পপ সম্রাটের ফিরে আসা, অতঃপর…
২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল, লন্ডনের বিখ্যাত কনসার্ট হল ‘ওটু এরেনা’ থৈ থৈ করছে সহস্র অপেক্ষমান ভক্তের কলকাকলিতে। তারা সবাই অপেক্ষা করছেন ‘কিং অফ পপ’কে এক নজর দেখার জন্য, ঘন্টাখানেক হলো দাঁড়িয়ে আছেন সবাই। অবশেষে মহাতারকা দেখা দিলেন। কালো লিমুজিন গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই কণ্ঠশিল্পী। মিলিটারি স্টাইলের এমব্রয়ডারি করা জ্যাকেট, কালো প্যান্ট আর সানগ্লাস, সাথে চিরচেনা আন্তরিক হাসির অভিব্যক্তি। মুহূর্তেই উল্লাসে ফেটে পড়লো ভক্তরা। গোটা ওটু এরেনা ‘মাইকেল, মাইকেল’ ধ্বনিতে মুহুর্মুহু কেঁপে উঠছে। উত্তেজিত জনতাকে সামাল দিতে নিরাপত্তারক্ষীদের বেহাল দশা। মঞ্চে আবিষ্ট হলেন মাইকেল। মাইক্রোফোনের সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে চারপাশের আবহটা উপভোগ করলেন তিনি। তারপর লাজুক কণ্ঠে ভক্তদের উদ্দেশ্যে বললেন, “আই লাভ ইউ!”
আবারও প্রকম্পিত হল ভেন্যুর অন্দরমহল। হবেই না বা কেন? দীর্ঘ ৮ বছরের নিঃসঙ্গ-নির্বাসিত জীবনের ইতি টেনে আবারও মঞ্চে পারফর্ম করতে চলেছেন মাইকেল! ১৯৯৭ সালের পর থেকেই মঞ্চে অনুপস্থিত তিনি। সেই হিসেবে বিরতিটা প্রায় এক যুগের। এর মাঝেই সঙ্গীত জগতের চালচিত্র বেমালুম পাল্টে গেছে। নতুন অনেক শিল্পীর উত্থান হয়েছে, আবার অনেকের পতন হতেও সময় লাগেনি। কিন্তু মাইকেলের আবেদন এক বিন্দুও কমেনি। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সব বয়সের দর্শকের সরব উপস্থিতি তার তারকাখ্যাতিকে কষ্টি পাথরে ঘষে প্রমাণ করলো আরেকবার।
ফিরে আসি ওটু এরেনাতে, মাইকেলের ভক্তদের মাঝে। মাইকেল ঘোষণা দিলেন, যুক্তরাজ্যের মাটিতে শেষবারের মতো পারফর্ম করতে যাচ্ছেন তিনি। কনসার্ট ট্যুরের নাম ‘দিস ইজ ইট’। বিদায় নেবার সময় প্রিয় ভক্তদের বলে গেলেন মাইকেল, আবার দেখা হবে! সেদিন কেউ হয়তো ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি, মাইকেল আর কখনো ফিরবেন না তার ভক্তদের মাঝে। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কাছে পরাজিত হয়ে না ফেরার দেশে চলে যান পপ জগতের অবিসংবাদিত সম্রাট। ২৫ জুন ২০০৯, এই দিনটির মাধ্যমে শেষ হয় মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন নামের কালজয়ী এক শিল্পীর জীবন। নাচ, গান আর মিউজিক ভিডিওর আবেদন- এই তিনটি গুণই বোধহয় মাইকেলকে ভালোবাসার জন্য যথেষ্ট ছিল। চলুন ঘুরে আসা যাক পপ সম্রাটের জীবনের কিছু অধ্যায় থেকে।
গল্পের শুরু
১৯৫৮ সালের ২৯ আগস্ট। ইন্ডিয়ানার গ্যারিতে এক বর্ধিষ্ণু কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে মাইকেল জ্যাকসনের জন্ম। দারিদ্রপীড়িত পরিবারটির কর্তা ও মাইকেলের বাবা জোসেফ ওয়াল্টার জ্যাকসন তার ছেলেদের সঙ্গীত প্রতিভা নিয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন। ছেলেদের দিয়ে গানের দল বানিয়ে আয়ের পথও বের করে ফেলেন তিনি। পাঁচ ভাইকে নিয়ে গড়া সেই ব্যান্ডের নাম ‘জ্যাকসন ফাইভ’, সর্বকনিষ্ঠ মাইকেল সেই দলের প্রাণভোমরা। ধীরে ধীরে ‘জ্যাকসন ফাইভ’ জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া মাইকেল আলোচনায় আসেন এই ব্যান্ডের কারণেই। বড় ভাইদের সাথে মঞ্চে তার সরব উপস্থিতি দর্শকদের অভিভূত করে। কে জানতো এই বিস্ময় বালক একদিন পৃথিবীতে সঙ্গীতের জগতে রাজত্ব করবেন!
