ইরানে ইসলামিক বিপ্লব হয়েছে সেই ১৯৭৯ সালে। এরপর থেকে মোটামুটি বড় ধরনের কোনো হামলার শিকার হয়নি দেশটির মানুষ। আশপাশের অন্য দেশগুলোতে যখন হানাহানি আর রক্তাক্ত হামলা নিত্যকার ব্যাপার, তখনো ইরানে মানুষজন নিরাপত্তা নিয়ে তেমন শঙ্কার মধ্যে ছিল না। কিন্তু এবার বোধ হয় সেই দিন ফুরোলো! ইরানের পার্লামেন্টে (মজলিস) এবং ইমাম খোমেনির সমাধিস্থলে বুধবারের সন্ত্রাসী হামলায় অনেকটাই কেঁপে উঠেছে ইরানের স্থিতিশীলতা। আরো ভয়ের বিষয় হচ্ছে, ইরানের অভ্যন্তরে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের এটাই প্রথম বড় ধরনের হামলার ঘটনা। এর মাধ্যমে তারা জানান দিতে চেয়েছে ইরানের ভেতরে তাদের উপস্থিতি। অবশ্য ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরানের সরকার এই ঘটনার পর যথারীতি এর জন্য আমেরিকাকে দায়ী করেছে এবং ইরানের পার্লামেন্ট এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে ‘আমেরিকা ধ্বংস হোক’ স্লোগান তুলেছে। তবে বিশ্বজুড়ে বিশ্লেষকদের মতামত, ইরানের শক্তি এবং স্থিতিশীলতার দুটি প্রতীকী স্থাপনায় আইএসের এই হামলা যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ।
যা ঘটেছিল
বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বুধবার ইরানের পার্লামেন্ট মজলিসে এবং তেহরানে সাবেক ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির মাজারে পৃথক দুটি হামলায় ১২ জন নিহত এবং আরো ৪২ জন আহত হয়েছে। ইরানের সরকারি সূত্রগুলোও এই হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত করেছে। দুটি হামলায় মোট ৫ জন হামলাকারী অংশ নেয় বলে জানা গেছে। ইরানের ডেপুটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জানিয়েছেন, মহিলাদের ছদ্মবেশে অস্ত্রধারীরা পার্লামেন্টের ভেতরে ঢুকে গুলি করা শুরু করে। এদের একজন শরীরে বাঁধা বোমার বেল্টের বিস্ফোরণ ঘটায়। বন্দুকধারীদের হাতে একে-৪৭ রাইফেল এবং পিস্তল দেখা গেছে। ইরানের বার্তা সংস্থা ইরনা জানিয়েছে, একজন বন্দুকধারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেখানে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক গোলাগুলির শব্দও শোনা গেছে বলে জানান প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা।
এদিকে পার্লামেন্টে গুলির ঘটনার প্রায় আধা ঘণ্টা পর কয়েক কিলোমিটার দূরে শহরের দক্ষিণে ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া আয়াতুল্লাহ খোমেনির সমাধিস্থলে গুলির ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ আহত হয়। তেহরানের গভর্নর জানান, একজন হামলাকারী আত্মঘাতী ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটায়। আরেকজন নিরাপত্তার বাহিনীর হাতে নিহত হন।
এই হামলার পর ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইরানের সরকারি কর্মকর্তারা জানান তেহরানের দুই অংশেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে নিরাপত্তা বাহিনী। তাছাড়া নিরাপত্তা বাহিনী তৃতীয় আরেকটি হামলার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়ে সন্ত্রাসীদের আটক করেছে বলেও জানা গেছে। এই হামলার ঘটনায় আহতদের সেবা দিতে চিকিৎসা কার্যক্রম চালাচ্ছে তেহরানের সরকারি হাসপাতালগুলো। এছাড়া দেশের বিভিন্ন হাসপাতালও জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সতর্ক ও প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান ইরানি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
দায় স্বীকার আইএসের
এই হামলার ঘটনার পর দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট। তাদের অনলাইন প্রকাশনা আমাক এ প্রকাশিত এক বিবৃতির মাধ্যমে তেহরানে দুটি স্থানে হামলার কথা স্বীকার করে তারা। আইএসের বিবৃতিতে বলা হয়, ইরাকে এবং সিরিয়ায় ইরানের ভূমিকার প্রতিশোধ হিসেবেই এই হামলা চালিয়েছে তারা। ইরান বলছে দেশটির তেহরানে হামলায় ১২জনকে হত্যার ঘটনায় জড়িত হামলাকারীরা ছিলেন ইসলামিক স্টেট বা আইএসে যোগ দেয়া ইরানের নাগরিক। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে একজন সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন ইরান থেকেই বন্দুকধারীদের নিয়োগ করেছে আইএস। উল্লেখ্য, ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে এই হামলার ঘটনা ঘটলো। এটাকে ইরানের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় রকমের ধাক্কা হিসেবেই দেখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া
তেহরানে সন্ত্রাসী হামলার পর নিন্দা জানিয়েছে আমেরিকা, কাতার, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ। আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হিদার নওয়ার্ট বলেন, শান্তিপূর্ণ, সভ্য বিশ্বে সন্ত্রাসের অশুভ শক্তির ঠাঁই নেই। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে ঘটনার নিন্দা করে বলেছে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তারা জোরদার অবস্থান নিয়েছে। জার্মানি বলেছে, তারা ‘কঠোরতম ভাষায়’ এ হামলার নিন্দা জানায়।
