশিষ্ট্য ওকিটসুমিয়ার মন্দির
এই দ্বীপের মূল আকর্ষণ সমুদ্রের দেবীর সম্মানে তৈরি মুনাকাতা তাইশা ওকিটসুমিয়ার মন্দির। শিন্টো পুরোহিতেরা খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে এটি বহুবার পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। শিন্টো পুরোহিতদের রক্ষণাবেক্ষণে ১৯৩২ সালের পর থেকে মূল মন্দিরটি একই অবস্থায় রয়ে গেছে। শুধু জাপানেরই নয়, বিশ্বের অন্যান্য মঠের থেকে এটি বেশ স্বতন্ত্রও বটে। এই মন্দিরটি বিশেষত পুরুষদের জন্য; শুধুমাত্র পুরোহিত ও নাবিকরা এই পবিত্র স্থানে আসার সুযোগ পান।
দ্বীপে প্রবেশের নিয়ম
স্থানীয় শিন্টো ধর্মাবলম্বীরা এই দ্বীপটিকে দেবতাদের পবিত্র বাসস্থান মনে করে। তাই তাদের কাছে দ্বীপটি পবিত্র জায়গা হিসেবে পরিচিত। শিন্টো পুরোহিতরা প্রাচীনকাল থেকেই ওকিনোশিমা দ্বীপ এবং ঐতিহ্যবাহী মঠের সংরক্ষণের ব্যাপারে বেশ কড়াকড়ি নিয়ম আরোপ করে আসছেন। এই দ্বীপে আসতে হলে তাকে বেশ কিছু কঠোর অনুশাসন মেনে চলতে হয়। অধার্মিক এবং মহিলাদের এ দ্বীপে প্রবেশ করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। বছরের মাত্র একটি দিনেই ধার্মিক পুরুষদের জন্য দ্বীপটি উন্মুক্ত থাকে। তবে আগত দর্শনার্থীর সংখ্যাও নির্দিষ্ট। শুধুমাত্র ২০০ জন ধার্মিক পুরুষকে এই দ্বীপে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।
১৯০৫ সালের যুদ্ধে জাপান ও রাশিয়ার এক বিশাল সৈন্যবাহিনী জাপান সমুদ্রে মৃত্যুবরণ করেন। এসব শহীদদের স্মৃতিতে প্রতি বছর ২৭ মে দিনটি শিন্টো পুরোহিতরা মঠে বার্ষিক উৎসবের আয়োজন করে। তখন ওকিনোশিমা দ্বীপ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। তবে এই দ্বীপে আগত দর্শনার্থীদের প্রাচীন সবধরণের রীতিনীতি ও অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হয়।
আগত ধর্মাবলম্বীদের এ সময় চতুষ্পদী কোনো প্রাণীর মাংস খাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। দ্বীপে প্রবেশের পূর্বে দ্বীপের জলে নিজেদেরকে শুদ্ধ করে নিতে হয়। এ সময় পুরুষদের সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে সমুদ্রে স্নান করে শুদ্ধ হতে হয়। তারপর পরিস্কার কাপড় পরিধান করে দ্বীপে প্রবেশ করতে হয়।
দ্বীপ পরিদর্শনে আসা অভ্যাগতদের জন্য দ্বীপের আইন খুবই কঠোর। কোনো ধর্মযাজকের অনুমতি ব্যতীত এই দ্বীপ থেকে বের হওয়া যায় না। এই দ্বীপ দর্শনে আসা ব্যক্তিরা পরবর্তীতে এই দ্বীপ সম্পর্কে কোনো কথা বাইরে কাউকে বলতে পারবেন না। এমনকি যাওয়ার সময় দ্বীপ থেকে একটুকরো পাথর কিংবা গাছের পাতাও স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তারা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবেন না। স্থানীয় অধিবাসীরা এবং শিন্টো ধর্মাবলম্বীরা এসব আইন মেনে চলেন। শুধু তা-ই নয়, স্থানীয় জেলেরা দ্বীপে বেড়ে ওঠা পাইন গাছের কোনো শুকনো ডাল সমুদ্রে ভেসে গেলেও তা পর্যন্ত তুলে নেয় না। আর এ কারণেই দ্বীপটি প্রাকৃতিকভাবেও অনেক আকর্ষণীয়।
নারী যেখানে নিষিদ্ধ
জাপানীরা ওকিনোশিমা দ্বীপকে বড়ই পবিত্র মনে করেন। আর এ কারণেই দ্বীপটিতে শুধুমাত্র পুরুষদের প্রবেশাধিকার রয়েছে। কোনো নারীরই সেখানে পা রাখার অধিকার নেই। শিন্টো পুরোহিতেরা এই বিধান অত্যন্ত কঠোরভাবেই অনুসরণ করেন। কিন্তু কেন এই দ্বীপটি নারী বঞ্চিত এবং কেনইবা দ্বীপটিতে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। শিন্টো ধর্মাবলম্বী অনেকরই মত, এই দ্বীপে নারীদের নিষিদ্ধ করার পিছনে রয়েছে ধর্মীয় ঐতিহ্যকে সম্মান জানানো। তবে কী সেই প্রথা সে ব্যাপারে কেউই সুস্পষ্টভাবে কিছু উল্লেখ করতে পারেননি।
তবে এ বিষয়ে দুটি অভিমত বহুল প্রচলিত রয়েছে। তার একটি হচ্ছে দ্বীপটির যাতায়াত ব্যবস্থা। মূল ভূখন্ড থেকে ওকিনোশিমা দ্বীপে পৌঁছানোর রাস্তাটি খুবই বিপদসংকুল এবং কষ্টসাধ্য। প্রাচীনকালে এই পথ দিয়ে নারীদের যাতায়াত অত্যন্ত দুরুহ ছিল বলে কোনো মহিলাকেই তার পরিজনেরা দ্বীপে নিয়ে যেতে সাহস করতো না।