জ্যাকসন ফাইভের সাথে থাকাকালে মাইকেল চারটি একক অ্যালবাম রেকর্ড করেন। তখনই হয়ত তিনি অনুধাবন করেছিলেন, তার ভবিষ্যৎ এই ব্যান্ডের সাথে নয়, একক ক্যারিয়ার গড়ার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। মাঝখানে একটি সিনেমায় কাকতাড়ুয়ার চরিত্রে অভিনয় করে ফেলেন মাইকেল। ‘দ্য উইজ’ নামের সেই সিনেমাটি অবশ্য ব্যবসায়িক সাফল্য পায়নি।
১৯৭৯ সালে মুক্তি পায় মাইকেলের পঞ্চম একক অ্যালবাম ‘অফ দ্য ওয়াল’। পপ আর ফাংক ধাঁচের অ্যালবামটি সাড়া ফেলে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গীতাঙ্গনে। স্টিভি ওয়ান্ডার আর পল ম্যাকার্টনির মত বাঘা বাঘা তারকারা এই অ্যালবামের গান লিখেছিলেন।
তিন বছর বিরতির পর ১৯৮২ সালে মাইকেল ফিরে এলেন নতুন অ্যালবাম নিয়ে। ‘থ্রিলার’ নামের সেই অ্যালবাম সঙ্গীতের ইতিহাসে অনন্য সাধারণ এক মাত্রা যোগ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক বিক্রিত অ্যালবামের তালিকার শীর্ষস্থানটি আজও থ্রিলারের দখলে। মোট ১২টি গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়ে ৮টিই জিতে নেয় এই মাস্টারপিস। থ্রিলারের সবগুলো গানই জনপ্রিয় হয়েছিল, কিন্তু আলাদা করে টাইটেল ট্র্যাক ‘থ্রিলার’-এর কথা বলতেই হবে। জন ল্যান্ডিসের পরিচালনায় নির্মিত হয় থ্রিলারের ১৪ মিনিটের মিউজিক ভিডিও। হরর সিনেমার মতো ভিডিওতে জম্বির সাজে হাজির হন খোদ মাইকেল, তার মোহনীয় নাচের ভঙ্গি আর কণ্ঠের জাদুতে থ্রিলার আমেরিকায় তোলপাড় ফেলে দেয়।
১৯৮৭ সালে মাইকেলের প্রত্যাবর্তন হয় ‘ব্যাড’ অ্যালবামের মাধ্যমে। ইতোমধ্যেই মাইকেলের মুনওয়াক তাকে নৃত্যশিল্পীর মর্যাদা দিয়ে ফেলেছে, থ্রিলারের মিউজিক ভিডিওগুলো তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। মাইকেল চাইতেন তার সব কাজ নিখুঁত হোক। মিউজিক ভিডিও শব্দটি তিনি কখনোই ব্যবহার করতেন না, তার সব গানের ভিডিওকে তিনি একেকটা স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচিত্র হিসেবেই বানাতেন। ব্যাড অ্যালবামের টাইটেল ট্র্যাক ‘ব্যাড’ এর ভিডিও বানানোর জন্য তিনি কিংবদন্তীতুল্য চিত্রপরিচালক মার্টিন স্করসেজির শরণাপন্ন হলেন। এবারেও বাজিমাত। ব্যাডের ৫টি গান বিলবোর্ডে প্রথম স্থান দখল করল, মাইকেল আবারও তার জাত চেনালেন। কনসার্ট করতে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও’ প্রান্তে ছুটে যেতে লাগলেন তিনি। মঞ্চে তার নাচ-গানে বিমোহিত দর্শক-শ্রোতা অজ্ঞান হয়ে যেতে লাগলো হরহামেশাই। মাইকেল পেয়ে গেলেন তার উপাধি ‘কিং অফ পপ’। এলভিস প্রিসলির একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন তিনি।