ইরানে আইএসের থাবা
আইএসের উত্থানের পর থেকেই ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে সিরিয়া এবং ইরাকে সক্রিয়ভাবে লড়াই করছে ইরান। কিন্তু ইসলামিক স্টেট মঙ্গলবারের আগ পর্যন্ত ইরানের ভেতর কোনো সন্ত্রাসী হামলা চালাতে পারেনি। এর একটা কারণ হয়তো ইরানের শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাদের ঢোকার কোনো রাস্তা ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠী ফার্সি ভাষায় তাদের প্রচারণা জোরদার করে। এরা টার্গেট করেছিল ইরানের সংখ্যালঘু সুন্নি মুসলিমদের।
ইরানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দাবি করেছে যে ইসলামিক স্টেটের মদদে ইরানের ভেতরে কিছু হামলার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। সেগুলো তারা ভন্ডুল করে দেয়। ইসলামিক স্টেট কিছু প্রপাগান্ডা ভিডিও ছেড়েছিল যেগুলোতে ইরানের ভেতর হামলায় উস্কানি দেয়া হয়। ডকুমেন্টারি স্টাইলে তৈরি করা আইএস এর এক ভিডিওতে কিছু জঙ্গিকে দেখানো হয় যাদের ইরানি বলে পরিচয় দেয়া হচ্ছে। এরা ইরাকে আইএস এর বিভিন্ন ঘাঁটিতে কাজ করছে। এসব জঙ্গিকে ফার্সি ভাষায় ইরানের সরকার এবং আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি সহ ধর্মীয় নেতাদের সমালোচনা করতে দেখা যায়। আইএস এবং এর আগে আরেক সুন্নি জিহাদি গোষ্ঠী আল কায়েদা অতীতে ইরানকে টার্গেট করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সফল হয়নি। কিন্তু বুধবারের হামলার পর আইএস হয়তো দাবি করতে পারে যে এক্ষেত্রে তারা এবার সফল হয়েছে। এর ফলে ইরানকে এখন ঘরের বাইরে আইএস দমনে লড়াইয়ের পাশাপাশি দেশের ভেতরেও আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কৌশল তৈরি করতে হবে।
ইরানের প্রতিক্রিয়া
অবশ্য সরকারিভাবে এই ঘটনায় ইরানের প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকাকেই দায়ী করা হয়েছে। যথারীতি এই হামলার পর ইরানের পার্লামেন্ট অধিবেশন শেষে ইরানের স্পিকার আলি লারিজানি তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসীরা নতুন এক সমস্যা তৈরি করতে চায়, বিশেষ করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সন্ত্রাস-বিরোধী লড়াইয়ের এক সক্রিয় অক্ষ বলেই তারা নতুন সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তিনি আজকের দুই সন্ত্রাসী হামলাকে ছোটখাটো ঘটনা বলে মন্তব্য করেন। লারিজানি জোর দিয়ে বলেন, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী অবশ্যই এই সন্ত্রাসীদের মোকাবেলা করবে ও এর ফলে সমস্যাটির সমাধান হবে। ইরানি সংসদের সদস্যরাও এদিনের অধিবেশন শেষে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানান এবং তারা ‘আমেরিকা ধ্বংস হোক’ বলে শ্লোগান দেন।
পরে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনি বলেন, তেহরানে জঙ্গি হামলার ফলে ইরানি জনগণ ও সরকারের লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্পে বিন্দুমাত্র বিঘ্ন ঘটবে না। তিনি বুধবার সন্ধ্যায় তেহরানে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের জন্য আয়োজিত পূর্ব নির্ধারিত এক ইফতার অনুষ্ঠানে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, তেহরানের সন্ত্রাসী হামলা নতুন প্রজন্মের সামনে এই বাস্তবতা তুলে ধরেছে যে, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী হামলা কত জঘন্য কাজ এবং জঙ্গিরা কীভাবে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। তিনি বলেন, ইসলামি বিপ্লবের পরপর সারা ইরানে বুধবারের হামলার চেয়েও জঘন্য পরিবেশ বিরাজ করেছে। কিন্তু ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির কাছে সন্ত্রাসবাদ পরাজিত হয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি তেহরানে বুধবারের সন্ত্রাসী হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত’ আখ্যায়িত করে এর নিন্দা নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে তার দেশ শত্রুদের সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করবে।
এই হামলার ঘটনা ঠিক এমন সময়ে ঘটলো যখন ইরানের সঙ্গে তার প্রতিবেশি আরব দেশগুলোর কাতার ইস্যুতে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। সেই উত্তেজনার আগুণে নতুন করে কাঠ যুগিয়ছে এই হামলা। এই হামলার ঘটনার পর সারাসরি সৌদির দিকে আঙুল তুলেছে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)। এক বিবৃতিতে আইআরজিসি বলেছে, এ অঞ্চলের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার (সৌদি আরব)-এর সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বৈঠকের এক সপ্তাহ পর এই সন্ত্রাসী হামলাটি হয়েছে। এটা প্রমাণ করে এই নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে তারা (সৌদি আরব) জড়িত। কাতারের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার পর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার পর ইরানের এ অভিযোগ পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তুলতে পারে।