আর অন্য যে মতটি প্রচলিত রয়েছে তা হচ্ছে নারীদের ঋতুস্রাবের সাথে সম্পর্কিত। শিন্টোধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন, সূর্যদেবী আমাতারসু পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি করেছেন এবং মনে করা হতো সম্রাটেরা তার ঔরসজাত। অষ্টম শতাব্দীর আগপর্যন্ত জাপানে নারীদের সন্তান উৎপাদন এবং মাতৃত্ব লাভই প্রধান কাজ ও কর্তব্য বলে মানা হতো। ফলে তাদের ঘরের বাইরে খুব একটা প্রবেশাধিকার ছিল না। এরপর পিতৃতান্ত্রিক কনফুসিয়ানিজম এবং বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ধর্ম পালনের সাথে রক্তের বিশুদ্ধতা, নারীর অশুচিতা এবং অপবিত্রতার বিষয়টিও চলে আসে। ফলে ঋতুমতী নারীদের বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে যাওয়ার ব্যাপারে নানা নিষেধাজ্ঞা তখন থেকেই চলে আসছিল। পরবর্তীতে ধর্মযাজকেরা তা মানতে শুরু করে। আর এ কারণেই ওকিনোশিমা দ্বীপে নারীদের প্রবেশ নিষেধ।
দ্বীপে সংরক্ষিত ঐতিহাসিক যত শিল্পকর্ম
ঐতিহাসিকভাবে দ্বীপটি বেশ সম্পদশালী এবং নানা শিল্পসামগ্রীর সংরক্ষণশালা হিসেবেও দ্বীপটি বেশ পরিচিত। দ্বীপটিতে ঐতিহাসিক যুগের প্রচুর মূল্যবান শিল্পকর্ম রয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হাজার হাজার শিল্পসামগ্রী এবং কোরিয়া উপদ্বীপ থেকে আনা বহু মূল্যবান সামগ্রী; যেমন- সোনার বিভিন্ন সামগ্রী, পুরনো পার্সিয়ান ধাতব বস্তু এই দ্বীপে রক্ষিত আছে। অন্তত ৮০ হাজার শিল্পকর্ম এই দ্বীপে সংরক্ষিত আছে বলে ধারণা করা হয়। ফলে জাপান সরকার ওকিনোশিমা দ্বীপটিকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করেছে । আর দ্বীপটির সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ জাপান সরকারের কাছে বেশ গুরুত্ব বহন করে।
ইউনেস্কো হতে স্বীকৃতি
জাপান সরকার ওকিনোশিমা দ্বীপটিকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য মনোনয়নের সিদ্ধান্ত নেয়।। ২০১৭ সালে জাপানের পক্ষ থেকে যে পাঁচটি স্থানকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্তি করার জন্য জাপান সরকার ইউনেস্কোর কাছে প্রস্তাব পেশ করে, তার মধ্যে অন্যতম এই দ্বীপটি। ২০১৭ সালের মে মাসে জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতি পায় ওকিনোশিমা দ্বীপের এই প্রাচীন ধর্মীয় স্থানটি।
তবে এই মর্যাদা পেতে জাপান সরকারকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কারণ ওকিনোশিমা দ্বীপটি নারী বর্জিত বলে অনেক দেশের অনেক ধর্মপ্রাণ এই হেরিটেজ মর্যাদা দেয়ার বিপক্ষে জোর প্রতিবাদ জানায়। তবে জাপান সরকার সকলকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, এই অঞ্চলটিতে নারীদের নিষিদ্ধ করা হয়নি। এমনকি এ ধরণের কোনো লিখিত আইনও নেই দ্বীপটিতে। তাই এই দ্বীপকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যায় বলে জাপান সরকারের দাবী জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক সংস্থা মেনে নিতে বাধ্য হয়। পোল্যান্ডে আয়োজিত রাষ্ট্রসংঘের বার্ষিক সম্মেলনে ৭০০ বর্গমিটার আয়তনের এই দ্বীপটিকে হেরিটেজের মর্যাদা দেওয়া হয়। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত জাপানের ২৯টি জায়গা বিশ্ব ঐতিহ্যের তকমা পেল।
পর্যটকদের জন্য আজও নিষিদ্ধ
বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর ওকিনোশিমা দ্বীপটিতে পর্যটকদের যাতায়াত বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হলেও তা সম্ভবত সত্যি না-ও হতে পারে। এর কারণ শিন্টো ধর্মযাজকেদের প্রভাব। তারা কিছুতেই এ দ্বীপটিতে বহিরাগতদের আগমন মেনে নিতে চান না। আর তাই তারা পর্যটকদের আগমন নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন।
এ ব্যাপারে সতর্ক প্রতিক্রিয়াও প্রায় সময় ব্যক্ত করা হয়েছে। মুনাকাতার তিনটি শীর্ষ মঠের প্রধান যাজক তাকায়ুকি আশিজু এক সাক্ষাৎকারে জানান, “ইউনেস্কোর ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও আমরা এই দ্বীপের পবিত্রতা পূর্বের মতোই মেনে চলবো। দ্বীপটিতে সাধারণ মানুষের জন্য তো বটেই, এমনকি নারীদের জন্যও খুলে দেয়া হবে না। উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ ব্যতীত সাধারণ মানুষদের অযথা সবসময় দেবতাদের কাছে আসা ঠিক নয়।”