১৯৯৪ সালে এলভিস তনয়া লিসা মেরি প্রিসলিকে বিয়ে করেন মাইকেল। নিজের আইডলের মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করলেও মাত্র দু’বছর সংসার করেছিলেন তারা। ১৯৯৬ সালে মাইকেল বিয়ে করেন ডেবি রোও নাম্নী এক নার্সকে। এই দম্পতির ঘরে জন্ম নেয় মাইকেলের দুই সন্তান প্রিন্স জ্যাকসন আর প্যারিস জ্যাকসন। ডেবি রোও-এর সাথেও খুব বেশি দিন সংসার করা হয়নি মাইকেলের, ১৯৯৯ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
বর্ণালী জীবন
ব্যক্তিজীবনে মাইকেল ছিলেন অত্যন্ত লাজুক ও প্রচারবিমুখ, খুব প্রয়োজন না হলে তিনি ক্যামেরার সামনে সাক্ষাৎকার দিতেন না। ভালোবাসতেন মেক্সিকান খাবার, সময় পেলেই বই পড়তেন। পোষা প্রাণীর বাতিক ছিল মাইকেলের। শিম্পাঞ্জী বা অজগর- সবই ছিল তার পোষ্য। মিউজিক ভিডিও নিয়ে মাইকেলের খুঁতখুঁতে স্বভাবের কথা আগেই বলেছি। সবসময় চাইতেন নিজের সেরাটা দিতে। তার বোন জ্যানেট জ্যাকসনকে নিয়ে বানিয়েছিলেন সর্বকালের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মিউজিক ভিডিও ‘স্ক্রিম’। ৭ মিলিয়ন ডলার বাজেটের ভিডিওটি সম্পূর্ণ সাদাকালো।
পঞ্চাশ বছর বয়সী মাইকেলের মৃত্যুর খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সংবাদমাধ্যমে। কেউ যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। সবাই একসঙ্গে ব্রাউজ করায় ওয়েবট্রাফিকে পড়ে অস্বাভাবিক চাপ। অপ্রত্যাশিত এত ব্যবহারকারী দেখে গুগল ধরেই নেয় তাদের সার্চ ইঞ্জিনে কেউ হামলা করেছে! ইনস্ট্যান্ট মেসেঞ্জার, ইউটিউব, উইকিপিডিয়া সহ অনেক জনপ্রিয় ওয়েবসাইটের সার্ভার ক্র্যাশ করে। প্রতি মিনিটে ছয় হাজারের বেশি টুইটের চাপ নিতে পারেনি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট টুইটার। ৪০ মিনিট ওয়েবসাইটটি ছিল ক্র্যাশড অবস্থায়।
মাইকেলের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে গোটা বিশ্বে। তার প্রিয় সহকর্মী আর বন্ধুরা ব্যথিত হৃদয়ে বিদায় জানান মাইকেলকে। চিত্রপরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ মাইকেলের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় বলেন,
“Just as there will never be another Fred Astaire or Chuck Berry or Elvis Presley, there will never be anyone comparable to Michael Jackson. His talent, his wonderment and his mystery make him legend.”
মাইকেলের কথিত সাবেক প্রেমিকা পপ কুইন ম্যাডোনা বলেন,
“I can’t stop crying over the sad news. I have always admired Michael Jackson. The world has lost one of the greats, but his music will live on forever! My heart goes out to his three children and other members of his family. God bless.”
মাইকেল জ্যাকসনের মতো মহান শিল্পীর আসলেই মৃত্যু নেই। তিনি বেঁচে থাকবেন তার শত কোটি ভক্তের হৃদয়ে, তার গানের মধ্য দিয়ে।